২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৪০

পেট ভরে খাবা পারু নাই...

‘কয়েকদিন পেট ভরে কিছু খাবা পারু (পারি) নাই। খাবার নাই, খাবাও মেনায় না। ছুয়ালা (ছেলে) সারাদিন কান্দেছে (কাঁদছে)। হামাক এগনা সাহায্য কর না গে। পানি কমুছে কিন্তু বাড়িডাই তো নাই, কুণ্ঠে থাকিমো। তাই স্কুল ঘরে থাকেছি।’ ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার আমাজান খোঁর ইউনিয়নের সুফিয়া খাতুনের মত বন্যা পরবর্তীতে এমন লাখো মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পানি নামতে শুরু করলেও এখনও নিজ ভিটা-বাড়িতে ফিরতে পারছেন না বানভাসী মানুষ। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যা। নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেকেই। আবার অনেকেই টাকার অভাবে ঘর-বাড়ি ঠিক করতে পারছেন না। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া ঘর-বাড়ি ঠিক করা কখনই সম্ভব না বলে সরকারের কাছে সহযোগিতার আঁকুতি জানান। অনেকের রান্নাটা চলছে নৌকায়, উঁচু চালে কিংবা রাস্তাতেই। এরই মধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টি যোগ করছে ভোগান্তির নয়া মাত্রা। নারী-শিশুদের নাওয়া, খাওয়া, টয়লেট এবং ঘুমানো যে কতটা মানবিক কষ্ট অতিক্রম করছে, তা অবর্ণনীয়। অনেকেই অর্ধাহারে করছে মানবেতর জীবন যাপন। কর্মচঞ্চল খেটে খাওয়া মানুষগুলো হয়ে পড়েছে বেকার। তলিয়ে যাওয়া ফসলী জমি আর অর্ধ-নিমজ্জিত বাড়ি ঘরের দিকে উদাস নয়নে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছেন ফ্যালফ্যাল করে। গবাদী পশু নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকেরা। মাথার ওপরে পলিথিনের ছাউনী, ভেজা স্যাতঁস্যাতে মাটিতে রাস্তায় চট বিছিয়ে শুয়ে আছে নারী, শিশু, বৃদ্ধ। বাড়িঘরে পানি ওঠায় কারো ভিজে গেছে কাঁথা-কাপড়, বিছানা। শিক্ষার্থীদের বইও ভিজে একাকার। সামনেই পরীক্ষা। লেখাপড়া বিঘিœত হচ্ছে মারাত্মকভবে। দুর্ভোগ-দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই শিশুদের নিয়ে। বিধ্বস্ত সড়ক, বাঁধ ও রেলপথ। কয়েকটি জেলার সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দুর্ভোগ নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে বানভাসি মানুষের। তার ওপর ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছে না ত্রাণ। সরকারি কিংবা বেসরকারি চাহিদার তুলনায় কম ত্রাণ নিয়ে এলাকায় গিয়ে দুর্গতদের তোপের মুখে পড়ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

জামালপুরের ইসলামপুরে মাছ ধরতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে আব্দুস ছালাম ও পানিবন্দি অবস্থায় চরম ঠান্ডা জ্বরে বিনা চিকিৎসায় আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা জিনেতন নামে এক গহবধূ, নওগাঁর আত্রাইয়ে বন্যার পানিতে ডুবে আলেফ হোসেন (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এসব মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য নিয়ে রিপোর্ট:
মোঃ হাফিজুর রহমান মিন্টু, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, গতকাল শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নিচু এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাৗয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, আত্রাইয়ে বন্যার পানিতে ডুবে আলেফ হোসেন (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার চকশিমলা গ্রামের এই ঘটনাটি ঘটেছে। জেলার ছোট যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৪ লাখ ৫২ হাজার ৩শ’ ২৫ জন মানুষ পানিবন্দি। নওগাঁ শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট এখনও পানির নিচে। ৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৭২ হাজার ৪শ’ ৮৫ হেক্টর জমির।
মোঃ আজিজুল হক টুকু, নাটোর জেলা থেকে জানান, আত্রাই নদীর পানি সিংড়া ফেরিঘাট পয়েন্টে বিপদ সীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্ধ হয়ে গেছে ৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল গতকাল বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেন।
মুরশাদ সুবহানী, পাবনা থেকে জানান, পদ্মা ও যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাঁচটি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বেড়া উপজেলার যমুনা নদীর নিকটবর্তী ৭টি ইউনিয়নে যমুনার পানি প্রবেশ করেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ত্রাণের জন্য মানুষ অপেক্ষা করছে। গবাদী পশুর খাদ্যের অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে
নাজিম বকাউল, ফরিদপুর থেকে জানান, পদ্মার পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার তিনটি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। গতকাল ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা সদর ইউনিয়নের বানভাসি ৪০০ পরিবারের মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণের চাল বিতরণ করা হয়েছে।
আতাউর রহমান, ঈশ^রগঞ্জ (ময়মনসিংহ) থেকে জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ায় উচাখিলার মরিচারচর (নতুনচর) গ্রামের প্রায় ৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সঙ্কট। ত্রাণের জন্যে চলছে হাহাকার। গতকাল দূপুরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করলেও এখন পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি স্থানীয় কোন জন প্রতিনিধিরা।
আবদুল হালিম দুলাল, মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) থেকে জানান, উপজেলার মিরুখালী বাজারে সড়ক ও জনপদের ভুলের কারণে খালের ভাঙনে হুমকির মুখে শতবর্ষী একটি মসজিদ। মসজিদের পাশ দিয়ে প্রবাহিত আমুয়া-মিরুখালী-ধানীসাফা খালে স্থায়ী পাইলিংয়ের ব্যবস্থা না হলে মিরুখালী ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে মুসল্লিরা আশঙ্কা করছেন।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, ২য় দফার বন্যাতেও বগুড়ায় বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওদের কোন তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বগুড়ার ৩টি উপজেলায় আওয়ামীলীগ দলীয় বর্তমান সংসদ সদস্য ও বিএনপি থেকেই দুর্গত এলাকায় যারা প্রার্থী হবেন, তারা ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করেছেন। বগুড়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নুরে আলম ইনকিলাবকে বলেন, এনজিওগুলো কী করবে এটা তাদের ব্যাপার, সরকারের ত্রাণ ভান্ডারে মজুদের ঘাটতি নেই।

https://www.dailyinqilab.com/article/92945/