২৪ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৬:১৯

পাউবোর ৬ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে জলবায়ু অর্থায়ন তহবিল থেকে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর পুরো প্রক্রিয়ায় চরম অস্বচ্ছতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। অন্যদিকে অন্তত ৬টি প্রকল্পে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে দাবি করেছে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি জানায়, পাউবো জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তার কোনো নিরীক্ষা হয় না। তাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও আইনের আওতায় আসে না।

গতকাল টিআইবির কার্যালয়ে ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্লাইমেট ফাইন্যাস গভর্নেন্স (সিএফজি) ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মহিউদ্দিন। গবেষণায় আরো সংযুক্ত ছিলেন একই ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ এবং অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজু আহমেদ মাসুম। উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা এবং ক্লাইমেট ফাইন্যাস গভর্নেন্স (সিএফজি) ইউনিটের সিনিয়র প্রোগ্রাম মানেজার এম জাকির হোসেন খান।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অসময়ের বন্যা কিংবা বারবার বন্যার কারণে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি যখন আলোচিত তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করে কী করছে তা দেখাই ছিল টিআইবির গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। এতে টিআইবি পাউবোর ৬টি প্রকল্প যাচাই করে। তবে গবেষণার ফলাফলে টিআইবি সংখ্যার হিসাবে চূড়ান্ত কোনো তথ্য না দিয়ে বরং ছোট-বড় নানা রকম দুর্নীতি হচ্ছে- সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

প্রবন্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ঠিকাদারের নিজস্ব ইটভাটার বিজনেস আছে। খাল যে কেটেছেন সে মাটিটা বাঁধের পাড় শক্ত করার জন্য দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি নিজের ইটভাটায় নিয়ে চলে গেছেন। ১টি প্রকল্পে রাস্তার নির্মাণকাজের সময় ঠিকাদার ১০ থেকে ১৫টি গাছ, সেই যে রাস্তায় আছে, সেগুলো কেটে গাছপ্রতি গড়ে ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ঠিকাদার অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কেউ ভয়ে কিছু বলেনি।
গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ু প্রকল্প যে এলাকার জন্য বেশি প্রয়োজন সেখানে তা বাস্তবায়ন না হয়ে হচ্ছে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় এলাকায়। এমনটি পর্যবেক্ষণ করে টিআইবির গবেষণা দল খুঁজে পায়, ৬টি প্রকল্পের ২টিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ১টিতে সাবেক মন্ত্রীর আত্মীয়, ১টি ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং ১টি প্রকল্প পেতে জনৈক সচিবের প্রভাব মূল ভূমিকা পালন করেছে।

গবেষণায় বলা হয়, সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে ই-টেন্ডারিং পদ্ধতিকে আদর্শ ব্যবস্থা মনে করা হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি কেবল টেন্ডার জমাদান পর্যন্ত সীমিত। টেন্ডার মূল্যায়ন ও নির্বাচনে আগের পদ্ধতি বহাল থাকায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।
এতে আরো বলা হয়, জলবায়ু অর্থায়নের টেন্ডার বাস্তবায়নে ৭ স্তরের জাবাবদিহি থাকার কথা। কিন্তু এতেও ঘাটতি রয়েছে। টিআইবি পাউবোর ৬টি প্রকল্প তাদের গবেষণার আওতায় নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ), মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) এসব প্রকল্প শেষ হওয়ার পর মূল্যায়ন, নিরীক্ষা ও পরিবীক্ষণ করেনি। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪টি প্রকল্প পরিবীক্ষণের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সেসব বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকায় কাজ সম্পর্কে বোর্ডে তথ্য প্রকাশ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাও হয় না।

দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত প্রকল্পগুলো হলো- অবকাঠামো নির্মাণ ও নদীতীর সংরক্ষণ ও পুনঃখনন (সময়কাল ২০১৩-১৪), বরাদ্দ ১২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা; নদী তীর সংরক্ষণ (সময়কাল ২০১৩-১৫), বরাদ্দ ২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা; ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা সংক্রান্ত প্রকল্প: পোন্ডার মেরামত (সময়কাল ২০১১-১৫), বরাদ্দ ১১ কোটি ৪৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা; নদীতীর সংরক্ষণ ও বাঁধ পুনঃনির্মাণ (সময়কাল ২০১২-১৬), বরাদ্দ ১৮ কোটি ৮৮ লাখ ৩ হাজার টাকা; ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ: পোন্ডার নির্মাণ (সময়কাল ২০১৩-১৪), বরাদ্দ ৯৯৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রক বাঁধ নির্মাণ (সময়কাল ২০১২-১৬), বরাদ্দ ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি প্রকল্প দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরিশাল। প্রতিবেদনে এসব উন্নয়নকাজের দরপত্র প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা ঘুষ লেনদেন করে তারা কী আপনাকে বলবে যে, আমরা ঘুষ লেনদেন করেছি। সেটা তো হয় না, সম্ভব না। এখানে প্রভাবটা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভালনারেবিলিটি ম্যাপ যেটি, সেই ম্যাপের সঙ্গে। কিন্তু প্রকল্পের লোকেশনগুলো কনসিসটেন্ট না। মিলছে না। এটা হচ্ছে যেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আছে সেখানে প্রকল্পের লোকেশন। এই জিনিসটা কিন্তু খুব পরিষ্কার। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে পাউবোর ব্যর্থতা উদ্বেগজনক। পাউবোর বাঁধ নির্মাণে দুর্বলতা আছে। টেন্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বার্থের বিষয়ে প্রাধান্য পায়।
এমন প্রেক্ষাপটে পাউবো যে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার সুফল আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ পাবে কি না এবং এসব দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছ থেকে জলবায়ু তহবিলের অর্থ ঠিকমতো পাবে কি না- এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে টিআইবি।
অনুষ্ঠানে পাউবো কর্তৃক বাস্তবায়িত জলবায়ু প্রকল্পে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ১৪ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেছে টিআইবি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80255