২৪ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৬:৩০

শেষ মুহূর্তেও শেষ হচ্ছে না হজযাত্রীদের অনিশ্চয়তা

ভিসা-টিকিট হয়নি অনেক যাত্রীর ** বাড়তি ফ্লাইটের অনুমতি দেয়নি সৌদি আরব ** প্রতারণায় মধ্যস্বত্বভোগী ও এজেন্সি মালিকেরা ** প্রতারিতদের কান্নায় ভারী হজ ক্যাম্প

প্রতিটি ধর্মপ্রান মুসলমান স্বপ্ন দেখেন জীবনে অন্তত একবার হলেও আল্লাহর ঘরে যাবেন, হজ পালন করবেন। সামর্থবানদের জন্য এই ফরজ এবাদত পালনের জন্য বছরের পর বছর কেউ অপেক্ষা করেন আবার সীমিত আয়ের মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতে থাকেন। জমি-জিরাত বেচেও অনেকে লালিত স্বপ্ন পুরনের জন্য অধীর আগ্রহে দিনযাপন করেন। কিন্তু প্রতি বছরই হজে যাওয়ার সময় এলেই ভোগান্তি যেনো ঘিরে ফেলে হজ যাত্রীদের। প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত কেউ সম্পুর্ন নিশ্চিত হতে পারেন না যে,তিনি নির্বিঘ্নে সৌদি আরব পৌছাতে পারবেন।

এবছর শুরু থেকেই শুরু হয়েছে হজযাত্রীদের ভোগান্তি। প্রথমে নিবন্ধন নিয়ে দুর্নীতি। তারপর প্রি-ভিসা জটিলতা, সময় মতো ভিসার আবেদন না করা,মোয়াল্লেমের সঙ্গে এজেন্সিগুলোর বিলম্বে চুক্তি,সময়মতো বাড়িভাড়া না করা, ভিসা লজমেন্ট ও মোফা সেন্ড করতে বিলম্ব করা, হজ এজন্সিদের গাফিলতিতে যাত্রীর অভাবে একটার পর একটা করে ৩৩ টি হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়া। আর শেষ মুহুর্তে এসে এখন ফ্লাইটের বিপর্যয় ঘটেছে। বহু হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা ঊধাও হয়ে গেছে এজেন্ট ও মধ্যস্বত্বভোগী। ভিসার কথা বলে অন্তত এক হাজার হজ গমনেচ্ছুর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ভিসার জন্য আবেদনই করেনি। ভিসাপ্রাপ্ত হজযাত্রীদের সৌদি পাঠাতে এজেন্সি মালিকরা শুরু করেছেন টালবাহানা। মধ্যস্বত্বভোগী দালালচক্র প্রায় দুই হাজার হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এজেন্সিদের দেয়নি। ফলে এজেন্সি টিকিট কাটছে না। প্রতারণা করে মধ্যসত্বভোগী ও অনেক এজেন্সি মালিক লাপাত্তা হয়ে গেছে। প্রতারিত হজযাত্রীরা জড়ো হচ্ছেন আশকোনার হজ ক্যাম্পে। সেখানে প্রতারিত হজযাত্রীদের কান্নায় প্রতিদিন ভারী হয়ে ঊঠেছে আকাশ। অভিযোগের পাহাড় জমছে হজ অফিস ও ধর্ম মন্ত্রনালয়ে। কিন্ত দ্রুত কোন প্রতিকার করতে পারছেন না কেউই।

যাত্রী ভোগান্তি এবং অনিশ্চয়তার জন্য ধর্ম মন্ত্রনালয় এবং হজ এজেন্সিগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছে। আর মাঝে পড়ে পিস্ট হচ্ছেন হজযাত্রীরা। আগামী ৩১ আগস্ট হজ। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট শেষ হবে আর দুই দিন পরেই। ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারনে ভিসা পাওয়া প্রায় ৪ হাজার হজযাত্রীর সৌদি আরবে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা গতকালও কাটেনি। যাত্রীসংকটের কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সৌদি এয়ারলাইনসের মোট ৩৩ হজ ফ্লাইট বাতিল বা পেছানোর কারণে শেষ মুহূর্তে এই সংখ্যক যাত্রীর জন্য আসন পাওয়া যাচ্ছে না।

বিমানের শেষ হজ ফ্লাইট ২৬ আগস্ট। সৌদি এয়ারলাইনসের শেষ হজ ফ্লাইট ২৭ আগস্ট। বাকি দিনগুলোতে ভিসা পাওয়া অন্তত: ২৭ হাজার হজযাত্রীকে সৌদি আরবে পাঠাতে হবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১২ টি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে এই দুই সংস্থা। প্রতিটি ফ্লাইটে ৪১৯ জন করে যাত্রী যাচ্ছেন।

বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ জানিয়েছেন, ২৬ আগস্ট দুটি অতিরিক্ত স্লট ( বিমান ওঠা নামার অনুমতি) পাওয়া গেছে। সৌদি আরবের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ২৭ ও ২৮ আগস্টে হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত ১২টি স্লটের আবেদন করা হয়েছে। এই স্লটগুলো পাওয়া গেলে তা পূর্ণ ব্যবহার করা গেলে সব যাত্রীকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বিমান সাধ্যমতো চেষ্টা করছে সব হজযাত্রীকে সৌদি আরবে পৌঁছাতে। বাংলাদেশ থেকে এবার ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের পবিত্র হজ পালন করতে যাওয়ার কথা। ৯৯৩ জনের পাসপোর্ট শেষ দিনেও জমা না পড়ায় তাঁদের ভিসা পাওয়ার আর সুযোগ নেই। হজ কার্যালয়ের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত সৌদি আরবে পৌঁছেছেন ৯৮ হাজার ৪১০ জন হজযাত্রী।

হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। প্রতিবছরই এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে হজযাত্রীদের জন্য নিম্নমানের লাগেজ ক্রয়,ভিসা-টিকেট নিয়ে টালবাহানা, মক্কা-মদিনায় বিলম্বে বাড়ি ভাড়া করা, নির্ধারিত দূরত্ব থেকে দূরে এবং নিম্নমানের বাড়ি ভাড়া করা, ঠিকমতো খাবার না দেওয়া, চুক্তিহীন বাড়িতে গাদাগাদি করে হজযাত্রীদের রাখা, দেরিতে মোয়াল্লেম নেওয়া, হজযাত্রীদের খোঁজখবর না নেওয়াসহ অভিযোগের পাহাড় রয়েছে। কিন্ত প্রতিকার হয়না। হজ মৌসুমে হৈচৈ হয়। হজ মৌসুম চলে গেলে সবাই ভুলে যায়।

হজযাত্রীদের সাথে প্রতারনা এবং টিকেট না করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল সব হজ এজেন্সিকে জরুরি ভিত্তিতে সকাল ১০ টায় বিমান অথবা সাউদিয়ার টিকিট ও যাবতীয় প্রমানপত্রসহ হজ অফিসে তলব করে ধর্মমন্ত্রনালয়। অনেক হজ এজেন্ট সেখানে যায়নি বলে জানাগেছে।

এদিকে শেষ মুহুর্তে রাজধানীর আশকোনার হজ ক্যাম্পে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজযাত্রীরা জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের অনেকে আসছেন বিভিন্ন এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে। অনেকের অভিযোগ হজ এজেন্সিকে টাকা দিয়েও ভিসা ও টিকিট পাননি। কারও অভিযোগ, এজেন্সি যোগাযোগ করছে না। একজন মোয়াল্লেমও এসেছেন এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে। হজ অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, অসংখ্য অভিযোগ। গতকালই প্রায় ৬০০ টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকা নিয়েছে ভিসা হয়নি। ভিসা হয়েছে টিকেট হয়নি। ভিসা টিকেটের কথা বলে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখন তাদের খোজ পাওয়া যাচ্ছেনা। এজেন্সি অফিস বন্ধ। ফোন বন্ধ -এমন অভিযোগ বেশী। নিবিড় হজ-ওমরাহ অ্যান্ড ট্যুরিজম,ইকো এভিয়েশন,ইউরো এশিয়া ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর বলে জানান হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব শাহাদাত হোসেন তাসলিম। তিনি জানান, প্রায় পাঁচ শতাধিক সমস্যার সমাধান করার চেস্টা করছি। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হজ ক্যাম্পে থেকে অভিযোগের প্রতিকার করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।

হজ অফিসে এসে প্রতারিত কয়েকজন হজযাত্রী সাংবাদিকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের অভিযোগ, নিবিড় নামে একটি এজেন্সি সুস্থ হজযাত্রীকে অসুস্থ দেখিয়ে অন্য ব্যক্তিকে রিপ্লেসমেন্ট করে হজে পাঠিয়েছে। এ রকম প্রায় ৪০ জনকে ওই এজেন্সি হজে পাঠিয়েছে । হাজী সংগ্রহকারী আজিজুল হাকিম মতিন জানান, তিনি এবার ৮৭ জন হজযাত্রী সংগ্রহ করেছেন। ঢাকার হজ এজেন্সির নিবিড় হজ ওমরাহ এন্ড টুরিজম এবং ক্লাব ট্রাভেলসের মাধ্যমে তাদের নিবন্ধন করেছেন। এই দুই এজেন্সিকে প্রায় ২ কোটি টাকা পরিশোধও করেছেন তিনি। কিন্তু ধোঁকা দিয়েছে এজেন্সি। মাত্র ৩৩ জন হজযাত্রীকে সৌদি পাঠিয়ে গত সোমবার থেকে উধাও হয়েছে ওই এজেন্সির লোকজন। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে তারা।

শুধু মতিন নয়, তার মতো আরো কয়েকজন মুয়াল্লিমকে একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে দেখা গেছে ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্পে। সংশ্লিষ্ট এজেন্সির লোকজন তাদের টাকা আত্মসাত্ করে কেটে পড়েছে বলে তাদের অভিযোগ। তারা বলছেন, এজেন্সির কয়েকদফা অতিরিক্ত টাকা দাবির চাহিদা মিটিয়ে তাদের হাজীদের পাঠাতে পারছেন।

হজ পরিচালকের অফিসের সামনে রাজশাহীর বানেশ্বরের মো. আতাউর রহমান কান্নাকাটি করেন মঙ্গলবার। তিনি নিজেকে ইকো এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের একজন দলনেতা (গ্রুপ লিডার) দাবি করে বললেন, ২০১৫ সালে ২১ জনকে হজে নেওয়ার জন্য জনপ্রতি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা তিনি ইকো এভিয়েশনকে দিয়েছিলেন। এজেন্সি ওই বছর পাঠাতে পারেনি। গত বছরও ঘুরিয়েছে। এবার জনপ্রতি আরও ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার পর ২১ জনের ভিসা করেছে। কিন্তু এখন টিকিট না দিয়ে জনপ্রতি আরও ৪০ হাজার টাকা দাবি করছে।এ ব্যাপারে হাব মহাসচিব বলেন, আতাউর রহমান একজন মধ্যস্বত্বভোগী। এ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই হজে সমস্যা হচ্ছে। যারা সরাসরি এজেন্সিকে টাকা দিয়েছেন তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তিনি বলেন, হজে যেসব সমস্যা হচ্ছে তার জন্য হজ নীতিমালায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।

ময়মনসিংহের তারাকান্দার নাজিমউদ্দিনসহ আটজনের একটি দল হজ ক্যাম্পে আছেন। তাঁরা সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৪ সালে ইউরো এশিয়া ট্রাভেলসকে জনপ্রতি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ২০১৫ সালে নেয়নি। এবারও দুই দিন আগে এজেন্সির মালিক সৌদি আরবে চলে গেছেন। এখন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।

http://www.ittefaq.com.bd/national/2017/08/24/125055