২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩১

জনশক্তি রফতানিতে প্রতারণা চলছেই

মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর নির্দেশনার কথা বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় জনশক্তি রফতানিতে প্রতারণা কমছে না। বৈধ পন্থায় যেতে না পারায় অবৈধ পন্থায় বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতারকদের দৌড়াত্ম্য আরও বেড়েছে। বিশেষ করে দেশে চাকরি না থাকায় বিদেশে যেতে চায় দেশের মানুষ। এ সুযোগ নেয় প্রতারকরা। এসব প্রতারকের পাল্লায় পড়ে হাজার হাজার মানুষ নিঃশ্ব হয়। বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে। এসব ভোগান্তির পর অনেকে দেশে ফিরে আসেন। তারা নানা দেনদরবার এবং আইন আদালতের আশ্রয় নিয়েও সুবিচার পায় না। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণা অভিযোগে ইতিমধ্যে অনেকগুলোর রিক্রুর্টিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এরপরও প্রতারণা থামছে না। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, মালদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমিক পাঠানোর নাম করে দালালেরা গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অগ্রিম টাকা আদায় করছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তাদের অনেককেই বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। এ অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে। তাদের নিয়োগ করা দালালেরা বিদেশ গমনেচ্ছু এসব মানুষের টাকা নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে হতদরিদ্ররা হচ্ছেন সর্বস্বহারা।
চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষাধিক কর্মী পাড়ি জমিয়েছেন এ সময়। এর মধ্যে বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবেই অর্ধ লক্ষ কর্মী গেছেন। এর পরই রয়েছে ওমান, কাতার ও বাহরাইনের নাম। বিদেশে কর্মী নিয়োগের এ সুযোগেই চলছে প্রতারণা।
অভিযোগ রয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিদেশগামী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই এখন জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সদস্য বিভিন্ন রিক্রুটিং অফিসে টাকা ও পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরছেন। কিন্তু বিদেশ যেতে পারছেন না। কেউ কেউ আবার দালালরূপী প্রতারকের খপ্পরে পড়ে জমা দেয়া টাকাই খুইয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, চুক্তি মোতাবেক কেউ কেউ বিদেশ যাওয়ার পরও সঠিক কাজ পাচ্ছেন না। লোভনীয় বেতনের অফার দিলেও সেখানে গিয়ে তার কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছে না।
বিদেশে প্রতারিত হয়ে প্রতি বছর কত কর্মী দেশে ফেরত আসছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এ সংখ্যা কয়েক হাজার হবে বলে মনে করেন রফতানি সংশ্লিষ্টরা। আর এ ধরনের প্রতারণার কারণে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেশের সুনাম।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত এক হাজার ৭১টি রিক্রুটিং এজেন্সি। এর মধ্যে মানবপাচার, কর্মী পাঠাতে অনিয়ম, হয়রানি ও জালিয়াতির অভিযোগে ৮৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার বিষয় নিয়ে বিদেশীদেরও অভিযোগের শেষ নেই। তারাও চায় বাংলাদেশ থেকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি যাক।
গত মাসে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এক বৈঠকে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক রামলান ইবরাহিম নিজ নিজ দেশের পক্ষে সচিব পর্যায়ের ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশী পাঠানোর স্বচ্ছ ও পরিষ্কার প্রক্রিয়া চায় কুয়ালামপুর।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারিভাবে লোক পাঠানোর পাশা পাশি বেসরকারিভাবে লোক পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশ একমত হলেও এর প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ আছে। মালয়েশিয়া সরকার স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করলে বাংলাদেশ এতে সম্মত হয়।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার কার্যনির্বাহী কমিটির এক নেতা বলেন, বিদেশগামীদের সাথে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে না, এমনটি বলব না। তবে আগে যেভাবে দালালেরা টাকা হজম করে দিত এখন সেই রকম আর নেই। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন প্রতারকদের ধরার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত টাস্কফোর্স, র্যাব, পুলিশ ডিবি ও সিআইডি বেশ তৎপর। এ ছাড়া প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেনÑ কোনোভাবেই যেন বিদেশগামীরা প্রতারণার শিকার না হন।
তবে বায়রার অপর এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি করলেও একশ্রেণীর আদম ব্যাপারী এখনো অবৈধ পথে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে আদম পাচার অব্যাহত রেখেছে। এই চক্রের অপতৎপরতা বন্ধ না হলে বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি যেমন প্রসারিত হবে না, তেমনি বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার গতিও বাড়বে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/297068-