২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৬

উত্তর, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও মধ্য-দক্ষিণাঞ্চলে কমছে পানি

বানভাসির দুর্দশা অব্যাহত

নীলফামারীতে ত্রাণের চাল বিক্রির অভিযোগ * সিংড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাচারিবাড়িতে পানি * চলতি বন্যায় সোমবার পর্যন্ত মারা গেছেন ১১৫ জন * ঢাকার আশপাশের নদীতে পানি বাড়ছে

বন্যার্ত এলাকা থেকে নামছে পানি। উত্তরাঞ্চল থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ১৭ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্য-দক্ষিণাঞ্চল থেকে অবশ্য পানি কমার গতি এর চেয়ে একটু কম। তারপরও গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে পানি কমতে থাকলেও বন্যাদুর্গতদের দুর্দশা অব্যাহত আছে। তাদের মাঝে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন ও গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। এখনও অনেকেই খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সোমবার অতি জোয়ারে ডুবে গেছে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ইলিশা ফেরিঘাট। এতে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। নাটোরের সিংড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি উঠেছে। এতে উপজেলায় বিদ্যুৎ বিছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি চত্বরে পানি উঠেছে। এদিকে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়েছে ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ট্রেন যোগাযোগ। সোমবার বন্যার পানিতে ডুবে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বন্যায় ১১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদিকে এখনও ১৭টি নদীর ২৯টি স্থানে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে আছে। ঢাকার আশপাশের নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। তবে উজান থেকে আসা বেশিরভাগ পানিই নেমে যাচ্ছে।
এফএফডব্লিউসির এক বুলেটিনে বলা হয়, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি অব্যাহত থাকবে। পদ্মা নদীর পানি সমতল কমতে শুরু করায় মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুঞ্জীগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের নিন্মাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হবে।
যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী : জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বন্যায় সরকারের দেয়া ত্রাণের চাল বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ওই ইউনিয়নের ৫০ পরিবার এ অভিযোগ করে। এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যানের কামরুল আলম কবীর বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৪শ’। তাই বরাদ্দ পাওয়া ৫০ পরিবারের জন্য ৫০০ কেজি সরকারি ত্রাণের চাল ১৯ হাজার টাকা বিক্রি করে সব পরিবারকে ভাগ করে বিতরণ করা হয়েছে। এ বিষয়টি তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান জলঢাকা উপজেলার পিআইও মোয়াজ্জেম হোসেন।
সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর : শাহজাদপুর উপজেলার কোর্ট ভবনের ভেতরে এখনও হাঁটুপানি। ২ দিন আদালত বসতে পারেননি। ফলে বিচারপ্রার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তাদের এ দুর্ভোগ লাঘবে সোমবার সিনিয়র চিফ জুডিশিয়াল আদালতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়েছে নবনির্মিত সাব-জজ আদালত ভবনে। এদিকে উপজেলার দ্বারিয়াপুরে অবস্থিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি তদারকির কাচারিবাড়ি চত্বরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
গোয়ালন্দে উঁচু সড়কে মানবেতর দিন কাটছে কয়েকশ’ পরিবারের : রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ছোটভাকলা ইউনিয়নের অন্তার মোড় এলাকায় উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছে চার শতাধিক পরিবার। তারা অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও তাদের দুর্দশা এতটুকু কমেনি। সোমবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে পলিথিন ও পাটকাঠির ছোট ছোট ছাপরা তুলে গরু-ছাগলের সঙ্গে একত্রে এসব পরিবারের লোকজন মানবেতরভাবে মাথা গুঁজে রয়েছেন। দেবগ্রাম ইউনিয়নের জাবেদ আলী, সাহেদা বেগম, ইসলাম শেখ, সবুজসহ অনেকেই জানান, বন্যার পানি বসতঘরে উঠে যাওয়ায় তারা এক সপ্তারের বেশি সময় ধরে রাস্তায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এ পর্যন্ত কেউ তাদের খবর নেয়নি। এক ছটাক রিলিফও তাদের ভাগ্যে জোটেনি। দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতর আলী সরদার জানান, বন্যায় রাজবাড়ী জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ইউনিয়নে। এ পর্যন্ত তিনি ২০ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। তা ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
রংপুর : সোমবার পর্যন্ত সরকারিভাবে যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তাতে ক্ষতিগ্রস্তরা মাথাপিছু সাহায্য পেয়েছেন মাত্র ৮৫৮ গ্রাম চাল ও সাড়ে ৯ টাকা। যা দিয়ে দেড় দিনের খাবারও জোটে না। গঙ্গাচড়ার নোহালী ইউনিয়নে বন্যাদুর্গতদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। তারা জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম : বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষজন বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরে মেরামতের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আবারও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র জানায়, বন্যায় জেলার ৯ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৮২০ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিবন্দি ছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ।
সিংড়া ও গুরুদাসপুর (নাটোর) : সোমবার সিংড়া পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি ডুকে পড়ায় উপজেলার ২৫ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের আশঙ্কায় রয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলার বলিয়াবাড়ী ও কালিনগর গ্রামে দুটি বাঁধ ভেঙে ৭টি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার ও ফসলি জমি নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, সিংড়াকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের হাত থেকে রক্ষা করতে উপজেলা পরিষদ কাজ করছে। এদিকে গুরুদাসপুরে বন্যার পানিতে ডুবে আইমন নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
পাবনা : যমুনার পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকায় পাবনার বেড়া, ফরিদপুর, চাটমোহর ও ভাঙ্গুরায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে জেলার সুজানগর ও সদরের ২টি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে।
ভোলা : সোমবার অতি জোয়ারে ডুবে গেছে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ইলিশা ফেরিঘাট। ফেরির অ্যাপ্রোচ ডুবে যাওয়ায় দুপুরের পর থেকে লোড-আনলোড বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ থাকে ফেরি চলাচল। রামদাসপুর ও শাহবাজপুর চ্যানেলে দুই মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
জামালপুর ও মাদারগঞ্জ : মাদারগঞ্জে বন্যার পানি কমছে। এ উপজেলায় বন্যার্তরা ত্রাণের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় নেতাদের কাছে ছুটছেন। সোমবার মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জেলায় বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ দেয়া হয়েছে।
জয়পুরহাট : সোমবার ক্ষেতলাল উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৪ হাজার কৃষকের মাঝে বিনা মূল্যে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের বীজ বিতরণ করেছে আওয়ামী লীগ। পাঁচবিবি উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে আটা। বন্যায় জেলার ৩ হাজার একর আখক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
ফরিদপুর : মধুমতি নদীর ভাঙনে দিশেহারা মানুষ। নদীর বুকে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, রাস্তাঘাট। নদীর ভাঙনে ভিটাবাড়ি হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে আগের ভিটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। ইতিমধ্যে মধুমতি নদীতে বিলীন হতে শুরু করেছে চাপুলিয়ার গুচ্ছগ্রাম। চরভদ্রাসনে বানভাসি ৪০০ পরিবারের মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণের চাল বিতরণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি গত কয়েকদিন ধরে কমতে থাকলেও মানুষের দুর্ভোগের অবসান হয়নি।
অন্যান্য জেলার বন্যা পরিস্থিতি : শেরপুর সদর, নকলা ও শ্রীবরদী উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৭৪টি গ্রামের নিন্মাঞ্চল থেকে পানি কমছে। নওগাঁর মান্দায় গবাদি পশুর জন্য খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ ও ডাল-ভাত বিতরণ করা হয়েছে। শরীয়তপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দিনাজপুরে ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বানভাসি মানুষ।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/22/150012/