২৪ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৬:২৪

আ.লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যা

মামলার তারিখ এলেই ‘অসুস্থ’ সাংসদ আমানুর

দুই বছর তিনি পলাতক বা আত্মগোপনে ছিলেন। আদালতে আত্মসমর্পণের পর প্রায় ১০ মাস ধরে কেবলই অসুস্থতার কথা বলে আদালতে হাজিরা থেকে বিরত থাকছেন। ফলে আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ আমানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে দলেরই আরেক নেতা ফারুক আহমেদ খুনের মামলার বিচারকাজ শুরুই হচ্ছে না। গত নভেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত মামলাটির অভিযোগ গঠনের শুনানি আটবার পিছিয়েছে। প্রতিবারই অসুস্থতার কারণে।

এদিকে, আমানুরকে বিচারিক আদালতে হাজির করার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। মামলার তারিখে আমানুরকে আদালতে হাজির করা হয় না জানিয়ে এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ আসে। গতকাল বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
সাংসদ আমানুর বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের এক নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ফারুক হত্যা মামলাটি বিচারাধীন। এই আদালতেই গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেন আমানুর। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এরপর থেকে বুক ও কোমরে ব্যথা, পাইলস, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি কারণে আমানুর রহমান ভ্রমণ-উপযোগী নন বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছেন কারা চিকিৎসকেরা। আর চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বিচারিক আদালতকেএ তথ্য জানিয়ে আসছে।তবেমামলার বাদীপক্ষের অভিযোগ, বিচার বিলম্বিত করতে আমানুর প্রভাব খাটিয়ে অসুস্থতার সনদ সংগ্রহ করে আদালতে হাজির হচ্ছেন না। বাদীপক্ষের আইনজীবী এস আকবর খান বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে ছয় মাসের মধ্যে এ মামলার বিচারকাজ নিষ্পত্তি করার জন্য। কিন্তু ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। আসামি আমানুরকে হাজির না করায় বিচারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনা হবে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়,সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুব্রত কুমার বালা আদালতকে জানান, পাইলসের রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ থাকায় আমানুর ভ্রমণ-উপযোগী নন বলে কারাগারের সহকারী সার্জন জানিয়েছেন। তাই তাঁকে আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগের তারিখ১২ জুন জানানো হয়, জ্বর, বমি, পাতলা পায়খানা, কোমর ব্যথা ও হৃদ্রোগের ব্যথার কারণে আমানুর ভ্রমণ-উপযোগী নন।

গত বছরের ৯ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির প্রথম তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু এর আগের দিন কাশিমপুর কারাগার থেকে তাঁকে বুকে ব্যথাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। তাই তাঁকে ওই তারিখে আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। উচ্চ রক্তচাপ, বুক ও কোমরের ব্যথার কারণে আমানুর গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি প্রায় তিন মাস ঢাকা মেডিকেলের কেবিনে ছিলেন। ৯ মে প্রথম আলোতে ‘হাসপাতালে বসেই রাজনীতি করছেন সাংসদ আমানুর!’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁকে আবার কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় অভিযোগ গঠনের শুনানি তিনবার পেছায়।

গত এপ্রিলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আমানুরকে অস্থায়ী জামিন দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমআপিল আবেদন করেন। ৮ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ চার মাসের জন্য আমানুরের জামিন স্থগিত করেন। পাশাপাশি ছয় মাসের মধ্যে ফারুক হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে নিম্ন¤আদালতকে নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম খান বলেন, অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আটবার তারিখ পড়েছিল। কিন্তু আমানুরকে হাজির না করায় অভিযোগ গঠনের শুনানি করা যায়নি। তাই বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। এই অবস্থায় কী করা যায়, সে ব্যাপারে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
মামলার বাদী ও নিহত ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ অভিযোগ করেন, আমানুর প্রভাব খাটিয়ে কখনো হাসপাতাল, কখনো কারাগারের চিকিৎসাকেন্দ্রে থেকে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল বাকী মিয়া বলেন, আসামি এখন সরকারের হেফাজতে। অসুস্থ থাকলে তাঁকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব সরকারের।

২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ মরদেহ টাঙ্গাইলেতাঁর কলেজপাড়া এলাকায় বাসার সামনে পাওয়া যায়। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। প্রথমে থানা-পুলিশ ও পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলার তদন্ত করে। ২০১৪ সালের আগস্টে এ মামলার আসামি আনিসুল ইসলাম ওরফে রাজা ও মোহাম্মদ আলী গ্রেপ্তার হন। আদালতে তাঁদের স্বীকারোক্তিতে সাংসদ আমানুর রহমান খান ও তাঁর তিন ভাইয়ের এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি বের হয়ে আসে। এরপর আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে চলে যান। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আমানুর ও তাঁর তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সানিয়াত খানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1300346