২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৫৯

যানজট : বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও পরিসংখ্যান কি সঠিক?

মো: গোলাম হোসেন

ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বিশ্বব্যাংক গত ১৯ জুলাই টুওয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বহু বিদেশী বিশেষজ্ঞও অংশ নেন। সেমিনারে গৃহীত প্রতিবেদনে যানজটের কবলে পড়ে দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। পরিসংখ্যানটি বিবেচনায় নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন অনেকেই। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও হয় বেশ কয়েক দিন ধরে। প্রশ্ন হচ্ছে, পরিসংখ্যানটি আদৌ বাস্তবসম্মত কি না। ‘৩২ লাখ কর্মঘণ্টা’ তথ্যটি এসেছে বিশ্বব্যাংকের মুখ থেকে। বিশ্বব্যাংক ও অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্তের বিষয় অসঙ্গতি ও অবাস্তবতার অভিযোগ বহু পুরনো। এবার তাদের গবেষণার ফলাফলটি একটু পরখ করা যাক।

ঢাকায় রিকশার সংখ্যা কত? অনেকের ধারণা মতে পাঁচ লাখের কম নয়। ধরলাম চার লাখ। রিকশাগুলো চলে ৮৪ ঘণ্টা করে দুই শিফটে। সুতরাং চালকের সংখ্যা আট লাখ। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট ১৫ মিনিটের রাস্তায় গড়পড়তা সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। অর্থাৎ প্রতি আট ঘণ্টায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টাই অপচয়। প্রতিজন রিকশা চালকের প্রতি শিফটে পাঁচ ঘণ্টা অপচয় ধরা হলেও আট লাখ চালকের দৈনিক নষ্ট হয় ৪০ লাখ কর্ম ঘণ্টা। অন্য দিকে, প্রতিজন চালক যদি দৈনিক আট ঘণ্টায় আটটি ট্রিপ দিতে সক্ষম হোন এবং মোট ১২ জন যাত্রী (প্রতি ট্রিপে দেড় জন) বহন করেন তা হলে আট লাখ রিকশাচালক দৈনিক ৯৬ লাখ যাত্রী পরিবহন করেন বলে ধারণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে যাত্রীপ্রতি আধা ঘণ্টা অপচয় ধরা হলে সময়ের অপচয় দাঁড়ায় ৪৮ লাখ কর্মঘণ্টা। এর বাইরে সাইকেল, ভ্যান ইত্যাদি যদি তিন লাখ হয়, তা হলে কম করে হলেও এর সাথে আরো অন্তত ১২ লাখ কর্মঘণ্টা যোগ হবে।
বিআরটির তথ্য মতে মে ২০১৭-তে ঢাকায় চলাচলকারী যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ১৪ হাজার ১৯১টি। ধরা যাক, এর মধ্যে ৯ লাখ (তথা ২১ শতাংশ) রাস্তায় সচল থাকে এবং দৈনিক এক কোটি যাত্রী পরিবহন করে। তাহলে (যানবাহনপ্রতি গড়ে ১১ জন) আর যাত্রীপ্রতি দুই ঘণ্টা সময় অপচয় হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে মোট দুই কোটি কর্মঘণ্টা অপচয় ধরা যেতে পারে। ৯ লাখ যান্ত্রিক পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট ড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টর ইত্যাদি মিলে সংখ্যাটি ১৪ লাখ হয় এবং মাথাপিছু ৫ ঘণ্টা সময় অপচয় হয়; তা হলে সময়ের অপচয় দাঁড়ায় ৭০ লাখ কর্মঘণ্টা। এর বাইরে ঢাকায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আট-নয় লাখ মানুষ আসেন নানা কাজে। ভাসমান এই সংখ্যাটির মাথাপিছু তিন ঘণ্টা সময় অপচয় ধরা হলে ন্যূনতম সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৪ লাখ কর্মঘণ্টা এবং এ যাবৎ সার্বিক সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩৯৪ লাখ কর্মঘণ্টা। এর সাথে যারা যানজটের কবলে পড়ে দিনান্তে ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়ে ঢাকাতেই থেকে যান, যারা যানজট এড়াতে পদ দলে চলেন তাদের সময় অপচয়টি যোগ করা হলে সর্বমোট ৪০০ লাখ বা চার কোটি কর্মঘণ্টা ছাড়িয়ে যাবে। পরিসংখ্যানটি ভিন্নভাবেও যাচাই করা যায়। জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের হালনাগাদ জনসংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখের কম নয়। ধরা যাক, এদের ৩ ভাগের ২ অংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রাত্যহিক কাজে রাস্তায় বের হন। এর পাশে ১০ লাখ ভাসমান মানুষ যোগ করা হলে সংখ্যাটি ১ কোটি ৩০ লাখ দাঁড়ায়। যানজটের কারণে প্রতিজনের গড়পড়তা ৩ ঘণ্টা দাঁড়ায়। ৩ কোটি ৯০ লাখ কর্মঘণ্টা, ৪ কোটি আর ৩ কোটি ৯০ লাখের পার্থক্যটি একেবারেই স্বাভাবিক। আমরা এখানে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরলাম, তাতে যানজটের কারণে মাথাপিছু সময়ের অপচয় ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের মতো। আর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩২ লাখ কর্মঘণ্টায় মাথাপিছু সময়ের অপচয় হয় মাত্র ১০ মিনিট। কোনটি বাস্তবসম্মত তা সহজেই অনুমেয়।

যানজটজনিত আর্থিক ক্ষতির দিকে এবার নজর দেয়া যাক। প্রতি ঘণ্টায় ৭৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি ধরা হলে ৩০০ কোটি টাকা দৈনিক ক্ষতি (এটি মাথাপিছু দৈনিক আয় ৬০০ টাকা হিসাবে।) আর আমরা যদি ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়ে থাকি তাহলে ক্ষতিটা হবে দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ বছরে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা আমাদের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বড়। অতিরিক্ত জ্বালানি তেল পোড়ার জন্য ক্ষতিটা এর বাইরে যা নেহাত কম নয়। আর আর্থিক ক্ষতির সাথে টাকায় পরিমাপ যোগ্য নয়। এমন ক্ষতিগুলো বিবেচনায় নেয়া দরকার। যেমন কর্মস্থলে সঠিক সময় না পৌঁছার ক্ষতি, পটুয়াখালীর যাত্রীর লঞ্চ ফেল করার ক্ষতি, পরীক্ষার্থী যথাসময় হলে না পৌঁছতে পারায় খারাপ ফলের ক্ষতি, অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মারা যাওয়ার ক্ষতি, ভ্যানগাড়িতে প্রসূতির সন্তান প্রসবের ক্ষতি, সময় মতো আদালতে পৌঁছতে না পারার জন্য রায় বিপক্ষে যাওয়ার ক্ষতি ইত্যাদি।

অবাক হওয়ার বিষয়, অপরিকল্পিতভাবে শহর গড়ে ওঠার পরিণামে ব্যাপক ভূমিধসের আশঙ্কা করা হলেও বিশ্বব্যাংক কার্যত সেই ঝুঁকি বাড়ানোর পরামর্শই দিলো যেন। একসময় ৪০-৫০ ফুট খুঁড়লেই ঢাকা শহরে পানি পাওয়া যেত। এখন হাজার ফুটেও পানি দুর্লভ। ভূগর্ভে ক্রমবর্ধমান পানিশূন্যতায় মাটির স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রভাব পড়ছে বৃক্ষলতার ওপর। ঢাকা উত্তর ও পশ্চিমে সম্প্রসারিত হয়েছে বটে, তবে এর এক বড় অংশ প্রাকৃতিক বিলঝিল ভরাট করেই। ঢাকা শহরের খালগুলোর মতো এখন বিলঝিলও বিলুপ্ত। ৩০ মিনিটের বৃষ্টির পানি কেন ৩ দিনেও সরে না তা অনুসন্ধানে হয়তো বা বিদেশী বিশষজ্ঞই খোঁজা হবে এখন। ফাইওভারের নিচে হাঁটুডোবা ময়লা কাদা উন্নয়নে হাসির খোরাক এখন। ঢাকার পূর্ব পাশে নিচু জমি ভরাট করে আরেকটি ডিএনডি সৃষ্টি করা হলেই ঢাকা যানজটমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক কি নিশ্চিত? হ্যাঁ, অকৃতজ্ঞ নই বলে স্বীকার করি, বিশ্বব্যাংক আমাদেরও উন্নয়ন চায় যেমন একজন গৃহকর্ত্রী তার কাজের বুয়ার ছেলেটির উন্নতি চায়। আমরা জাপান বা ব্রিটেনের সমকক্ষ হই বিশ্বব্যাংক বা উন্নয়ন সহযোগীরা কি তা চাইতে পারে? বুঝতে হবে ওরা আমাদেরও গণতন্ত্রী বানাতে চায়, তবে ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো নয় বরং আলজেরিয়া বা মিসরের মতো।

শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর চৌহদ্দির মধ্যে ৩০-৩৫ বর্গমাইলের এই নিচু এলাকাটি আজো কোনো মতে শহরের প্রাণ রক্ষা করছে। নগর কেন্দ্রের কাছাকাছি বলে ভূমিদস্যুদের অশুভ নজর এ দিকে যে পড়েইনি তা কিন্তু নয়। এবার নজর পড়েছে বিশ্বব্যাংকেরও। সুতরাং ঠেকানো হয়তো বা দায় হবে। আর আমরা তো কেবল বিনিয়োগ চাই। পূর্ব দিকে নিচু ভূমিতে নগরায়ন অগত্যা দু’টি শর্তে চিন্তা করা যেতে পারে। ক. তা হতে হবে কোনো প্রকার মাটিভরাট ছাড়াই। খ. এই নগরায়ন কোনো কোম্পানি অথবা ব্যক্তিমালিকানায় নয়; বরং তা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে একমাত্র রাজুকের অধীনেই হতে হবে। মাটি ভরাট না করে তা কেমন করে সম্ভব এ বিষয় ইনশা আল্লাহ আরেক দিন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/246850