১৯ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:২০

ত্রাণের ডাকে সাড়া নেই

ত্রাণের জন্য ছুটছে মানুষ কিন্তু বানভাসি অসহায় মানুষের জন্য আগের মতো সাহায্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় না এখন। অসহায় মানুষের আর্তনাদ যেন আর আগের মতো মানুষের মন স্পর্শ করে না। মানুষের অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ কোথায় যেন আটকা পড়েছে। মনোযোগ যেন অন্য কোথাও, অন্য কিছুতেই যেন বেশি ব্যস্ত মানুষ। তাই অনেকে ফেসবুক, টুইটারে বন্যার ছবি পোস্ট আর লাইক শেয়ার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চাইছেন যেন।

সমগ্র উত্তরাঞ্চল ভাসছে বন্যায়। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি অবর্ণনীয়। আশ্রয় নেয়ার জায়গাও নেই। পানিতে তলিয়ে গেছে স্কুল-কলেজ। তাই অনেকের আশ্রয় হয়েছে ঘরের চালা ও মাচা। তাদের খোঁজ নেয়ার নেই কেউ। অপর দিকে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে সব হারিয়ে উঁচু রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন তারা পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত সহায়তা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। কোথাও তীব্র খাদ্যের সঙ্কট, কোথাও খাবার পানির। কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে পেটের পীড়াসহ নানা রোগব্যাধি। পানিতে ডুবে মরছে ছোট ছোট অনেক শিশু।

বন্যায় হাটবাজার, ফসলের মাঠ সব ডুবে যাওয়ায় অনেক এলাকায় মানুষ টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন না। তাদের প্রয়োজন তৈরি খাবার। কিন্তু তা পাচ্ছেন না তারা। বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণের জন্য অসহায় মানুষের ছোটাছুটি, বুক সমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার করুণ দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। ত্রাণ সঙ্কটের প্রতিবেদনও তুলে ধরা হচ্ছে কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না আশানুরূপ। মানুষ আগের মতো বিপন্নদের জন্য ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না। ৭০-৮০ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু ও অসহায় নারীরা অপেক্ষায় রয়েছেন ত্রাণের জন্য। কিন্তু তাদের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না।

অথচ ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যায় বানভাসিদের জন্য সব শ্রেণীর মানুষের সাহায্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এ সময় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ, খাদ্য তৈরি, ত্রাণ বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লাখ লাখ মানুষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সংস্থার অফিস, মেস, বাসাবাড়িতে ছাত্রছাত্রী, স্বেচ্ছাসেবী, সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দুর্যোগকালে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় দল বেঁধে ত্রাণ প্রস্তুতের কাজ করেছে অতীতে। কিন্তু এখন সে ধরনের কোনো দৃষ্টান্ত চোখে পড়ছে না অনেক দিন ধরে। যেন হারিয়ে গেছে মানুষের জন্য ত্যাগের সেই সংস্কৃতি। যদিও ২০০৪ সালের পর দেশে বড় মাপের বন্যা হয়নি কিন্তু মাঝারি আকারের বন্যা এবং সিডর, আইলার মতো প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাতে আগের মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সাড়া পড়েনি। বিভিন্ন দল ও সংগঠন এখন যেন দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। কোনো কোনো দল সবার প্রতি ত্রাণ বিতরণের আহ্বান জানিয়েই দায়িত্ব সারে। দলের নেতাকর্মীদেরও আগের মতো অসহায় মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় না। অনেকে যত না সাহায্য করেন তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তা প্রচার আর প্রদর্শনে। দশটা শাড়ি বিতরণের জন্যও টেবিল সাজিয়ে তার সামনে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় অসহায় মহিলাদের। উদ্দেশ্য একটাই, ছবি তোলা আর ফেসবুকে সেসব ছবি পোস্ট করা। প্রচার আর প্রদর্শনের ব্যাধি যেন পেয়ে বসেছে আমাদের।

পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যেও এখন পর্যন্ত বন্যা মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। বন্যার্তদের সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান লক্ষ করা যাচ্ছে না। এক দিকে ত্রাণের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের সঙ্কট অপর দিকে সমন্বয়হীনতা এবং জোরালো উদ্যোগের অভাব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এবার দেশ ১৯৮৮ সালের মতো বড় ধরনের বন্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দু’টি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যে পরিমাণ পানি জমা হয়েছে তা গত ১০০ বছরে হয়নি। তিস্তা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি গত ৯৮ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আর গঙ্গা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি ৭৫ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশের উজানে ভারত ও চীনে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তিস্তার বিস্তীর্ণ অববাহিকায় বিপুল বৃষ্টির পানি প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এখন এ পানি ধেয়ে আসতে শুরু করেছে মধ্যাঞ্চলের দিকে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত বন্যায় ৩৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেক মানুষকে সরকারি সহায়তা দেয়ার সামর্থ্য রয়েছে।

হাওরে ফসলহানির পর থেকে দেশে চাল সঙ্কট শুরু হয়েছে। অনেক চেষ্টার পর এ পর্যন্ত মাত্র ৫৭ হাজার টন চাল আমদানি করতে পেরেছে সরকার। গুদামে মজুদ আছে দুই লাখ টনের কিছু বেশি চাল। সারা বছর চলমান দুস্থদের সহায়তার বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে বন্যার্তদের সহায়তার জন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে যেভাবে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে তাতে বন্যা ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য সরকার কোথা থেকে চালের ব্যবস্থা করবে সেটাই এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও স্বীকার করেছেন বন্যায় কিছুটা হলেও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্যায় শুধু যে ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে তা নয় বরং মানুষের ঘর, বাজারের দোকান ও গুদামে মজুদ বিভিন্ন ধরনের শস্যও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। হাওরে ফসলহানির পর চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে বন্যার কারণে কম বেশি সঙ্কটে পড়েছে সারা দেশের মানুষ।

‘ভোক সহ্য হয় না, মোর জন্যে একনা খাবারের ব্যবস্থা করি দ্যাও।’ এভাবেই নিজের আকুতি প্রকাশ করলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা ছবিরণ। বন্যার কারণে ছয় দিন ধরে পাকা রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ছবিরণের মতো ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন কুড়িগ্রামের পাঁচগাছী ইউনিয়নের ঝাকুয়া পাড়ার ৭নং ওয়ার্ডের যাত্রাপুরগামী রাস্তায় আশ্রয় নেয়া আরো অনেকে। ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাস্তার পাশে আশ্রয় নেয়া বানেছা নামে এক বানভাসী। তার প্রশ্ন, ‘হামার কি এক মুঠও হক নাই! পাঁচ-ছয় দিন ধরি রাস্তাত পড়ি আছি, মেম্বার-চেয়ারম্যান কি হামাক (আমাকে) দেখে না?’

অনেকে কিছু চাল পেয়েছেন অনেকে তাও পাননি। চাল পাওয়া এক মহিলা বলেন, ‘খালি চাউল দিয়া কি করমো? আলুর কেজি ৩০ ট্যাকা, আলুভর্তা করিও ভাত খাবার পাই না।’

অপর দিকে টাঙ্গাইল ভুঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামে ঘরের চালে আশ্রয় নেয়া কৃষক আবদুল লতিফ ও তার পরিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্যার মঙ্গলবার থেকে না খাওয়া। শুকনো খাবার চিঁড়া মুড়ি যা ছিল সব শেষ। বেঁচে থাকার জন্য বন্যার পানি খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। আর পারছি না। আমরা ত্রাণ চাই না। একটু খাবার পানির ব্যবস্থা করে দেন। কোনোরকম জীবনটা বাঁচিয়ে রাখি। একটু দয়া করেন।’

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘরের চালার ওপর আশ্রয় নেয়া লতিফের পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবারের আর্তনাদ শোনার মতো কেউ নেই। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি তারা। এগিয়ে আসেনি কোনো বেসরকারি সংস্থাও। বন্যার পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ঘরের মধ্যে উচু বাঁশের মাচান পেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, অন্যের উঁচু জমি ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এদের বেশির ভাগই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কোনো ভালো গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করালেই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছে গাড়ির কাছে। কিন্তু ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের সারা ২৭ জেলার শতাধিক উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যাকবলিত উত্তরাঞ্চলের সব জেলায় ত্রাণের জন্য হাহাকার। বন্যার পানি এখন গড়াতে শুরু করেছে মধ্যাঞ্চলের দিকে।

জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ফুলকুচা ইউনিয়নের দিলালেরপাড় গ্রামে বন্যাকবলিত সুবেদা সাংবাদিকদের জানান, শোবার ঘরেও বুকপানি। ডুবে গেছে খাট-সিন্দুক সবই। আশপাশে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই ঘরেই মাচা বেঁধে থাকছেন সুবেদা বেগম। কয়েক দিন ধরে এভাবে দিন কাটালেও তাদের দেখতে আসেননি কেউই।

সুবেদার মতোই অবস্থা এ গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দার। এখানকার প্রায় সব স্কুল ভবনের মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়েরও কোনো ব্যবস্থা নেই।

সুবেদা বলেন, বন্যায় তাদের সব ভেসে গেছে। ঘর ভেঙে গেছে। ক্ষুধায় পোলাপান কানছে। কোথাও শুকনো জায়গা নেই। কলাগাছের ভেলায় চুলা বসিয়ে আলু সেদ্ধ করে খাচ্ছেন তারা।

বন্যার কারণে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং হাটবাজার তলিয়ে যাওয়ায় অনেক এলাকায় টাকা দিয়েও খাবার পাচ্ছে না অনেকে। অনেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেকের খোঁজখবরও নেয়া হচ্ছে না।

এ দিকে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। রংপুরের বদরগঞ্জে ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করেছে শত শত নারী-পুরুষ।

সরকারি হিসাব মতে বন্যায় এ পর্যন্ত এক লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এক হাজার ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে চার লাখ ১১ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত বন্যাকবলিতদের জন্য চার হাজার ৪৫০ টন চাল এবং পৌনে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/245308