২০ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৩১

এবার পদ্মাতীরবর্তী অঞ্চলে বন্যার শঙ্কা

ফারাক্কায় দৈনিক ৫ সেমি. পানি বাড়ছে * ১০ জেলায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ লণ্ডভণ্ড * ভারত থেকে ভেসে আসছে লাশ ও মৃত পশু : কুড়িগ্রামে পচা গন্ধে বাতাস ভারি * ৭ দিনে মারা গেছে ৮১ জন * উন্নতি : কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ * অবনতি-স্থিতিশীল : মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর

এবার রাজশাহীসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসছে বন্যা। নেপাল-বিহারসহ গঙ্গা অববাহিকার উজান থেকে নেমে আসা পানি এই বন্যা তৈরি করবে। ২৫ আগস্টের পর রাজশাহী বিভাগে পদ্মা বিপদসীমা পাড়ি দেবে। ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং রাজবাড়ীতে বন্যা দেখা দিতে পারে। বর্তমানে বন্যা আক্রান্ত নীলফামারী-গাইবান্ধা-সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের জন্যও সুখবর তেমন নেই। ওই অঞ্চলে বর্তমানে বন্যার পানি নামছে। কিন্তু অমাবস্যার কারণে সাগর থেকে জোয়ারের পানি ঢুকবে দক্ষিণাঞ্চলে। এর ফলে ২২ আগস্টের পর বন্যার পানি নেমে যাওয়ার গতি কমে যাবে। শুধু তাই নয়, ২৬ আগস্টের পর উত্তরাঞ্চলে ফের বন্যা দেখা দিতে পারে। এমন পরিস্থিতি হলে ওই অঞ্চলের জন্য এটা হবে তৃতীয় দফা বন্যা। বর্তমানে দ্বিতীয় দফা বন্যায় ভাসছে অঞ্চলটি। বন্যা বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

এদিকে বন্যায় উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১০ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক ও রেল যোগাযোগ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বন্যার পানির তোড়ে দিনাজপুর-পার্বতীপুর রেললাইন এমনভাবে এঁকেবেঁকে গেছে দেখলে মনে হবে যেন সাগরের ঢেউ। এছাড়া রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, নীলফামারী, জয়পুরহাট ও জামালপুরে কাঁচা-পাকা সড়ক ও সেতু ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেছে। এসব জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। কোনো কোনোটি ধসে গেছে। দেখলে মনে হবে, যেন কোনো বিধ্বস্ত নগরী। এদিকে বন্যায় শনিবার আরও ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ৭ দিনে মারা গেছেন ৮১ জন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমেইলে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, ‘ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বর্তমানে দৈনিক ৫ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। এ কারণে ২৫ আগস্টের পর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করতে পারে। ২৪ আগস্ট নাগাদ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমা পার করতে পারে। এসব লক্ষণে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে এরপরের বড় বন্যা ধেয়ে আসছে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায়। আর তেমনটি ঘটলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং রাজবাড়ীতে বন্যা দেখা দিতে পারে।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চলের (কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ) বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। তবে উত্তরাঞ্চল থেকে নেমে আসা পানির কারণে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যা চলছে। সরকারি এই সংস্থাটির মতে, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল এবং নিন্মাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি কিছু জায়গায় স্থিতিশীল ও কিছু জায়গায় অবনতিশীল থাকবে।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি রাজধানীর আশপাশেও চাপ সৃষ্টি করছে। ঢাকার চতুর্দিকের ৫টি নদীর পানি বিপদসীমা বর্তমানে ৩ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত আছে। তবে এই পানি নদীকে কানায় কানায় পূর্ণ করলেও রাজধানীতে ১৯৯৮ বা ১৯৮৮ সালের মতো বন্যার আশঙ্কা নেই। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী ও চিলমারী : নাগেশ্বরীতে বন্যার পানিতে ভেসে আসা মানুষ ও পশুর মৃতদেহের দুর্গন্ধে ভারি হচ্ছে বন্যার্ত এলাকার বাতাস। বন্যায় উজানের পানির ঢলে ভেসে আসে বেশ কিছু মানুষ, শতাধিক গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়ার মৃতদেহ ও অসংখ্য মরা হাঁস-মুরগি। পানি কমতে থাকায় সেগুলো কচুরিপানার সঙ্গে উঁচু জায়গা বা নদীনালার ব্রিজ ও কালভার্টের মুখে আটকে গেছে। কোথাও কোথাও সেগুলো আটকে গেছে জাগ দেয়া পাটের সঙ্গে। শনিবার বামনডাঙ্গার বোয়ালেরডারা ও পাগলীর ব্রিজের মুখে এবং পাটেশ্বরী বিলে কর্কসিটের বাক্সবন্ধি ১টি শিশুসহ ৩টি লাশ দেখা যায়। অর্ধগলিত লাশগুলোর একজনের পরনের পোশাক দেখে মনে হচ্ছিল সেটি মহিলার। ধারণা করা হচ্ছে, মৃতদেহগুলো ভারত থেকে ভেসে এসেছে। পাগলীর ব্রিজের পাশে আটকে থাকা কর্কসিটের যে বাক্সটিতে শিশুর লাশ ছিল সেটির গায়ে হিন্দিতে লেখা কিছু কাগজ সাঁটানো আছে।

এদিকে নাগেশ্বরীতে বন্যায় অর্ধশতাধিক ব্রিজ-কালভার্ট ও প্রায় সবগুলো কাঁচা-পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুক্রবার সন্ধ্যায় নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ীতে বানের পানিতে ডুবে বাবু ইসলাম নামে এক শিশু মারা গেছে। এদিকে পানি কমতে শুরু করায় ভাটির টানে ভাঙছে চিলমারী। এক সপ্তাহে প্রায় ৫শ’ বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদিকে জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামে বন্যায় শুধু কৃষিতে পৌনে ৫শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রংপুর : বন্যায় রংপুর বিভাগের ১০০ কিলোমিটার রেলপথজুড়ে ধ্বংসের ছাপ। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুটি আন্তঃনগর ট্রেনসহ ২২টি ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের পাশাপাশি দেশজুড়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থায় মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের আগে এই রেলপথগুলো সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়, এমনটি জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে ঈদের মৌসুমে যাত্রী ও পণ্য পরবিহন নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়বে এ অঞ্চলের মানুষ। পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ে প্রধান অফিস রাজশাহী সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় রেলপথের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রাম জেলায়। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ না হলেও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শুধু রেললাইনের ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকার ওপর। এদিকে জেলায় ত্রাণ বিতরণ নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্গতদের চাহিদার তুলনায় সিকিভাগ ত্রাণও বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ বিতরণ নিয়ে নাজেহাল অবস্থায় পড়েছেন।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/20/149456