২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৯

বন্যার আগাম তথ্য থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়নি

জনপ্রতি ১ কেজি চাল, ২০ টাকায় ত্রাণকার্যক্রম শেষ

বন্যার আগাম তথ্য থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়নি। বন্যা হতে পারেÑ এমন তথ্য আবহাওয়া অধিদফতর অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সময় মতোই সরবরাহ করা হয়েছে।
আব হাওয়া অধিদফতর চলতি মাসের শুরু থেকে মওসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে বন্যার আশঙ্কা করে পূর্বাভাস দিয়েছিল। আবহাওয়া অধিদফতর সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করেছে বন্যা সম্পর্কে। এ মাসের মাঝামাঝিতে বন্যা হতে পারে পানিসম্পদমন্ত্রী এমন তথ্য সাংবাদিকদেরও জানিয়েছিলেন। তারপরেও মাঠপর্যায়ে বন্যা মোকাবেলায় এবং ত্রাণ বিতরণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি, ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়নি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বন্যা হয়ে থাকে প্রধানত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি থেকে। অন্য দিকে সুরমা-কুশিয়ারার মাধ্যমে সিলেট বিভাগে বন্যার সৃষ্টি করে। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, কোন নদীতে কতটুকু পানি হয় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তা সংশ্লিষ্ট দফতরকে নিয়মিত অবহিত করা হয়ে থাকে ই-মেইলের মাধ্যমে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা নদীতে কী পরিমাণ পানি এসেছে অথবা কতটুকু এলাকা প্লাবিত হয়েছে এমন তথ্য নিয়মিতই দিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসনকে। তিনি বলেন, ভারতের কোন নদীতে কতটুকু পানি হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট দেশের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি। এ ছাড়া ভারত ও চীন প্রতিদিন পানির তথ্য বাংলাদেশকে দেয় ই-মেইলের মাধ্যমে।
পানি বৃদ্ধির তথ্য নিয়মিত মন্ত্রণালয় অথবা মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণে লক্ষ করা গেছে অব্যবস্থাপনা। পানির তথ্য আগে থেকে পেলেও চলতি বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়নি। আগাম তথ্য পেয়েও কেনো ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, পানি বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খান জানান, ভাটির দেশ বাংলাদেশের পক্ষে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ক্ষয়ক্ষতি কিছু হয়তো কমিয়ে আনা যাবে আগে চেষ্টা করলে; কিন্তু স¤পূর্ণ সম্ভব নয়। ‘বন্যাকে নিয়ে এবং বন্যা হবে’ এ কথা চিন্তা করেই আমাদের চলতে হবে। এবার বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা বেসিনে একই সাথে পানি বেড়েছে এবং প্রায় একই সাথে এ পানি এসেছে, ফলে বন্যা হয়ে গেছে। আগাম তথ্য থাকলেও এখানে করার কিছু ছিল না দ্রুত পানি বেড়েছে বলে। এ ছাড়া আমাদের নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বেশি পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে নদীর দুই কূল উপচে বন্যা হয়ে যায়। তিনি বলেন, নদীগুলো পরিকল্পিত উপায়ে খনন করা হলে নদীর গভীরতা বাড়বে। তখন হয়তো পানি উপচে পড়বে না, বন্যার ব্যাপকতা কমে যাবে। ড. এস আই খান বলেন, এবার দেখা গেছে, বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে। বাঁধগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, জনগণকে বাঁধ ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাঁধের মধ্যে তাদের বাস করতে দিতে হবে, রাস্তা বানাতে হবে। বাঁধে কোনো ফাটল দেখা দিলে জনগণই ফাটল সারিয়ে নেবেন অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবেন।
ক্ষয়ক্ষতি কেন কমিয়ে আনা গেল নাÑ প্রশ্নের জবাবে রংপুর জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদ্জ্জুামান এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, বন্যা হবে এটা তারা জানতেন। তা মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতিও জেলা প্রশাসনের ছিল। এ ছাড়া বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) কাছ থেকে চাহিদার তালিকা নিয়ে ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, প্রয়োজন অনুসারে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে, আরো বিতরণ করা হবে। আমরা দক্ষতার সাথে বন্যা মোকাবেলা করছি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে রংপুর জেলায় ৩৮ হাজার ৩১ পরিবারের প্রায় তিন লাখ ১২ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। তিন লাখ মানুষের জন্য এ পর্যন্ত ২৬৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। টাকা বিতরণ করা হয়েছে তিন লাখ। আরো ৪০০ মেট্রিক টন চাল পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসন থেকে আবেদন করা হয়েছে সরকারের কাছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে রংপুরে বন্যাকবলিতদের জন্য জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি পরিবারের জন্য মাত্র ৫৫৮ গ্রাম চাল ভাগে পড়েছে এবং প্রতি পরিবার পেয়েছে ৯.৬১ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বানভাসি মানুষের জন্য এ ত্রাণ খুবই অপ্রতুল এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার সাতটি উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়েছে। এ জেলাটি ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘট নদীর পানিতে বন্যাকবলিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জেলার প্রায় চার লাখ মানুষ। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন যে, তারা বন্যার তিন দিন আগে পানি আসবে এমন তথ্য পেয়েছেন। এখানে ২০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে। বাঁধগুলোর মধ্যে ছোট তিনটি বাঁধ ভেঙে গেছে। তবে বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, আমরা মেরামত করেছি। তিনি জানান, গাইবান্ধা জেলায় প্রায় এক হাজার ৪০০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে ও টাকা বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ।
তবে গাইবান্ধার স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বানভাসি ছিন্নমূল মানুষ খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আরো ত্রাণ প্রয়োজন। আগাম বন্যা হবে এমন তথ্য থাকলেও বন্যা মোকাবেলায় অথবা মানুষের দুর্দশা লাগবের জন্য প্রস্তুতি মোটেও যথেষ্ট ছিল না। এ এলাকার একজন বাসিন্দা হামিদুল ইসলাম মনে করেন, বন্যা হবে এটা এ এলাকার সব মানুষই জানেন। কারণ প্রতি বছরই এই সময়টায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘটের মতো নদী উপচে বন্যা হয়ে থাকে। এলাকার সব মানুষই সরকারি ত্রাণ নিতে আসেন না। সরকার অন্তত ছিন্নমূল অথবা অতিদরিদ্র মানুষের চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু জনপ্রতি আধা কেজি অথবা এক কেজি চাল আর ১০-২০ টাকা বিতরণ করাকে কি ত্রাণ বলে? এটা নিরন্ন-দরিদ্র মানুষের প্রতি উপহাস ছাড়া কিছুই নয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/246119