২১ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৯:০৬

৭২ ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে মসলার বাজার

নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে দাম

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মসলার বাজার নিয়ে 'খেলা' করছেন ৭২ ব্যবসায়ী। সরবরাহ কমিয়ে বিভিন্ন ধরনের মসলার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন তারা। এরপর নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদা ও রসুনের দাম কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকা, পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৩৫ ও এলাচের দাম ৫০ টাকা বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভোজ্যতেলের দামও। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সারাদেশে চার শতাধিক ব্যবসায়ী মসলা আমদানি করলেও ৭০ শতাংশ মসলা এনেছেন মাত্র ৭২ ব্যবসায়ী। এখন তাদের ইশারাতেই বাড়ছে মসলার দাম।


সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার ২০১২ সালে 'প্রতিযোগিতা বিল' পাস করলেও তার কোনো প্রভাব নেই বাজারে। নেই নজরদারিও। তাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বগুড়ার কয়েকজন ব্যবসায়ী মসলা নিয়ে মনোপলি ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন।


দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে খাতুনগঞ্জের বাচা মিয়া সওদাগরের স্বত্বাধিকারী মো. ইদ্রিস বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পণ্য সরবরাহ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১১০ টাকার আদা ও বড় রসুন খুচরা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ২০ থেকে ২৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হলেও পাইকারিতে এখন দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও বিদেশি পেঁয়াজ ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারণে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি হলেও পাইকারিতে বেচাকেনা ঠাণ্ডা ছিল। আবহাওয়া ভালো হলে বাড়বে সরবরাহ। কমে আসবে পণ্যের দামও। দেশি পেঁয়াজ নিয়ে পাবনায় কারসাজি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ৪২৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৯ হাজার ৩৫৯ টন রসুন আমদানি করে ৯৮ ব্যবসায়ী। কিন্তু আমদানি করা রসুনের প্রায় অর্ধেকই এনেছে মাত্র ১৫ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সর্বাধিক এক হাজার ৯২৪ টন রসুন আমদানি করেছে চট্টগ্রামের রুমি এন্টারপ্রাইজ। দেড় হাজার থেকে এক হাজার টনের ওপরে রসুন এনেছে যথাক্রমে চট্টগ্রামের কফিল অ্যান্ড ব্রাদার্স, এনএন এন্টারপ্রাইজ, আবরার ট্রেডিং, ঢাকার মিতা এন্টারপ্রাইজ, চট্টগ্রামের ইকবাল অ্যান্ড ব্রাদার্স, ভাই ভাই বাণিজ্যালয়, চট্টগ্রামের জাহান এন্টারপ্রাইজ ও সুলতানা করপোরেশন। এক হাজার থেকে ৬০০ টনের মধ্যে রসুন এনেছে যথাক্রমে ঢাকার হাফিজ করপোরেশন, আয়নাল অ্যান্ড সন্স, আসিফ ট্রেডিং, বগুড়ার সুইটি এন্টারপ্রাইজ, রুম্পা এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার রফিক ট্রেডার্স ও চট্টগ্রামের সাবরিন এন্টারপ্রাইজ। সর্বশেষ অর্থবছরে ৪৭ ব্যবসায়ী এনেছে ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের এক হাজার ৫৫৯ টন গোলমরিচ। এর মধ্যে ১০ জন ব্যবসায়ী এনেছে ৭০ শতাংশ গোলমরিচ। সর্বোচ্চ ১৯৩ টন গোলমরিচ এনেছে চট্টগ্রামের ফরচুন ইন্টারন্যাশনাল। ১৫২ ও ১২৫ টন আমদানি করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে চট্টগ্রামের হারুন স্টোর ও ঢাকার সনিকা এগ্রো ফুডস। ১০০ টনের নিচে কিন্তু ৫০ টনের ওপরে গোলমরিচ আমদানি করা অন্য বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে যথাক্রমে ঢাকার হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদার্স, ইস্টার্ন করপোরেশন, চট্টগ্রামের রানী ট্রেড, মিতা স্টোর, ঢাকার এমএস ট্রেডার্স, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ট্রেডিং ও আকতার ইম্পেক্স।


চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯২ ব্যবসায়ী দারুচিনি আমদানি করেছে ৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ১১ হাজার ৩২৩ টন। এর মধ্যে মাত্র ১০ জন ব্যবসায়ী এনেছে ৭০ শতাংশ দারুচিনি। তাদের মধ্যে ঢাকার এম রহমান সর্বাধিক ৭৯৫ টন দারুচিনি আমদানি করে। অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের এম কে এন্টারপ্রাইজ ৭১৪ টন, হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স ৬০৩ টন, ঢাকার সনিকা এগ্রো ফুডস ৬০০ টন, হেদায়েত অ্যান্ড ব্রাদার্স ৪৯৬ টন, আবু মো. অ্যান্ড কোম্পানি ৪৮৪ টন, চট্টগ্রামের নূর এন্টারপ্রাইজ ৪০৮ টন, মেসার্স মমিনুল হক ৩৮৪ টন, দাশ ইমপেক্স ৩৪২ টন ও ঢাকার আল আমিন ট্রেডিং ৩১৯ টন দারুচিনি আমদানি করে শীর্ষ দশে আছে। সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা মূল্যের ৭৮৭ টন লবঙ্গ আমদানি করেছে ৩৯ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ লবঙ্গ এনেছে মাত্র সাতজন। ঢাকার এম রহমান ৭৩ টন, চট্টগ্রামের মিতা স্টোর ৫৭ টন, ঢাকার ব্লু বে ইন্টারন্যাশনাল ৫৫ টন, চট্টগ্রামের বিআর ট্রেডিং ৩৬ টন, হারুন স্টোর ৩৪ টন, প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ ৩৪ টন ও ঢাকার এলিনা ইমপোর্ট ৩০ টন লবঙ্গ আমদানি করে।


সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ১৬৫ কোটি টাকা মূল্যের তিন হাজার ১৩৬ টন এলাচ এনেছে ৪৩ ব্যবসায়ী। সর্বোচ্চ ৩৮২ টন এলাচ এনেছে হক মার্কেটের আবু মো. অ্যান্ড কোম্পানি। অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স ৩৩৩ টন, বিআর ট্রেডিং ২৫৪ টন, এবি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং ২৩০ টন, অনুকূল ট্রেডার্স ২২০ টন, এবি ট্রেডার্স ২০৪ টন, এমইউ ব্রাদার্স ১২০ টন, ঢাকার জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানি ১১৭ টন ও চট্টগ্রামের বিআর ট্রেডিং ১০৩ টন এলাচ আমদানি করেছে। ১১৩ ব্যবসায়ী ৩৬২ কোটি টাকা মূল্যের ২৪ হাজার ৪৫ টন জিরা আমদানি করে। তবে দুই হাজার থেকে ৫০০ টন জিরা এককভাবে আমদানি করে ১০টি প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৬৭ টন জিরা আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এবি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি। এরপর এমইউ ব্রাদার্স এক হাজার ১৯৯ টন, সাউদার্ন ট্রেডিং ৯৮৫ টন, বিআর ট্রেডিং ৯৩৭ টন, হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স ৯১০ টন, নূর ট্রেডিং কোম্পানি ৭৭১ টন, অনুকূল ট্রেডার্স ৬৬৮ টন, রোজ ইন্টারন্যাশনাল ৬৪০ টন, ট্রেড লিঙ্ক এজেন্সি ৫৫৮ টন, আকতার ইমপেক্স ৫০৮ টন ও সাউদার্ন কমার্শিয়াল করপোরেশন ৫০২ টন জিরা আমদানি করে।


সর্বশেষ অর্থবছরে ১৮০ ব্যবসায়ী ৪১৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মূল্যের ৬৯ হাজার ৯৬১ টন আদা আমদানি করলেও শীর্ষ আমদানিকারকের সংখ্যা মাত্র ১১ জন। তার মধ্যে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫৬০ টন আমদানি করেছে চট্টগ্রামের ফাহাদ ট্রেডিং। এ ছাড়া ঢাকার সানজিদা এন্টারপ্রাইজ তিন হাজার ৮৩ টন, মিতা এন্টারপ্রাইজ দুই হাজার ৯৮০ টন, ভাই ভাই বাণিজ্যালয় দুই হাজার ৫১৩ টন, রুমি এন্টারপ্রাইজ দুই হাজার ৫০ টন, ঢাকার অপু এন্টারপ্রাইজ দুই হাজার ৩৫ টন, ব্রাদার্স ইমপেক্স এক হাজার ৮৩৬ টন, আসিফ ট্রেডিং এক হাজার ৭৩৬ টন, রাজশাহীর সিদ্দিকা এন্টারপ্রাইজ এক হাজার ৭৩৫ টন, ঢাকার আল ফায়েদ ট্রেডার্স এক হাজার ৬০৪ টন ও জেনি এন্টারপ্রাইজ এক হাজার ৫২৭ টন আদা আমদানি করেছে।

 

http://bangla.samakal.net/2017/08/21/318867