বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরদোর, আসবাব। ছোট্ট ডিঙি নিয়ে বুকপানিতে নেমে ঘরের বেড়া, টিনের চালা তুলে আনছেন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সারডোপের মনসুর আলী।
১৯ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:৪৮

সরেজমিন: কুড়িগ্রাম

ঝড়ের মতো বানের তাণ্ডব

বন্যা ভাসায়, ডোবায়। কিন্তু এতটা বিধ্বস্ত করে দেয় তা চোখে না দেখে বিশ্বাস করা যায় না। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সন্ন্যাসী এবং পাশের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের সারডোপ, বড়লই ও চর বড়লই গ্রামের অবস্থা দেখে মনে হলো, মহাশক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিংবা সিডর-সুনামির মতো কিছু। যারা এই বিপুল ধ্বংসের ভেতর থেকে নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম করছে, সেই মানুষগুলোর কাছেও এখন অকল্পনীয় মনে হচ্ছে ১৩ আগস্টের তাণ্ডব।

ওই দিন সকালে কোনো ঝড়বৃষ্টি ছাড়াই হঠাৎ ধরলা নদী ফুঁসে ওঠে। প্রলয়ংকরী স্রোত হলোখানা ইউনিয়নের বাংটুর ঘাটের পশ্চিম দিকে তিনটি জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে দিয়ে অকল্পনীয় শক্তিতে ছুটতে থাকে। ধরলা অপেক্ষাকৃত ছোট নদী। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তার প্রবাহ প্রবল বৃদ্ধি পায়। ফলে সামনে যা পড়েছেÑপাকা বাড়ি, বাজারের পাকা ছাউনি থেকে আস্ত বাঁশঝাড়, বড় বড় আম-কাঁঠাল-মেহগনি-ইউক্যালিপটাসগাছ, বিদ্যুতের খুঁটি—সব উপড়ে পড়েছে, হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আর টিনের ঘরবাড়িগুলোর অবস্থা দেখে মনে হলো, সেগুলো যেন স্রেফ উড়ে এসে পড়েছে। ডানে-বাঁয়ে, পূর্ব-পশ্চিম যেদিকে তাকানো যায় চোখে পড়ে

দুমড়ে-মুচড়ে পড়া টিনের চালা। গাছের গোড়ায়, বাঁশঝাড়ে, বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে এগুলো আটকে আছে। কাগজের ঠোঙা হাতের মুঠোয় চাপ দিলে যেমন হয়, টিনের বেড়া ও ছাউনিগুলোর অবস্থা ঠিক তেমনই। সারডোপ থেকে ফুলবাড়ী উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের পাকা সড়কটি নয় জায়গায় ভেঙে গেছে। এ ছাড়া কিনার দিয়ে, মাঝ বরাবর ধসে গেছে বহু জায়গায়। গ্রামীণ সড়কের মাঝে মাঝে সেতুগুলোর দুই পাশের মাটি সরে গিয়ে সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। লোকজন এখনো পানিবন্দী।

ফুলবাড়ী উপজেলার চর মেকলি, পশ্চিম ধনিরাম, চর ধনিরাম সাহেব বাজার, চর জ্যোতিন্দ্র নারায়ণ, চর চরচাই, টুংটুংগির চরেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া চর মেকলি ও তার আশপাশের পাট ও ধঞ্চেখেতে ভারত থেকে ভেসে আসা শত শত মরা মুরগি আটকে আছে। এগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা রুহুল আমিন জানান, সম্ভবত ভারতের কোনো মুরগির খামার ভেসে গেছে। এই এলাকার আশপাশে কোনো মুরগির খামার নেই। দ্রুত এসব মরা মুরগি সরিয়ে না ফেললে পরিবেশ মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়বে।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ধরলা নদীর অববাহিকায় গিয়ে দেখা যায়, পানি আর পানি। তবে স্রোতের সেই উন্মত্ততা থেমেছে। পানিও নামছে বেশে দ্রুতই। তলিয়ে যাওয়া পাট-ধঞ্চে, কলার খেত আর বাড়ির আশপাশের ডুবে যাওয়া গাছগাছালি কাদামাখা পাতা নিয়ে জেগে উঠে জানান দিচ্ছে তাদের ডুবে যাওয়ার কষ্টের কথা। পরিবেশ এখন শান্ত-সমাহিত, নিঃশব্দ। ভীষণ ধ্বংসযজ্ঞের পরে যেন প্রকৃতির নীরবতা পালন পর্ব চলছে।

বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের সবচেয়ে বড় অংশের ভাঙন হয়েছে সন্ন্যাসী গ্রামে। বাঁধের পাশেই ছিল বাহাদুর ব্যাপারীর চারটি টিনের ঘর। বাঁধ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সেসব খড়কুটোর মতো স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। তাঁর স্ত্রী অজিমন দুই ছেলে আর ছয়টি গরু নিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বাহাদুর ব্যাপারী বলছিলেন, ‘সব শ্যাষ বাহে। হামার আর এখন কিচ্ছু নাই।’ তিনি কোথাও হাঁটুপানি কোথাও গলাপানিতে গিয়ে গাছগাছালি, খাদের কিনারে আটকে থাকা টিনের টুকরা, জানালা-কপাটের কাঠ কুড়িয়ে এনে রাখছিলেন বাঁধের ওপর। সেখানে বসে কাঁদছিলেন তাঁর স্ত্রী। মোটামুটি সচ্ছলই ছিল তাঁদের পরিবার। এখন আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা পথে বসেছেন।

পুরো ফুলবাড়ী উপজেলাই বন্যাকবলিত। তবে বিধ্বস্ত অবস্থা বড়ভিটা ইউনিয়নেই। কত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, কতগুলো ভেসে গেছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। সারডোপ, বড়লই ও চর বড়লই, কালিরপট—এই চার গ্রামে ট্রলারে করে ঘুরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়েছে। সারডোপে একটি বাজারের পাকা দোকান আর ছাউনি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। গ্রামগুলোর শতাধিক বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। পানি নামতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে ডুবে থাকা ঘরের চালা, দেয়াল, ভাঙা জানালা-কপাট, আসবাব জেগে উঠছে। বড়লই গ্রামে এক বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে আটকে আছে কার যেন ঘরের একটি টিনের চালা। সেই চালার সঙ্গে আটকে গেছে বিরাট এক গাছ। খুঁটিটি কাত হয়ে আছে। আরও খানিকটা সামনে দুটি পাকা ঘর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে পানিতে। পাড়ে দাঁড়ানো লোকেরা বললেন, খালেক-মালেক দুই ভাইয়ের বাড়ি। এখানে আরও চারটি পাকা বাড়ি ছিল। সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ ধরলা নদী এখান থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে। এদিকে কোনো দিন বন্যায় এত পানি আসেনি। এমন ধ্বংস দূরের কথা, মোট ছয়টি পাকা বাড়িসহ এই পাড়ায় মোট ২০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেসে গেছে বলে জানালেন মো. হোসেন, আবু তৈয়ব, আইয়ুবসহ অনেকে।

ছোট্ট এক ডিঙি নিয়ে টিন কুড়াতে বেরিয়েছেন সারডোপের মনসুর আলী। তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রি। নদী, খাল, আর মাঠ এখন কিছুই আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সব ডুবে একাকার। এখনো সেখানে বুকপানি। এর মধ্যেই টিনের টুকরা কুড়াতে কুড়াতে মনসুর বলে গেলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যাতেও তাঁর বাড়িতে পানি ওঠেনি। অথচ এবার তাঁর ও তাঁর ছোট ভাইয়ের পাঁচটি টিনের ঘর ভেসে গেছে। আরও গেছে দুটি বাইসাইকেল, পাঁচ হাজার টাকা, কাজের সব যন্ত্রপাতি, ২০ বস্তা ধান, ৬ মণ চাল। বাড়ির জায়গায় অথই পানি। দুই ভাইয়ের ৫০ শতক জায়গায় বাড়ি আর একটু আবাদ ছিল। সব শেষ। স্ত্রী, মা, ভাই, ছেলেমেয়ে নিয়ে মোট সাতজন পলিথিনের ছাউনির তলায় রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন। সম্বল আর কিছু নেই। তিনি জানালেন, পানির তোড় এত প্রবল বেগে ধেয়ে আসছিল যে, জীবন নিয়ে সরে যাওয়াটাই তখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হয়ে উঠেছিল।

এই গ্রামগুলোতে কিছু কিছু পুরুষ ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁরাই পানিতে নেমে, কেউ নৌকা বা কলাগাছের ভেলা নিয়ে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ির কিছু পাওয়া যায় কি না, খুঁজছেন। চরের মতো খানিকটা জায়গা জেগে উঠছে। সেখানে কাদামাখা একটি টেবিল ফ্যান, একটি প্রেশার কুকার, সংসারের আরও কিছু জিনিসপত্র পানির ভেতর থেকে তুলে এনে রাখছেন এক তরুণ। নাম তার রঞ্জু মিয়া। কাছে গিয়ে কথাবার্তায় জানা গেল, এখানেই ছিল তাঁদের বাড়ি। পেছনে উপড়ে পড়া বাঁশঝাড় আর গাছপালার সঙ্গে কেবল একটি ঘরের চালা আটকে আছে। তাদের মোট ছয়টি ঘর। বাড়িতে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছিল। টেলিভিশন ছিল। রঞ্জু ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজে স্নাতকের শিক্ষার্থী। বাড়ির সবাই কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছে। তাঁরা দুই ভাই দুই দিন ধরে বাড়ির খোঁজ নিচ্ছেন। বললেন, জায়গাটি এখন তাঁর নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। এখানে কোনো নদীই ছিল না। বেশ উঁচু করে মাটি ফেলে তার ওপরে বাড়ি করেছিলেন। পাকা ভিতের ওপরে টিনের দেয়াল। বাড়ির পাশে একটু নিচু জমি। সেখানে তাঁরা রোপা আমন চাষ করেছিলেন। অথচ এখন এখানে গভীর খাদ।

গ্রামের লোকেরা বললেন, ত্রাণ হিসেবে তাঁরা ১০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের কেউ এলাকায় আসেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবেন্দ্র নাথ উঁরাও জানান, তিনি গত বুধবার সারডোপ, বড়লই এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন। তাঁর মনে হয়েছে এখানে সিডর-আইলার মতো ভয়ংকর তাণ্ডব বয়ে গেছে। উপজেলার সব জায়গাতেই ক্ষতি হয়েছে, তবে এখানে সবচেয়ে বেশি। এই এলাকাকে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাটাগরিতে (এ প্লাস) রাখা হয়েছে। একটি বিশেষ ত্রাণ দল কাজ করছে। এখনো সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যায়নি।

 

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1294676