২১ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৯:০৩

দেখা অদেখা

একটি অভাবনীয় বৈঠক

সালাহউদ্দিন বাবর

আদালতের কোনো রায়ের ইস্যুতে প্রধান বিচারপতি দায়িত্বরত অবস্থায় তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের বৈঠক করার অতীতে কোনো নজির নেই। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘ এক বৈঠক করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সাথে। এই অভাবনীয় বৈঠকের পর প্রধান বিরোধী দল বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এই অভাবনীয় বৈঠক সাধারণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত এই রায়কে ক্ষমতাসীনেরা মেনে নিতে পারেনি এবং এই রায়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন। ইতিহাসের কোনো বিকৃতি নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণে কোথায় এবং কিভাবে বিকৃতি ঘটেছে, তা কিন্তু সরকারি মহল থেকে খোলাসা করা হচ্ছে না। তাই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, অভিযোগের মাত্রা কতটুকু। এই রায় অনেকেই পড়েছে এবং পর্যালোচনা বিশ্লেষণ হচ্ছে, কিন্তু সরকারি মহল ছাড়া এখনো কেউ এমন অভিযোগ তোলেনি। সে যা-ই হোক, এ বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এমন বৈঠক কতটা শোভনীয়।
দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধৃত রয়েছে। সংবিধানে জনগণের অবস্থান ও ভূমিকাকে সুনির্দিষ্ট করেছে। সংবিধানে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; জগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। জনগণের অভিপ্রায়ের পর অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।’ প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইনসভাকে দেয়া হয়েছে। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন কার্যকর করার ও আনুষঙ্গিক নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নির্বাহী বিভাগকে। প্রণীত বিধানাবলি অনুযায়ী বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব বিচার বিভাগকে দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগকে আরো কিছু বাড়তি দায়িত্ব সংবিধান দিয়েছে। বিচার বিভাগকে সংবিধানের হেফাজতকারীও করা হয়েছে। সংবিধান সংরক্ষণ এবং এর ব্যাখ্যা করার দায়িত্বও বিচার বিভাগের। আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা পৃথকীকরণ এভাবেই করা হয়েছে। তাই সীমারেখা লঙ্ঘনের ক্ষমতা। দেশে এখন যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা এই শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটার কারণেই ঘটেছে।
সে যা-ই হোক, সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা কোনো দোষণীয় নয় বটে, তবে বিচারকের দায়িত্বে থাকাবস্থায় এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এমন বৈঠক দেশে এই প্রথম। যত দূর অনুমান করা যায়, তাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বৈঠক হয়েছে। তবে রায়ে ও তার পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের যে ধরনের উদাহরণ তৈরি হলো, তা খুব রীতিসিদ্ধ হয়নি বলে বিভিন্ন মহল মনে করে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে- রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে নেতৃবৃন্দের অনেকে যে ভাষায় নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করেছেন, তা শালীনতা ও সৌজন্যসুলভ এবং কতটা আইনানুগ তা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে। রায় নিয়ে মত প্রকাশ, ভিন্নমত পোষণের যে একটা রীতিপদ্ধতি রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তার বরখেলাপ হয়েছেই এবং একই সাথে এটা যদি মনে করা হয় যে, এই মত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিপরীত হয়েছে; তবে এর বিপক্ষে বলার কিছুই নেই। দেশের নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ খুব সফলভাবে চলছে, তা বলা যাবে না। বিশেষ করে প্রায় দশ বছর ধরে আইন বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। যার প্রতিক্রিয়ায় দেশে জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর উপসর্গ হিসেবে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, নারী নির্যাতন, সুশাসনে ব্যত্যয় ঘটছে। প্রশাসন বিভাগের যে সঙ্কট এখন চলছে, তার প্রতিবিধান করার ক্ষেত্রে আইন বিভাগ ব্যর্থ হয়েছে। এখন যদি আবার বিচার বিভাগ চাপের মধ্যে পড়ে বা তার স্বাধীনতায় কোনো বাধা তৈরি হয়, তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুই অঙ্গ বিকল থাকার পর এখন তৃতীয় অঙ্গও যদি আবার সঙ্কটের মুখে পড়ে, তবে রাষ্ট্রযন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এর পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। গোটা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। দেশ কিন্তু এখন খুব স্বাভাবকি অবস্থায় নেই। নাগরিক জীবনে হাজারো সমস্যা মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগকে খুব সতর্ক হতে হবে। ধৈর্য ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে চলতে হবে। আদালতের বিষয়গুলো খুব স্পর্শকাতর, বিষয়টি উপলব্ধিতে নিয়ে চলা উচিত। রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয়, তারা রায়ে বিচলিত বোধ করছেন। রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সমস্যায় রয়েছে, কিন্তু দেশবাসী হাজারো সমস্যায় নিপতিত। হালে গোটা দেশ বন্যায় প্লাবিত, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, নারী নির্যাতন সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। এসব কিছুর সমাধান সরকারকেই দিতে হবে। তাদের সব সমালোচনা সহ্য করা এবং ঔচিত্যবোধের পরিচয় দিতে হবে।
ক্ষমতাসীনেরা আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে অতীতের মতোই রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করেন। নি¤œ আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরি ও শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি ’৭২ সালের মূল সংবিধানে উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীও তার সরকারের হাতে নিয়ে নেয়। কিছুকাল আগে আপিল বিভাগের এক রায়ে তা আবার উচ্চ আদালতের হাতে আসে। কিন্তু এ নিয়ে যে বিধি প্রণয়নের প্রয়োজন, তা সরকার করছে না। এ নিয়েও আদালতের সাথে সরকারের টানাপড়েন চলছে। হালে উচ্চ আদালতের সাথে সরকারের তীব্র মন কষাকষি চলছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের অপসারণ করার এখতিয়ার সংসদে দেয়া হলো সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ পর্যায়ক্রমে এই সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করে বাতিল ঘোষণা করেন। এই রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়েই এখন শুরু হয়েছে আদালতের সাথে টানাপড়েন। জাতীয় সংসদে এই রায় নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। সংসদের আলোচনা থেকেই এটা অনুমান করা গেছে, এই রায় স্বাভাবিকভাবে নেয়া ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিন। এ বিষয়টি আরো কঠিন অবস্থায় গড়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া আরো কঠোর ও তীব্র আকার নেয়ায়। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু নরম ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘এই রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত। আইনমন্ত্রী সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, রায়ে অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তিনি সেগুলো রায় থেকে বাদ দেয়ার জন্য রিভিউর আবেদন করার সম্ভাবনার কথা বলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, অন্য একাধিক মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকখানি ভিন্ন এবং তীক্ষè। তারা বিচার বিভাগের বিশেষত প্রধান বিচারপতির প্রতি কঠোর সমালোচনার বাণ নিক্ষেপ করেন, যা আদালত অবমাননার দোষের পর্যায়ে পড়ে। সংসদের ভেতর বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সংসদের দায়মুক্তি থাকলেও সংসদের বাইরে এমন সমালোচনা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয় এবং নজিরবিহীন। এ নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিতর্ক হচ্ছে, যা আদালতকে বিব্রত করছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রায় নিয়ে কেউ রাজনীতি করবেন না। এই বিতর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সরকারের পক্ষে যোগ দেন। তিনি রায়ের সমালোচনা করেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হকের মন্তব্য নিয়ে বিরোধী দলের ক্ষুব্ধ আইনজীবীদের একটি দল প্রধান বিচারপতির কাছে যান। তিনি বলেন, আদালত রাজনীতিতে পা দেবে না।
একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী একটি অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে রাজনীতি করা মোটেও উচিত হয়নি বা হচ্ছে না। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে এ নিয়ে একটা যুদ্ধ বেধে গেছে। রায়ে ভুল থাকলে আদালতেই তার সংশোধনের একটা পদ্ধতি রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের মূল কথা হচ্ছে অপ্রিয় ও অপছন্দের হলেও আদালতের রায় অবশ্যপালনীয়। রায়ের সমালোচনা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। ইচ্ছামতো বা বেছে বেছে বিচারের কৌশল কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজের রীতি হতে পারে না। আদালতের যে রায় আমার পক্ষে যাবে, শুধু সেটাই আমি মানব, এমন যুক্তি কোনো সুস্থ চিন্তার প্রতিফলন ঘটায় না। একাধিক সংশোধনীর ক্ষেত্রে আদালতের রায়কে উৎসাহিত হয়ে স্বাগত জানাতেও আমরা দেখেছি। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে আমরা জানতে পারলাম সুপ্রিম কোর্টে যত মামলা বিচারাধীন, তার ৮০ শতাংশই সরকার একটি পক্ষ। মামলায় কোনো পক্ষই হারতে চায় না, সবাই জিততে চায়। সুতরাং সরকারও যে ওসব মামলায় জিততে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সরকার যদি বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে কারো পক্ষে কোনো ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ কি আর থাকবে? তা সে হোক জমি অধিগ্রহণে আইন না মেনে কাউকে বাস্তুচ্যুত করা কিংবা বেআইনি আটকাদেশ অথবা নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির মতো কোনো গুরুতর প্রশ্ন। আইন সবার জন্য সমান, এই ঘোষিত নীতি মেনে চলায় সরকার যে কতটা আন্তরিক, তার দৃষ্টান্তগুলো কল্পনা করুন।
আমরা জানি, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গে তার কোনোটিকে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি। সম্প্রতি তিন অঙ্গকে নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা এর সর্বশেষ প্রমাণ। অবশ্যই এটা দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। রাষ্ট্রে দু’টি অঙ্গের প্রতিনিধিরা তাদের সীমা লঙ্ঘন করছেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক প্রেস কনফারেন্স করেন, যা তার এখতিয়ারে নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী বলেছেন, তিনি যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন তিনি তা পারেন না। (আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে) তিনি সরকারি চাকুরে হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আমার মতো তিনি যদি শুধু পেনশন পেতেন, তা হলে না হয় একটা কথা ছিল। সরকারের কাছ থেকে তিনি বেতন পাচ্ছেন। তার পদটি আধা বিচার বিভাগীয় হতে পারে। তিনি কেন সংবাদ সম্মেলন করবেন। আমি মনে করি, এটা তার পক্ষে সমীচীন হয়নি। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট শুধু কবর জিয়ারত করতে পারেন। দ্বাদশ সংশোধনীর পরে তিনি এ কথা বলেছিলেন। এর ১৬ বছর কেটেছে। এই সময়ে আমরা চারবার সংবিধান সংশোধন বিল পাস হতে দেখলাম, অথচ তার সেই বক্তব্যের কোনো বদল হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি আর সব ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলেন। তাই এ অবস্থায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমার তো মনে হয় তখন সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতই নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবেন। তাই সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় খুবই সঠিক হয়েছে বলে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন মনে করেন।
সরকার এখন শুধু আদালত ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত। ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও তার পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিভক্ত করার বিষয় নিয়েই এখন কাজ করছে। দেশের অন্যান্য সমস্যা নিয়ে মনোযোগ দেয়ার অবকাশ নেই। অথচ নানা সমস্যায় দেশবাসী এবং রাষ্ট্র নিপতিত। অর্থনৈতিক সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। জাতীয় অর্থনীতির হাল ভালো নয়। বাণিজ্যঘাটতি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। দেশ এখন বিভিন্নমুখী সঙ্কটের ভেতর দিয়ে চলছে। বারবার বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্যঘাটতি। চাল, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন ছিল, ফসলহানির কারণে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। বন্যায় দেশের এক বিরাট অংশ প্লাবিত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, খাদ্য নেই। সরকারি ত্রাণ নেই বললেই চলে। অথচ প্রশাসনের মধ্যে জনগণের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে উদ্বেগ কর্মতৎপরতা নেই।
এসব বিষয় নিয়ে যাদের সোচ্চার হওয়ার কথা, সেই জবাবদিহির জায়গা কিন্তু এখন নেই। বন্যা নিয়ে বানভাসি মানুষের খোঁজখবর নেয়ার তাগিদ সংসদ সদস্যদের মধ্যে নেই। এমন জাতীয় সঙ্কটে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকার কোনো তাগিদ সংসদ সদস্যদের নেই। আসলে যে নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত, সেখানে তারা মানুষের ভোট নিয়ে তো আসেনি। তাই তাদেরও কোনো জবাবদিহির অনুভূতি বা তাগিদ নেই। এর আগে দেখা গেছে, অতিবৃষ্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরী পানিতে ভেসে গেছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য দুই নগরীর নাগরিকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কিন্তু দুই নগরীর তিন মেয়রকে দেখা গেছে অসহায় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ এক মেয়র তার মেয়াদের এক বছরপূর্তি উপলক্ষে গর্বের সাথে বলেছেন, তিনি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে শতভাগ সফল। আসলে দেশের সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীলেরা অতিকথনের দোষের মধ্যে রয়েছেন। হালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের কয়েকটি অবাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে ঢাকার নাম ওপরের দিকেই রয়েছে। ঢাকার দুই মেয়র এখন কী বলবেন বা কী করবেন? রাজধানীর এই হাল নিয়ে শুধু দুই মেয়রের ভূমিকার পাশাপাশি সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। রাজধানীতে বাস করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিশিষ্টজন। তারা এই শহরে চলাফেরা করেন, এখানকার আলো-বাতাসে ভাগ বসান। তাই শুধু দুই মেয়রের ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে সমস্যা এড়ানো যাবে না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/245813