২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৩

‘সবার ঘর ভাঙিছে কই উঠুম’

ধরলার তীরে জগমনের চর। একস্থানেই ৫২ পরিবারের বসতঘর। এর ৩৫ বাড়িই স্রোতের তোড়ে নিশ্চিহ্ন। ভেঙেচুরে, হেলেদুলে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে বাকিগুলো। তাদেরও সব গেছে। চাল-চুলা, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন। বন্যা তাদের সবই কেড়ে নিয়েছে। একেবারে নিঃস্ব করে গেছে। তবুও নাড়ির টানে ছেদ পড়েনি। পানি কমতেই আপন ঠিকানায় ফিরছে বানভাসি পরিবারগুলো। আসমা, ফুলু, বুলু, ছৈবর, জলিল, আব্বাস, সামিনারা। কিন্তু নিঃস্ব হাতে। এক কাপড়ে। আড়াই দিন উপসের পর বুলু খাতুন দু’মুঠো ভাত জোগাড় করলেও খাওয়ার জন্য কিছুই খুঁজে পাননি। সাঁতরিয়েই শূন্য ভিটেয় যান স্বামী-সন্তানের কাছে। কলা গাছের খোল কুড়িয়ে তাতেই সন্তানদের খাওয়াতে বসেন। এভাবে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে খেয়ে-না খেয়ে পড়ে আছেন কেন জানতে চাইতেই সমস্বরে সবাই বলে উঠলেন, ‘সবার ঘর ভাঙ্গিছে, কার বাড়িত উঠি। তাই বাড়ি-ঘর যখন পানির নিচে ছিল তখন বেড়ি বাঁধে আশ্রয় নিছিলাম। পানি কমতেই বাড়িতে ভিটেয় উঠি।’

এমন নিঃস্ব পরিস্থিতি শুধু বুলুর নয়। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ওই জগমনের চরের সব বাসিন্দার। বন্যা তাদের সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। বিপর্যস্ত করে দিয়েছে সবার জীবন। অবশিষ্ট নেই শেষ সম্বলও। অধিকাংশই খুঁজে পায়নি তাদের বাড়ি। জগমনের চরের মতো যেসব এলাকা দিয়ে বন্যার করাল স্রোত বয়ে গেছে সেসব এলাকায় বিলীন হয়েছে পুরো গ্রাম। কোথাও অর্ধগ্রাম। তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে অন্তত ৩০ জেলার বিপুল জনগোষ্ঠী।
জগমনের চরের জেলে আবদুল জলিল ও আমজাদ হোসেনসহ ৩ জনকে দেখা গেলো সংলগ্ন ধরলার শাখা নদীতে হাঁটতে, আর মাঝে মাঝে ডুব দিতে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন, হামার বাড়ি বানে ভাসি নিয়া গেইছে। এলাও খুঁজি পাই নাই। সেই জন্যে নদীর তলাত বাড়ি খুঁজবার নাগছি। বানের পর পাটেশ্বরী মাদরাসাত থাকি। এলা ভিটাত আছছি। রাতে চিঁড়া-মুড়ি খাওয়ার পর সকাল থেকেই উপস বলে জানালেন ওই দু’জন। বন্যার পর থেকে কোনোমতে দুপুরে এক বেলা খেয়েই দিন পার করছি। সেই চিঁড়া-মুড়ি স্বউদ্যোগী ছাত্রদের দেয়া হয় বলেও জানালেন তারা। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ আসছে না বলে অভিযোগ তাদের সবার। তাই তাদের অনাহার-অর্ধাহার ঘুচছে না বলেও জানালেন বানভাসি মানুষ।
জেলে আব্বাস আলীও খুঁজে পায়নি তার ভাসিয়ে নেয়া বাড়িটি। তার উপার্জনের সম্বল জালটিও। তার স্ত্রী সামিনা বললেন, ৭ দিন ধরি নদীত বাড়ি খোঁজবার যেয়া আইজ একটি হাঁড়ি পাইছি।
শুধু ওরা নয়। গত ১২ই আগস্ট শনিবার ও ১৩ই আগস্ট রোববার উজানের বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়েছে একই এলাকার ফরিদ উদ্দিন, মোকছেদ আলী, এরশাদ, আনোয়ার হোসেন, মেহের আলী, নবীর হোসেন, আকলিমসহ অর্ধশতাধিক পরিবারের সহায়-সম্বল। এখন তারা পুরোপুরি নিঃস্ব। শুধু জগমনের চরই নয়। এমন শূন্যহাতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলা, উলিপুর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রাজারহাট, রৌমারী, রাজীবপুরবাসী। কুড়িগ্রাম জেলা সদরের অল্পকিছু উঁচু এলাকায় পানি না উঠলেও ডুবে গেছে পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চলও। কুডিগ্রামের মতোই বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়েছে নীলফামারী, লালমনির হাটসহ অন্তত ৩০ জেলার জনবসতি।
জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে অবস্থিত ফারাক্কায় প্রায় স্লুইস গেট খুলে দেয়ার ১২ই আগস্ট থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রথমে উজানের পানি বাড়তে থাকে। ১৩ই আগস্ট ব্যাপকহারে বাড়ে পানি। ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জেলাগুলোতে। তাতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ৫ থেকে ৭ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। নদীর অববাহিকায় পানি এত দ্রুততার সঙ্গে বাড়ে যে, বাড়ির জিনিসপত্র রক্ষা করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় গত ১২ আগস্ট থেকে মানুষ বসতবাড়ি ছেড়ে বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে গত দু’-একদিন ধরে পানি কমতে শুরু করেছে। মানুষ আশ্রয়স্থল ছেড়ে নিজের বাড়িতে যেতে শুরু করেছে। খুঁজছে তাদের হারানো সংসার। কেউ ছিটে-ফোঁটা পেলেও অনেকেই ফিরে পায়নি হারানো সম্পদ। তাছাড়া অধিকাংশ ঘরবাড়ি ভাসিয়ে না নিলেও তাদের আসবাপত্র, তোষক, জিনিসপত্র, খাবার-দাবার, দোকানের মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। এমন বন্যা পরিস্থিতি স্মরণকালের মধ্যে আর দেখেননি বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রামের বানভাসি মানুষ। এ বন্যাকে ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়েও ভয়াবহ বলে তুলনা করলেন বয়স্করা। এ বন্যা বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। তবে ১৯৮৮ সালের বন্যার মতো এবার পানি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বলে জানা গেছে।
সরজমিন দেখা গেছে, ধরলার দু’তীরে প্রবল স্রোতের তোড়ে গাছপালা, আগাছা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। পাট ও ধইঞ্চা বন নুয়ে পড়েছে। উপড়ে ভাসিয়ে নিয়েছে অনেক গাছ-পালা। উপড়ে ফেলেছে বাঁশঝাড়। ভেঙে খালে পড়েছে ঘর-বাড়ি। ভেঙে গেছে সীমানা বেড়া বা প্রাচীর। হেলে পড়েছে কিছু কিছু। এমনকি বন্যার পলি ভেঙেপড়া বহু ঘরের কবরও রচনা করেছে। পলিতে ঢেকে গেছে ঘরের চালা। ভেঙে পড়েছে স্কুল ও মাদ্রাসা। স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়ক। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ। গাছপালা ও ঘরের চালার নিচে ৪ থেকে ৫ ফুট উঁচুতে পলি জমে জানান দিচ্ছে কত পানির নিচে তলিয়েছিল এই লোকালয়। নদীর এখানে সেখানে ভাসছে গবাধি পশু-পাখির মরদেহ। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে থাকা-খাওয়ার চরম দুর্ভোগে রয়েছে মানুষ। যথেষ্ট ত্রাণ না পৌঁছানোয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে মানুষের।
বন্যায় বিভিন্ন এলাকায় মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, জগমনের চরসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারিভাবে আমরাও ত্রাণ পাঠাচ্ছি। একাধিকবারও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এখানে হয়তো বুঝার ভুল হচ্ছে।
তা যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ত্রাণ পাঠানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। তবে বন্যার্তদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রশিতে বাঁধার আগেই ভাসিয়ে নেয় কালামের ঘর: এক বছর আগে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে সর্দারপাড়া এলাকায় বাড়ি বানিয়েছিলেন রিকশাচালক আবুল কালাম ও মোছাম্মৎ রহিমা খাতুন দম্পতি। মনেরমতো করে আসবাবপত্রে সাজিয়েছিলেন সংসার। ১২ই আগস্ট বন্যা আসার পূর্বাভাস পেয়ে কাছের দোকানে ছুটেন রশি কিনতে। রশি কিনে রওয়ানাও দেন। বাড়ির দিকেই রওয়ানা দিতেই পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে শুনতে পান তার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আশাপাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রক্ষার চেষ্টাটাও হলো না তাদের। এক সপ্তাহ ধরে খোঁজাখুঁজির পর সেই ঘরের সন্ধান পেয়েছেন তিন কিলোমিটার দূরে ধরলা নদীর তীরে পাঙ্গারচরের ধইঞ্চা বনে। সেখানে আসবাবপত্রসহ আটকে আছে তাদের টিনের বাড়িটি। তবে সব জিনিসপত্র পাননি। একটি নৌকাভাড়া করে সেই বাড়িটির বিভিন্ন অংশ তুলছিলেন স্বজনরা।
কালামের স্ত্রী রহিমা খাতুন বলেন, বন্যার খবর শুনে কাছে দোকান থেকে রশি কিনে আসার আগেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়িটি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। খাড়া হয়ে আসছিলো প্রবল স্রোত। কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
রশিতে বেঁধে রক্ষা স্কুলঘর ও নলকূপ: ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ফ্রেন্ডশিপ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঘরটি। তবে রশি দিয়ে বেঁধে একেবারে ভাসিয়ে নেয়া থেকে রেহাই পেয়েছে স্কুলঘরটি। সেই স্কুলের নলকূপটিও রক্ষা করা হয়েছে রশি দিয়ে বেঁধে। কিন্তু স্কুলের আসবাবপত্রসহ নামফলক রক্ষা পায়নি।
বেড়িবাঁধে একসঙ্গে পশু ও মানুষের আশ্রয়: কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী মহাসড়কে বন্যার পর শ’ শ’ মানুষ ও গবাদিপশু একসঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। বসতভিটা থেকে পানি নামার পর অনেকে ফিরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করলেও অনেকে তাও পারেননি। পানি না নামায় গবাদি পশুর সঙ্গে একচালার নিচে এক সঙ্গে অবস্থান করছেন। গতকাল আলেয়া, তার স্বামী জরিপ উদ্দিন, তার ছেলে- ছেলের বউ, নবজাতক নাতি-নাতনিসহ একসঙ্গে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তাদের পাশেই রাখা হয়েছে রক্ষা পাওয়া শেষ সম্বল ৩টি গরু। সেইসঙ্গে কয়েকটি মুরগির ছানা।
আলেয়া ও তার পুত্রবধূ চম্পা বলেন, যাদের বাড়ির পানি নামি গেছে তারা চলি গেছে। আমার বাড়ির পানি এখনও নামি না যাওয়ায় আমরা রাস্তায় আছি। কয়েকটি টিন জোগাড় কড়ি ছাপড়া করি আছি। তাতে গরুও রাখছি। আর কী উপায় বলুন?

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=79933