২১ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৯:০৪

অনেক সাধের ময়না এই প্রিয় জন্মভূমি

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

জন্মভূমি ভালোবাসে না এমন অকৃতজ্ঞ পৃথিবীতে কেউ আছে বলে মনে হয় না। জন্মভূমিতে সবাই সুন্দরভাবে বসবাস করতে চাইবে এটাইতো স্বাভাবিক। জন্মভূমির বুকে সবাই নিজের আবাসন সাজাবে এমনইতো প্রত্যাশা থাকে দেশগতপ্রাণ মানুষের। এতো আশা-আকাক্সক্ষা সত্ত্বেও কোনও কোনও মানুষকে দেশছেড়ে চলে যেতে হয়। অনেক সময় এমনই বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, জন্মভূমিতে কারুর কারুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই অনেকে ভিনদেশের অভিবাসনগ্রহণে বাধ্য হয়। যেমন ধরুন ইলোরার কথা।
হ্যাঁ, ইলোরা জামান। জন্ম আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশে। অভিবাসনসূত্রে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তাই সুন্দরবন কিংবা বান্দরবান নিয়ে ভদ্র মহিলার মাথাব্যাথা নেই তেমন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবার কারণে মাঝে মাঝে মাথাব্যথা হলেও তিনি তা অস্ট্রেলিয়ান পেইনকিলার প্যানাডল সেবনেই দমন করেন।
তিনি লিখেছেন:
‘অস্ট্রেলিয়া আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছ। আমার মেধার মূল্যায়ন করেছে। আমাকে ফাইল নিয়ে অফিসে অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি। পথেঘাটে বখাটেদের টিজিংয়ের শিকার হতে হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকতে হয় না।’
ইলোরা এখন অস্ট্রেলিয়াকেই নিজদেশ মনে করছেন। তিনি আরও লিখেছেন:
‘আমার এই দেশ অপরিচ্ছন্ন না। আমার পিতাকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় না। আমাদের বাসা কেউ ভাঙচুর করে না। পুলিশের বাপের সাধ্য নেই আমার গায়ে হাত তোলে। তাদের কাছে যেতে আমি ভয় পাই না। আমি জানি, তারা আমার বন্ধু। যখন ডাকবো পাশে পাবো। তারা টাকা চাইবার দুঃসাহস করে না।’
ইলোরা জামান মনের কষ্টগুলো আরও উল্লেখ করেন এভাবে, অস্ট্রেলিয়ায় তাকে কোথাও ঘুষ দিতে হয় না। তার ভাই ক্রসফায়ারের ভয়ে থাকেন না। তার বোনকে ধর্ষণের শিকার হতে হয় না। সেখানে বাসায় ডাকাতি হয় না। তিনি রাত-বিরাতে যখন তখন বাইরে যেতে পারেন। কাজ করেন। ট্যাক্স দেন। সেই ট্যাক্সের টাকা দিয়ে সেদেশের সরকারের লোকেরা আঙ্গুলফুলে কলাগাছ হন না। তারা ইলোরার চিকিৎসা সেবা দেন বিনামূল্যে। তাকে সারাক্ষণ আতংকে থাকতে হয় না। রাস্তায় বেরোলে সড়কদুর্ঘটনার ভয়ে থাকতে হয় না। প্রতিবছর বন্যার পানিতে ডুবে যেতে হয় না। বাড়ি কিনবার সময় কেউ তার কাছে চাঁদা চায়নি। তার গাড়ি মিছিলে পড়ে গিয়ে ভাঙচুরেরর শিকার হয় না।
নিজদেশে বসবাস করতে গিয়ে ইলোরা জামান যেসব দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন এবং ভোগান্তির মুকাবিলা করেছেন সেগুলোর বেদনার্ত বর্ণনা দিয়েছেন:
‘কেউ আমার মাছের পুকুরে বিষ ঢেলে দেয় না। আমার জমি দখল করে না। আমাকে পিস্তল দেখায় না। আমাকে ফরমালিন বিষযুক্ত রং করা খাবার খেতে হয় না। হোটেল- রেস্টুরেন্টে আমাকে মরা মুরগি খাওয়ানো হয় না। আমাকে আমের জুসের বদলে মিষ্টিকুমড়া খাওয়ানো হয় না। এখানে রানাপ্লাজার রানার মতো লোক নেই। প্রতিবছর লঞ্চডুবির শিকার হতে হয় না। গার্মেন্টসে পুড়ে যেতে হয় না। হঠাৎ গুলি এসে বুক ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায় না। আমি না খেয়ে থাকলে এখানকার সরকার খাবারের ব্যবস্থা করে। আমার বাকস্বাধীনতা রয়েছে। আমার ভোটে নির্বাচিত সরকার সামান্য ভুল করলে আমি তার টুঁটি চেপে ধরতে পারি। এখানকার মিডিয়া দৌড়ে আসবে সত্য সংবাদের জন্য। আমার যাবতীয় সমস্যা তুলে ধরতে এখানে কোনও সমস্যা নেই।’
অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনগ্রহণকারী ইলোরা আরও জানিয়েছেন:
সেখানকার সরকার তার কষ্ট বোঝে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। সরকারকে গাল দিলেও তার লাশ ফেলে দেয় না। রিমান্ডে নেয় না। সরকার বুঝবার চেষ্টা করে যে, এই নাগরিক কেন অসন্তুষ্ট? সরকার তার মন পেতে চেষ্টা করে। খুশি রাখতে চায়, পরবর্তীতে যেন তিনি ক্ষমতাসীনদেরই ভোট দেন। নির্বাচনের সময় লাশের পর লাশ দেখতে হয় না। মানুষের রক্ত দেখতে হয় না। মারামারি, কাটাকাটি, কোনও হৈ হৈ নেই। কেউ গলায় ছুরি বসায় না। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে গিয়ে বিপদে পড়লে সেদেশের হাই কমিশন তাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করে। এছাড়া ইলোরা সেখানে সরকারি তরফ থেকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধে পান, যা নাকি বাংলাদেশের মানুষ কল্পনায়ও আনতে পারে না বলে তিনি জানিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি অভিবাসী ইলোরা জামানের হৃদয়মথিত কথাগুলো আমার ইনবক্সে শেয়ার করেছেন জনৈক ফেসবুক বন্ধু মুহাম্মদ হায়দার আলী। ইলোরা শেষে আরও উল্লেখ করেন:
‘আমি এখন আসলেই অস্ট্রেলিয়ার মালিক। এরাই আমাকে মালিকের মতো যতœ করেন। আর বাংলাদেশের মালিকেরা ক্ষমতায়। আমি তাদের কেউ না। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি হলেও আমি বাংলাদেশের কেউ নই। কেড়ে নিয়েছে তারা আমার সবকিছু।’
তবুও নিজের জন্মস্থানের জন্য এতো মমত্ববোধ কেন, ইলোরা জামান জানেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু সত্যই কি এই ‘কেন’র জবাব তার জানা নেই? আমি মনে করি, এর উত্তর ইলোরার বক্তব্যেই রয়েছে।
জন্মভূমির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে নয়, ক্ষুব্ধ হয়ে নয়, একান্ত বাধ্য হয়ে অনেক সময় অনেকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (স)ও মক্কার কুরাইশদের জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এই হিজরতও ছিল অভিবাসন।
নিজদেশ ফেলে অন্যদেশে বসতি গড়ে থাকা সবসময় আনন্দদায়ক হয় না। পরবাসী হবার পেছনে থাকে অনেক কান্না। অনেক বেদনা। ওই যে, কথায় বলে না ‘বেড়াল কি আর সহজে গাছে ওঠে?’ না, ওঠে না। সারমেয় যখন পেছন থেকে ধাওয়া দেয়, তখনই বেড়াল গাছে উঠে প্রাণ বাঁচায়। তবে ছোট পাখি, ইঁদুর কিংবা এমন শিকার ধরতে বেড়াল কখনও কখনও গাছে ওঠে বটে। অনেক মানুষও অধিকতর সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য দেশের ভিটেমাটি ফেলে বিদেশে চলে যায়। এরা আসলে সুবিধাবাদী। যেখানে সুযোগ সেখানেই তারা দৌড়ায়।
ইলোরা হয়তো ভাগ্যবতী। প্রতিভাময়ী। তিনি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সুবিধে পেয়েছেন। আর পেয়েছেন প্রতিভার মূল্যও। তবে অনেকেই ইলোরা নন। বিদেশ গিয়ে অনেককেই নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। অনেকের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে। কেউ কেউ লাশ হয়েও ফেরেন। সামান্য কাজের সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা যান অনেকে। কাউকে কাউকে জিম্মি হিসেবে আটকিয়ে টাকা আদায় করা হয়। দেশে থাকা আপনজনেরা ভিটেমাটি বেচে সব পাঠিয়েও তাদের উদ্ধার করতে পারেন না। কাজেই বিদেশ গেলেই সোনার হরিণ পাওয়া যাবে এমন নয়।
বলতে দ্বিধা নেই যে, অঢেল অর্থবিত্তের মালিক অনেকেই মালয়েশিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। সুইজব্যাংকে টাকার পাহাড় জমিয়েছেন। দেশের প্রতি তাদের আস্থা নেই। জন্মভূমিকে তারা বাসোপযোগী মনে করেন না। করবেন কীভাবে? এখানে জানমালের নিরাপত্তা নেই। বউঝি নিয়ে রাস্তায় বেরোনো মুশকিল। ছিনতাইকারী, লুচ্চার দাপট। পুলিশের টিয়ারশেল, গুলি, হামলা-মামলার ভয়। পুলিশের বেশে তুলে নিয়ে গুম। খুন। শ্লীলতাহানি। প্রতিবাদ করলেই গ্রেফতার। জেলজুলুম। রিমান্ড। কী নেই এখানে? যেসব কথা ইলোরা লিখেছেন মনের দুঃখে, তার কোনটা অসত্য বলবার ক্ষমতা আছে কারুর? নেই। চতুর্দিকে তুফান সরকারদের দাপুটে অবস্থান। এমতাবস্থায় ইলোরা জামানরা যদি ইজ্জতের ভয়ে, স্বামী-সন্তানের জীবনের ভয়ে, নিরপরাধ ভাইকে বিনাদোষে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশী নির্যাতনের ভয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যান, প্রিয় জন্মভূমিকে যদি শ্বাপদসংকুল মনে করেনই, তাহলে কী করবেন?
আমরা জন্মভূমিকে স্বর্গাদপি গরীয়সী মনে করি। এর বুকেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবার তীব্র আকাক্সক্ষা পোষণ করি। জীবনের অধিক ভালোবাসি এই মাটিকে। এর জলহাওয়া আমাদের প্রাণ জুড়ায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এদেশ। অনেক সাধের ময়না এই প্রিয় জন্মভূমি। কিন্তু তুফান সরকাররা যেভাবে চাঁদাবাজি আর ধর্ষণের তুফানমেল দাবড়াচ্ছে, জোর করে মেয়েদের তুলে এনে মাথা কামিয়ে বেল করছে, তাতেতো ইলোরা জামানের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়।
তবে সাধারণ নিরাপরাধ ও দেশগতপ্রাণ মানুষের জন্য কি প্রিয় এদেশ প্রকৃত অর্থেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে? না, আমরা এমনটি মনে করতে চাই না। চাই সমাজ ও জাতিকে নিরাপদ দেখতে। চাই দেশকে বসবাসযোগ্য রাখতে। আর এজন্য তুফান সরকারদের তুফান রুখে দিতে হবে বৈকি।

 

http://www.dailysangram.com/post/296873-