২০ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:২৫

ইসি সংলাপ আয়োজনেই নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই আইন সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সংলাপের আয়োজন করেছে ইসি। ইতোমধ্যে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সংলাপে অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। ইসির পছন্দের লোকদের আমন্ত্রণ দেয়া হয়েছে। সরকারের বিরোধী মতের সাংবাদিকদেরকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনা করছেন অনেকেই। আর ইসির সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়েও দেশের শীর্ষ স্থানীয় সম্পাদকরা আলোচনায় অংশ নেননি। এর আগে সুশীল সমাজেরও উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিরা ইসির আলোচনায় অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছেন।

সূত্রমতে, গত ১৬ জুলাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এ রোডম্যাপে সাতটি করণীয় বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকা পুনঃনির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ। এ সব বিষয়ে সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের আয়োজন করার কথাও রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়। রোডম্যাপ অনুযায়ী গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। সে দিন ৫৯জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের সাথে সংলাপের সময় দেয়া হয়েছিল দুই ঘন্টা। সে দিনের সংলাপে এই অল্প সময় নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। মূলত ইসির সংলাপের মাধ্যমে পরামর্শ নিতে চায় নাকি তা আইওয়াশ ? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। আর উপস্থিতি ছিল অর্ধেক। যার ফলে সম্পাদক ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের নিয়ে সংলাপের জন্য দুই সময় নির্ধারণ করা হয়। প্রথম দিন ১৬ আগস্টের আলোচনায় ৩৭জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আর ১৭ আগস্টের আলোচনায় ৩৪জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

বিশেষ করে সাংবাদিকদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের বিরোধী মতের বহুল প্রচারিত পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানায়নি। এমন কী সাংবাদিক সংগঠনের যেসব নেতৃবৃন্দ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করেন তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অপরদিকে সরকারের মতাদর্শের কোন কোন পত্রিকার একাধিক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যার ফলে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে ইসি তার নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ইসির আমন্ত্রণের তালিকা থেকে জানা যায়, সরকারের বিরোধী মতের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক আমারদেশ এর কোন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অপরদিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শওকত মাহমুদকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অতীতের নির্বাচন কমিশন সংলাপ আয়োজনের ক্ষেত্রে অন্তত সাংবাদিকদের সাথে এ ধরনের আচরণ করেননি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এমন কী জনসংযোগ কর্মকর্তাও এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এটি ইসির সিদ্ধান্ত বলে তিনি এ প্রতিবেদককে অবহিত করেন।

নির্বাচন কমিশনের তিনটি সংলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ তিনটি সংলাপেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপেক্ষিত হয়েছেন। বিষেশ করে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো ক্ষেত্রে বৈষম্য করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময়ও কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আর এ কারণে সরকারের মতাদর্শের সম্পাদকসহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদপত্রের অনেক সম্পাদকরা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ গ্রহণ করেননি।
নির্বাচন কমিশনের উপস্থিতি তালিকা থেকে জানা যায়, প্রথম দিন ১৬ আগস্টে আমন্ত্রণ প্রাপ্ত সম্পাদকদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন না তারা হলেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, আমাদের সময়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, দিনকাল সম্পাদক রিজওয়ান সিদ্দিকী, সকালের খবরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কমলেশ রায়, কলামনিস্ট আবেদ খান, আফসান চৌধুরী, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ বদরুল আহসান।

সেদিন আলোচনার সময় বিএফইউজে মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমের সাথে সংলাপে আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ৪টি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানায়নি। পত্রিকাগুলো হচ্ছে দৈনিক নয়াদিগন্ত, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক আমারদেশ ও দৈনিক সংগ্রাম। এসব পত্রিকা সরকারের অপছন্দের তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া কমিশন বিএফইউজে’র সরকার সমর্থক অংশের সভাপতি ও মহাসচিবকে আমন্ত্রণ জানালেও আমাদের সভাপতি শওকত মাহমুদকে অজানা কারণে আমন্ত্রণ জানাননি। কমিশন কেন এসব পত্রিকার সম্পাদক বা প্রতিনিধি ও বিএফইউজে সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানায়নি তা জানার অধিকার রয়েছে।

এ বিষয়ে শওকত মাহমুদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মাহবুব সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন যে আমন্ত্রণ জানানো হবে। পরে আর জানানো হয়নি। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। তবে আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে। নির্বাচন কমিশন চাইলে এসব বিষয় আমলে নিতে পারে। ‘ইসি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারবে না’ সিইসি’র এ বক্তব্য দু:খ জনক। ইসির অনেক ক্ষমতা রয়েছে। তারা বিধি প্রণয়ন করে নির্বাচন কালীন সময়ের বাইরেও লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরী করার জন্য কাজ করতে পারে।

গত ১৭ আগস্ট টিভি চ্যানেল ও অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সে দিন যারা উপস্থিত ছিলেন না, তারা হলেন: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন, এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা, গাজী টিভির হেড অব নিউজ মেজবাহ আহমেদ, চ্যানেল নাইনের হেড অব নিউজ আমিনুর রশীদ, বৈশাখী টিভির হেড অব নিউজ অশোক চৌধুরী, এবিসি রেডিওর বার্তা প্রধান সানাউল্লাহ আহমেদ এবং বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ।
সেদিনের সংলাপের শুরুতেই একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু নির্বাচন কমিশনের এই আমন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, গতকাল সম্পাদকদের সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমাদের এখানে বাসসের প্রধান সম্পাদকসহ অনেকে সিনিয়র সাংবাদিক রয়েছেন। তাহলে তারা কি সিনিয়র সাংবাদিক না? এ সব বিষয়ে কমিশনের আরও মনোযাগী হওয়া প্রয়োজন ছিল।”

৩১ জুলাইয়ের সুশীল সমাজের সংলাপেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ গ্রহণ করেননি। তারা হলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, আকবর আলী খান, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও মির্জা আজিজুল ইসলাম, সাংবাদিক তোয়াব খান, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, শাহদীন মালিক, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, অধ্যাপক আবুল বারাকাত, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন্সের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল হাফিজ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর এস এম শামসুল আরেফিন, চ্যানেল আই’র শাইখ সিরাজ, বিএসএস চেয়ারম্যান রাহাত খান, এ এইচ এম কাশেম, দৈনিক ইত্তেফাকের তাসমীমা হোসেন।

http://www.dailysangram.com/post/296756