একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসির চলমান সংলাপে সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতার’ ভূমিকা নিতে গণমাধ্যমের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। এ ছাড়াও নির্বাচনের সময় কী ধরনের সরকার থাকবে, সেই ব্যাপারে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। সরকার যে নির্বাচনপদ্ধতি ঠিক করে দেবে সেভাবে ভোট কার্যক্রম সম্পন্ন করবে ইসি- সিইসির এমন মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের দায়িত্ব ইসির। যেভাবে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব সে ব্যবস্থাই করতে হবে ইসিকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তার এ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ ছহুল হোসাইন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সাধারণভাবে যারা রাজনীতি করছেন তারা রাজনীতি করবেন। ওনারা শিডিউল দিয়ে দেবেন এবং পরে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার ক্ষেত্রে যদি কোনো বড় দল বলে আমরা এ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে নির্বাচনে যেতে পারব না। আমি মনে করি, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের একটি উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব রয়েছে। কারণ ওই রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন ইসি দিয়েছে। আমি কিছু জানি না, কিছু করব না বললে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন এগুলো তো শুধু শুধু বলা হবে। কেউ যদি বলে এ ধরনের অবস্থা না হলে নিরপেক্ষতা থাকবে না। এ আশ্বাস মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে যে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে- আপনারা আসেন কিংবা দুই দলের কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব থাকলে তা মধ্যস্থতা করে সমাধান করে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করার উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। এভাবে বলে দিলে হবে না যেখানে দেখা যাচ্ছে যে দলগুলোর সাথে বিরোধ আছে। দলগুলোর নিবন্ধন যেহেতু নির্বাচন কমিশনই দেয়; তাই তাদের পরিচালনার দায়িত্ব তাদেরই। কাজেই সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখন এগুলো কেরানির কথা। তাদের তো নির্বাচন করতে হবে। তাদের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যা যা করা দরকার; সম্ভব সবই তাদের করা উচিত। এখানে আইনে কোনো জায়গায় তাদের বাধা দেয় না। যখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে; তখন তারা ভূমিকা রাখতে পারে। এটি কোনো বিষয় না। কাজের বাইরে, আইনের বাইরে, আমরা কিছু করব না এগুলো ভিন্ন কথাবার্তা। একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য কমিশন যে উদ্যোগই নেই, সেটিই আইন। আইনের বাইরে কিছু না। উচ্চ আদালতের রায়ে তাদের কাজের এখতিয়ারের বিষয়গুলো বলে দেয়া হয়েছে। আসলে সদিচ্ছাটা হচ্ছে বড় কথা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে বক্তব্য দিয়েছেন; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তা সঠিক হয়নি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া সেনাবাহিনী সব নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচনে ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সেনা মোতায়েন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। এ জন্য কমিশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কমিশনের নিজের উচিত সক্রিয় হওয়া। নিকটাতীতে দেখেছি ইসি নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহা দেখিয়েছে, যা সুষ্ঠু নির্বাচন অর্জনে কাজে দেয়নি। এ বিষয় নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য তাদের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি সৎ ও সাহসিকতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে সমান সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তারা যদি নিরপেক্ষভাবে আচরণ করে এবং একটা সমতল ক্ষেত্র যদি প্রস্তুত হয় তাহলে তাদের মধ্যস্থতা দরকার হবে না। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করবে। দলীয় কর্মীদের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার না করে নিরপেক্ষদের দায়িত্ব দেবে। সবার জন্য সমান প্রচারের ব্যবস্থা করবে। এসব পদক্ষেপ নিলে সবাই নির্বাচনে অংশ নেবে। সরকার যেভাবে সাজিয়ে রাখবে সেভাবে নির্বাচন হবে; এ বক্তব্যটি মারাত্মক। এটি সরকারের অধীনস্থ কোনো অর্থব প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বক্তব্য হতে পারে। উপরন্তু নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ডিমান্ড করবে। কিভাবে নির্বাচন করলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে।