২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৩৪

এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান কবে

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের শিক্ষক ও বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী এন্থনি স্টরের (Anthony Storr) বিখ্যাত বই Human Aggression পুস্তকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের আগ্রাসী চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, মানুষ যদি তার বিবেকবোধ ও মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলে অথবা এসব গুণাবলী অর্জনে সে ব্যর্থ হয় তাহলে মানুষই হয়ে পড়ে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। তার ভাষায়, “The Sombre fact is that we are the cruellest and most ruthless species that has ever walked the earth.” অর্থাৎ “মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে এই যে, এই ধরিত্রির বুকে এ যাবত যত প্রাণী বিচরণ করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও যন্ত্রণা প্রদানকারী প্রাণী হচ্ছি আমরা মানুষ।” হ্যাঁ নিজের স্বার্থের জন্য, ক্ষমতা ও লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য, অর্থের জন্য মানুষ যত নীচে নামতে পারে অন্য কোনো প্রাণী সম্ভবত পারে না। হিংস্র জানোয়ারের জন্য হিংস্রতা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের জন্য তা স্বাভাবিক নয়। হিংস্রতা উত্তরণের জন্য মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। অসহায় ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে সে জন্মগ্রহণ করে এবং এই বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সে মানুষের মতো মানুষ হয়ে চলাফেরা করতে শিখে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ তাকে জ্ঞান-বুদ্ধির প্রসার, দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন এবং স্রষ্টা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ প্রেরণা থেকে সে অসভ্য পরিবেশ থেকে সভ্য পরিবেশে প্রবেশ করে। তার এই অভিযাত্রা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানবিক মূল্যবোধের তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশে অসভ্য যুগ তথা আইয়্যামে জাহেলিযাকেও অতিক্রম করছে বলে মনে হয়। সারা দুনিয়ার মানুষ অসভ্য অবস্থা থেকে সভ্য অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সভ্যতা ও শিষ্টাচারের দিকে এক পা আগালে অসভ্যতার দিকে তিন পা পিছাই। এই অবস্থায় গোত্র বা দলগত প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সা এবং ব্যভিচার ও নারীর প্রতি সহিংসতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এটা হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের কাজ, কিন্তু সরকার ও সরকারি দল যদি অপরাধ ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ায় এবং অপরাধীদের অনুপ্রাণিত করে তাহলে দেশ রসাতলে যায়। বাংলাদেশের অবস্থা এখন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কিছু নমুনা তুলে ধরছি।
ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বর্বর কর্মকা- এবং ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এই অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। তাদের অবাধ ও মুক্ত বিচরণ এবং শীর্ষ নেতৃত্বের অনুগ্রহ প্রবণতায় দলীয় বলয়ের বাইরের অপরাধীদেরও বেপরোয়া করে তুলেছে বলে মনে হয়। প্রশ্ন কেন এটি হচ্ছে?
ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় জাতীয় সম্পদ লুট হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের সম্পত্তি লুট করা হচ্ছে, জবর দখল করা হচ্ছে। এতেও তারা সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। নারীর ইজ্জত নিয়েও ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছে। যেখানে ধর্ষণ-ব্যভিচার সেখানেই হয় ছাত্রলীগ, না হয় যুবলীগ, না হয় শ্রমিক লীগ, আওয়ামী লীগ অথবা লীগ পরিবারের অন্যান্য সংস্থা জড়িয়ে পড়ছে। যারা হাতেনাতে ধরা পড়ছে তাদের বিচার হচ্ছে না। জেলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রাজার হালে দিন কাটানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সংক্রামক ব্যধির ন্যায় এই অপরাধ বিস্তৃতি লাভ করছে। মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এখন কোথাও নেই। তিন বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত মেয়েদের সকলেই এখন ধর্ষণকারীদের শিকার হচ্ছে। কন্যা সন্তান শিশু হোক, কিশোরী হোক অথবা যুবতী তাদের নিরাপদে লালন-পালন এবং স্কুল কলেজে প্রেরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। সহপাঠীদের কাছে যেমন তারা নিরাপদ নয় তেমনি স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটি অথবা সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতেও সহকর্মীদের কাছেও তাদের নিরাপত্তা নেই, ধর্ষণ-ব্যভিচার ও ইভটিজিং-এর কিছু কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যে পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্টনিক মিডিয়ায় উঠে আসে; অপরাধী ধরা হয়, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অপরাধীরা অঢেল পয়সা খরচ করে, ক্ষমতাসীন দল অথবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তাকে কন্যাদায় থেকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। যারা ধর্ষণ ব্যভিচারের সাথে জড়িত তারা আগে চোরের মতো পালিয়ে থাকতো, আওয়ামী লীগ শাসনামলে তারা বুক ফুলিয়ে বিচরণ করে, প্রকাশ্যে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করে। এদের বিচার হয়নি। কেন হয়নি সরকারই বলতে পারবেন, দেশের মালিকানার ন্যায় তারা কি ভোগের জন্য নারীদের মালিকানাও দাবি করতে চায়? এ ক্ষেত্রে নারীবাদী নেত্রীরা কোথায়?
দেশে এখন বন্যার যেমন বিস্তৃতি ঘটছে মানুষের দুর্দশা লাঘব এবং ত্রাণের সরকারী ব্যবস্থাও লুটপাটের তা-বে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। একইভাবে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা ল-ভ- ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ফলে অপরাধেরও বিস্তৃতি ঘটছে লাগামহীনভাবে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন নিরপরাধ ছাত্রদের উপর হামলা করছে, শিক্ষকদের পা কেটে দিচ্ছে। আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। সরকার নির্বিকার।
আজ সোমবার যখন নিবন্ধটি লিখছি তখন সহযোগী একটি দৈনিকে দেখলাম ঢাকার একজন নারী পুলিশ এবং নীলফামারীতে তিন সন্তানের একজন মাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। শরিয়তপুরে গণধর্ষণের শিকার চতুর্থ শ্রেণীর একজন ছাত্রী। আবার পাবনায় দুই স্কুল ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। নীলফামারীর ডিমলার আরেক ঘটনায় মাকে বেঁধে রেখে মেয়েকে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর কয়েক দিন আগে বরগুনার বেতাগীতে এক স্কুল শিক্ষিকাকে তার স্বামীর সামনে স্কুলের শ্রেণীকক্ষে সুমন বিশ্বাস (৩৫), রাসেল (২৪), সুমন কাজি (৩০), রবিউল (১৮), হাছান (২৫) ও জুয়েল (৩০) নামের ছয় পাষ- গণধর্ষণ করেছে। এদের সকলেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি এবং লুটপাটের সাথে জড়িত। এরা সন্ত্রাসী। নেশাদ্রব্য সেবন, ক্রয়-বিক্রয় এবং সরবরাহ করে। এদের ভয়ে এলাকার লোকজন তটস্থ থাকে এবং থানার আশ্রয় প্রশ্রয়ে এদের অপরাধপ্রবণতা সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চিত হলে অপরাধীরা প্রকাশ্য দিবালোকে স্বামীর সামনে স্কুলের শ্রেণীকক্ষে একজন স্কুল শিক্ষিকার সম্ভ্রমহানি করতে পারে? নিশ্চয়ই স্কুলের দারোয়ান দপ্তরীরা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল এবং তারা তাদের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারেনি! দেশের মানুষ কেমন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে আছো এখান থেকে সহজেই বুঝা যায়। আমাদের অধঃপতনের মাত্রা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে স্বামী তার স্ত্রীর, পিতা মাতা তাদের কন্যার, ভাই তার বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছে না। এই দুঃখে চলন্ত ট্রেনের নীচে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ কি? একটি ছোট্ট ঘটনা বলি।
বাংলাদেশ পাবলিকেন্স নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি আছে, কোম্পানিটি দৈনিক সংগ্রামের মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংস্থা। এর শেয়ার হোল্ডারের সংখ্যা হচ্ছে ৩৫০০ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। তাদের শেয়ারের টাকা দিয়ে মতিঝিলের আরামবাগে তারা ভবন ক্রয় করে ২০০৭ সাল থেকে ভোগ দখল করে আসছে। সেখানে তাদের অফিস ছিল। ভবনের কক্ষগুলো ভাড়া দিয়ে কোম্পানিটি মাসে প্রায় দশ লক্ষ টাকা আয় করতো। প্রতি বছর তারা সরকারকে আয়করও পরিশোধ করতো। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সিটি কর্পোরেশনের একজন কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা তার সাঙ্গপাঙ্গসহ কোম্পানির অফিসে হামলা করে, কর্মকর্তা কর্মচারীদের মারধর করে বের করে দেয়। তারা অফিসের মূল্যবান সামগ্রী, কম্পিউটার প্রিন্টার, আলমারী, আসবাবপত্র, শেয়ার সার্টিফিকেট, মূল্যবান খাতাপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ, ক্যাশ বুক, লেজার বই প্রভৃতিও লুট করে নিয়ে যায়। তখন থেকে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাড়াও আদায় করে নিচ্ছে। থানা পুলিশ, সরকারী প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সবার কাছ থেকে প্রতিকার চেয়েও কোম্পানিটি কোনও প্রতিকার পায়নি। জবরদখলকারীরা ভাড়াটিয়াদের ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এমনকি জামানতের টাকাও কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে আদায় করে নিচ্ছে। যারা দিতে পারছে না তাদের উঠিয়ে দিচ্ছে এবং উচ্ছেদকৃত ভাড়াটিদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য যুবলীগ ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের দিয়ে কোম্পানির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। সরকারি লোক যেখানে জবরদখলকারী সেখানে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ব্যাপারে আপীল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের পর্যবেক্ষণ মাননীয় প্রধান বিচারপতি দেশের এই নৈরাজ্যকর অবস্থাই তুলে ধরেছেন। কিন্তু সরকার ও সরকারী কর্তারা আদালতের তুলে ধরা বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে আদালতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালত অবমাননার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। রায় পরিবর্তনের জন্য তারা সদলবলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়ে এমন এক নজির স্থাপন করেছেন যার অনুশীলন ভবিষ্যতে বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কেন না বিচারাধীন বিষয় অথবা বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসা রায় পরিবর্তনের জন্য বিচারকের সাথে প্রাইভেট মিটিং করার নজির দুনিয়ার কোথাও নেই। আবার সুপ্রীম কোর্টের রায়ের প্রতি সরকারী বিষোদগার এবং প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে সিনিয়র মন্ত্রীসহ শীর্ষ সরকারী নেতৃবৃন্দের অনভিপ্রেত মন্তব্য দেখে আদালতের প্রতি অপরাধীদের অবজ্ঞা অসম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই মনে হয়। তারা ভাবতে শুরু করেছে যে, সরকারকে আমরাই টিকিয়ে রাখছি এবং সরকার আদালতের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। সারা দেশে অপরাধপ্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার এটি একটি কারণ বলে আমার বিশ্বাস।

http://www.dailysangram.com/post/297029-