২১ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৯:০৭

বাবারে আমার নামটা ন্যাকো

জামালপুর জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাই বন্যাকবলিত। এর মধ্যে ইসলামপুর উপজেলাবাসী বন্যায় চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। কারও কারও ঘর বন্যায় ভেসে গেছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে। অচেনা কোনো লোক দেখলেই তারা ভিড় করেন ত্রাণের আশায়। তাদেরই একজন আশি বছরের বৃদ্ধ মোমেনা বেগম। ইসলামপুরে ধর্মখুড়া গ্রামের এই নারী এ প্রতিবেদককে দেখে ঘিরে ধরেন। তিনি তার দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বাবারে আমার নামটা ন্যাকো। আমরা পরিবারের পাঁচজন খাইয়া না খাইয়া বাঁইচা রইছি। আমরা কোনো সাহায্য পাই নাই। একটা হালের বলদ আছিল ব্যাচলে লাখ টাকা পাইতাম তা সত্তর হাজারে বেইচ্যা দিছি। নিজেই খাইতে পারি না, গরুরে খাওয়ামো ক্যামনে। পাশে বসে থাকা আসমা বেগম নামে এক বয়স্ক নারী বলেন, ৮৮-এর বন্যা দেখেছেন। এটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল। কিন্তু এতো পানি হয়নি। এবারের বন্যা ৮৮-এর বন্যাকেও হার মানিয়েছে। বন্যায় ভেসে গেছে ইসলামপুরের চিনাঢুলী গ্রামের ইউসুফ আকনের ঘর। খালের পাড়ে অবস্থিত এই ঘরটি পাঁচদিন আগে বন্যায় ভেসে যায়। তারপর থেকে স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাতিজার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন ইউসুফ আকন। আত্মীয়স্বজনদের দেয়া খাবার খেয়েই দিনাতিপাত করছেন তারা। নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার ওমর ফারুককে দিনভর খুঁজছিলেন এলাকাবাসী। সন্ধ্যায় তাকে উলিয়া-মাহমুদপুর সড়কে পেয়ে ঘিরে ধরেন এলাকাবাসী। ওমর ফারুক বলেন, খারাপ লাগছে এলাকার মানুষের জন্য তেমন কিছু করতে পারছি না। সরকারি কোনো সাহায্যই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। সরকার কোথায় সহযোগিতা করছে আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। ওমর ফারুকের কথা বলার সময় পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে উলিয়া-মাহমুদপুর সড়কে কয়েক হাজার মানুষকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তাদের কারও কারও ঘর ভেসে গেছে, কারও ঘর ভেঙে গেছে। তারা সবাই বিভিন্নভাবে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এলাকার একমাত্র বাজার উলিয়া বাজার সেটিও পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। গত দুই দিন থেকে পানি কমলেও বাড়িঘরগুলো এখনও বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। উলিয়াবাজারের ব্যবসায়ী ঠান্ডু শেখ বলেন, বন্যার কারণে দোকানপাট বন্ধ ছিল। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি মেরামত করতে ব্যস্ত। এলাকাবাসী সরকারি ত্রাণ থেকে বঞ্চিত বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এহসানুল মামুন বলেন, আমরা প্রতিদিনই সরকারি সহযোগিতা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। এ পর্যন্ত ২৫৮ টন চাল বিতরণ করেছি। এ ছাড়া বন্যার্তদের শুকনো খাবারও দেয়া হচ্ছে। এ উপজেলায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭০০ জন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ হাজার ৬৮১ জন ক্ষতিগ্রস্তকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

দিনাজপুরে বন্যায় হুমকির মুখে ৬ লাখ গবাদিপশু
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে জানান, দিনাজপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৬ লাখ গবাদিপশু। সেই সঙ্গে প্রায় ১৪ লাখ হাঁস-মুরগিও আক্রান্ত হয়েছে বন্যায়। বন্যায় মারা গেছে প্রায় ১০ হাজার হাঁস-মুরগি। বন্যাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে এসব গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি। চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে গবাদিপশু মালিকরা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে এসব অসুস্থ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে ভিড় করছে বানভাসি মানুষ।
দিনাজপুরে বানভাসি মানুষ ও গবাদিপশু এখন একই স্থানে একই সাথে দিনাতিপাত করছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুরও খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্য দিতে না পারায় গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ।
জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৩টি গবাদিপশু হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৫০৫টি গরু, ১০৭টি মহিষ, ২ লাখ ১ হাজার ৯৩১টি ছাগল এবং ১১ হাজার ৪৭০টি ভেড়া রয়েছে। বন্যায় গো-খাদ্যের জন্য ২৫ হাজার ৩৪৭ একর জমির কাঁচা ঘাস ও ১ হাজার ৬৬৬ মেট্রিকটন খড় বিনষ্ট হয়েছে। এ কারণে দিনাজপুর জেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র গো-খাদ্যের সঙ্কট।
প্রায় ১৪ লাখ হাঁস-মুরগিও আক্রান্ত হয়েছে বন্যায়। বন্যায় মারা গেছে প্রায় ১০ হাজার হাঁস-মুরগি। বন্যাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে এসব গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে এসব অসুস্থ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে ভিড় করছে বানভাসি মানুষ।
বন্যা আক্রান্ত এসব গবাদিপশু জ্বর, ডায়রিয়া ও ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকরা চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছেন এসব অসুস্থ গবাদিপশুর।
দিনাজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, সরকারি হিসাব অনুযায়ী দিনাজপুর জেলায় ১৫ লাখ গরু, দুই হাজার ৮২৭টি মহিষ, ৯ লাখ ৩৩ হাজার ছাগল ও ১ লাখ ৩৩ হাজার ভেড়া রয়েছে। কিন্তু এসব গবাদিপশুর জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে দিনাজপুরে মাত্র ১০ মেট্রিক টন গো-খাদ্য পাঠানো হয়েছে। পশুখাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় গো-খাদ্যের ত্রাণ ও আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে জরুরি ফ্যাক্সবার্তাও দিয়েছে দিনাজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্তৃপক্ষ।
বন্যায় প্লাবিত বানভাসি মানুষ এবং গবাদিপশু একই স্থানে আশ্রয় নিয়ে এখন একই সঙ্গে বসবাস করছে। মানুষের পাশাপাশি গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তাই মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য ত্রাণ হিসেবে চেয়েছে খামারি এবং প্রাণি সম্পদবিদরা।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=79781&cat=2/