১৯ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৭

আমরা যখন মাতি...

বাংলাদেশের মানুষের ‘ঝোঁকে’ চলা সম্পর্কিত প্রবাদের মতো কথাটা সম্ভবত পাঠকরাও শুনেছেন। এর মূল কথায় বলা হয়েছে, কোনো বিষয় নিয়ে আমরা যখন ‘মাতি’ বা মেতে উঠি তখন আর সবকিছু ভুলে যাই। সাম্প্রতিক সময়েও ব্যতিক্রম হয়নি। ১ আগস্টের পর থেকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে সেই যে ‘মাতামাতি’ শুরু হয়েছে তার আর শেষ হওয়ার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে দন্ডিত মন্ত্রী থেকে নিন্দিত সাবেক প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত হেন কারো নাম বলা যাবে না, যিনি ওই রায় নিয়ে ‘মেতে’ না উঠেছেন। ৭৯৯ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ রায় কতজন পড়েছেন তা নিয়েও সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যারা তুলেছেন তারা বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ, কেবলই ক্ষমতাসীনদের আক্রমণ করতে ব্যস্ত বিএনপির নেতারা লক্ষ্যই করেননি যে, রায়টির পর্যবেক্ষণে দুটি সামরিক শাসনের কঠোর সমালোচনা করেছেন মাননীয় বিচারপতিরা। এতে স্বাভাবিকভাবেই নিন্দার মুখে পড়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান- বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি। কঠোর ভাষায় তীব্র সমালোচনা করলেও রায়ে কিন্তু এই সত্যটুকু তুলে ধরা হয়নি যে, মাননীয় বিচারপতিরা যে চতুর্থ সংশোধনী ও বাকশালের বিরুদ্ধে বলেছেন, জিয়াউর রহমান সে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্পিকারের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠের বিধানটিও যে জিয়াউর রহমানই করে গেছেন তার জন্যও রায়ে কোনো প্রশংসা নেই।

অর্থাৎ কোনো কারণেই জিয়াউর রহমান প্রশংসিত হননি, কিন্তু নিন্দিত হয়েছেন সামরিক শাসনের জন্য। অথচ জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সংঘটিত অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে। সামরিক শাসনও তিনি জারি করেননি, করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। এসব তথ্যেরও উল্লেখ নেই আলোচ্য রায়টিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিএনপির নেতারা মাতামাতিতেই ব্যস্ত রয়েছেন। কারণ, সাধারণভাবে প্রচারণা রয়েছে যে, রায়টিতে নাকি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনদের ‘ধোয়ামোছা’ করা হয়েছে! এতেই একেবারে নেচে উঠেছেন বিএনপির নেতারা। তাদের নৃত্য এখনো চলছেই! তারা এমনকি জনগণের অন্য কোনো সমস্যা নিয়েও কিছু বলছেন না। নানামুখি সমস্যার প্রচন্ড চাপে জনগণের যে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়েছে সে ব্যাপারেও মাথাব্যথা নেই বিএনপির নেতাদের!

এমন এক পরিস্থিতি দেখেই ব্যাঙের একটি গল্প মনে করিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। গল্পটি এরকম: একটি ব্যাঙকে পানি ভর্তি হাড়িতে রেখে জ্বলন্ত চুলায় বসানো হয়েছে। আগুনের তাপ অনুভব করলেও ব্যাঙটি প্রথম সুযোগেই লাফ দেয়নি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেনি। তেমন চেষ্টাই করেনি। ওদিকে তাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যাঙ লাফিয়ে বাইরে আসার চেষ্টা করার পরিবর্তে বেড়ে চলা তাপ সহ্য করছে। নিজের সহ্য ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর পানি এত বেশি উত্তপ্ত হয়ে পড়লো যে, ব্যাঙের পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না। ব্যাঙ এবার লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পারলো না। ফলে জীবন্ত একটি ব্যাঙ ‘সেদ্ধ’ হয়ে গেলো। তার মৃত্যুও ঘটলো।

গল্পের সারমর্ম বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা পরিমাণ পর্যন্ত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছিল ওই ব্যাঙটির। কিন্তু ব্যাঙ ভেবেছিল, সে হয়তো আরো বেশি তাপ সহ্য করতে পারবে। এই ভুল ধারণার শিকার হয়ে লাফিয়ে বাইরে আসার মতো শক্তি থাকতে থাকতে লাফ দেয়ার পরিবর্তে সে শুধু তাপই সহ্য করতে গেছে। ওদিকে আরো বেশি তাপ সহ্য করতে গিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে নিজের সব শক্তি খুইয়ে ফেলেছে ব্যাঙটি। সে কারণে যখন সে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আর তার কোনো শক্তিই অবশিষ্ট থাকেনি। মারা তো গেছেই, মরেছেও একেবারে ‘সেদ্ধ’ হয়ে!

ব্যাঙের গল্পটি যারা শুনিয়েছেন তারা এ থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য পরামর্শও দিয়েছেন। এই পরামর্শ বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে। হঠাৎ শুনলে বেসুরো, এমনকি অপ্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই জানা যাবে, ব্যাঙ সম্পর্কিত গল্পের আড়ালে এককালে ‘সংগ্রামী’ হিসেবে সঠিকভাবে পরিচিত এদেশের জনগণকে সময় ও শক্তি থাকতেই ঘুরে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। গল্পটি যারা শুনিয়েছেন তারা আরো বলেছেন, না হলে এমন সময় আসতে পারে, যখন জনগণ চেষ্টা করলেও আর ঘুরে দাঁড়াতে অর্থাৎ প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। ততোদিনে শক্তি ফুরিয়ে যাবে তাদের। আর পরিণতি হবে ঠিক ওই ‘সেদ্ধ’ হয়ে যাওয়া ব্যাঙের মতো।

কথাটা যে একেবারে অযৌক্তিক নয় সে বিষয়ে ধারণা পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হয়ে পড়া বর্তমান বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। কত তথ্য, উদাহরণ ও ঘটনার কথা জানতে চান আপনি? মাস দু’-আড়াই আগে চিকুনগুনিয়া জ্বর যখন রাজধানীতে মহামারির আকার নিয়েছিল, বিপন্ন রাজধানীবাসী যখন চিকিৎসা ও সাহায্যের জন্য সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনের দিকে অনেক আশায় তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল, তেমন এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেও ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলে বসেছিলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারা বা নির্মূল করা তার পক্ষে ‘সম্ভব নয়’! সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কারণ, মেয়র সাহেবকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারার জন্য অনুরোধ জানানো হয়নি। দাবি জানানো হয়েছিল প্রতিটি এলাকায় ওষুধ ছিটিয়ে মশা নির্মূল এবং মশার বিস্তার রোধ করার জন্যÑ যেটা তার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার এবং ‘সম্ভব নয়’ ধরনের কথার মাধ্যমে মানুষের চরম দুঃসময়েও রীতিমতো ব্যঙ্গ-তামাশা করেছিলেন মেয়র আনিসুল হক। কথার খেসারত অবশ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দিতে হয়েছিল। তাকে দিয়ে মাফ চাইয়ে ছেড়েছিল রাজধানীবাসী। মাফ চাওয়ার জন্য তিনি এমনকি বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে পর্যন্ত ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন!

এই একটি ঘটনায় রাজধানীবাসী গল্পের ব্যাঙ না হয়ে অতীতের ‘সংগ্রামী’ পরিচিতির প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। সরকারের হাজার ধরনের অন্যায়, নির্যাতন এমনকি গুম-খুনের মতো ভয়ংকর অপকর্মের বিরুদ্ধেও জনগণকে সামান্য প্রতিবাদ জানাতে দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে যাদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা সেসব দলের প্রধান দলটি ব্যস্ত রয়েছে কেবলই সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার জন্য। কোথায় ‘ফেলে’ দেয়া হবে সেকথাও জানিয়ে দিয়েছেন এর কোনো কোনো নেতা। বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে সরকারকে বঙ্গোপসাগরে ‘ফেলে’ দেবেন তারা। ক্ষমতাসীনরা নাকি পালানোরও পথ পাবেন না!

ভালো কথা। সরকারের পতন ঘটলে কিংবা সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়া হলে জনগণ খুশি হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের পতন ঘটানোই কোনো রাজনৈতিক দলের একমাত্র এজেন্ডা হতে পারে কি না? বিরোধী যে কোনো দলের প্রধান দায়িত্ব তো জনগণের পাশে দাঁড়ানো, বিশেষ করে তাদের দুঃসময়ে। অন্যদিকে আমাদের প্রধান বিরোধী দল সেই যে সরকারের পতন ঘটানোর কাজে নেমে আছে, প্রায় আট বছরেও সে কাজের শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা একদিকে জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলকে মামলা, গ্রেফতার ও ধাওয়ার মুখে রেখেছেন, অন্যদিকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন নিজেদের বিভিন্ন পরিকল্পনা। শত শত, হাজার হাজার কোটির অংকে টাকা লুণ্ঠন করছে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। এদিকে পণ্যের দ্রুত বেড়ে চলা মূল্য থেকে আয় কমে যাওয়া, চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ না পাওয়া এবং যখন-তখন নির্যাতনের শিকার হওয়া পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অসুখে চিকিৎসা পাচ্ছে না তারা। তাদের স্ত্রী-কন্যারা তো বটেই, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এমনকি ২২ মাসের শিশুও। কিন্তু একমাত্র সংবাদ সম্মেলন করা ও বিবৃতি দেয়া ছাড়া কিছুই করছে না প্রধান বিরোধী দল। করবেই বা কিভাবে? দলটির নেতারা তো সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ারÑ তাও আবার বঙ্গোপসাগরে ‘ফেলে’ দেয়ার দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করতে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন! এর মধ্যে আবার এসে গেছে ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়টি!

পাঠকদের মধ্যে যারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তাদের উদ্দেশে বলি, এদেশেরই ইতিহাস স্মরণ করে দেখুন। ১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘লৌহ মানব’ আইয়ুব খানের পতন ঘটানো থেকে ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা পর্যন্ত সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক দল এবং কয়েকটি দলের জোট। দলগুলোর আহবানে যথা সময়ে রাজপথে নেমে এসেছে ছাত্র-জনতা। ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। আর ছাত্র-জনতা ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র পতন ঘটেছে ‘নাম করা’ এবং দুর্দান্ত ক্ষমতাধর সব শাসক ও তাদের সরকারের। গুম ও গুপ্তহত্যার মতো পৈশাচিক কর্মকান্ড না থাকলেও তখনও কিন্তু মামলা, গ্রেফতার আর দমন-নির্যাতন যথেষ্টই ছিল। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা সে সবের তোয়াক্কা যেমন করেননি তেমনি কথায় কথায় সরকারকে ফেলে দেয়ার নামে কোনো সরকারের জন্য রাস্তাও মসৃণ করে দেননি।

কথাগুলো এমনি এমনি বলা হচ্ছে না। একজন মেয়র আনিসুল হক কেবল নন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও তো যথেষ্টই শুনিয়ে চলেছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে লক্ষ-হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়ার, ‘রাবিশ’ ধরনের গালাগাল করার এবং বছর শেষে ব্যর্থতার নজীর স্থাপনের জন্য ‘বিখ্যাত’ হয়ে ওঠা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নাম অবশ্যই সবার আগে বলতে হবে। ওদিকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে তাদের অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সমম্বয়হীন ও অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের কারণে মাত্র দু’-চারদিনের বৃষ্টিতেই রাজধানী যখন স্থবির, অচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল, তখনও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুকুমের সুরে দিব্বি বলে বেড়িয়েছেন, জনগণকে ‘সাময়িক’ এই অসুবিধা মেনে নিতেই হবে। শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘এটুকু’ অসুবিধার জন্য উন্নয়নের মহা কর্মকান্ড বন্ধ করা ‘সম্ভব নয়’!

লক্ষণীয় যে, জনগণ কিন্তু উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে ঘুষের লেনদেনসহ ‘নগদ নারায়ণ’ আমদানির পথ বন্ধ করার দাবি জানায়নি। নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বরং সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এমনভাবে খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব না ঘটে এবং মানুষকে যাতে মাসের পর মাস ধরে ভোগান্তির শিকার না হতে হয়। অন্যদিকে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুধু ‘এটুকু অসুবিধা’ এবং ‘সম্ভব নয়’ বলেই থেমে পড়েননি, সর্বশেষ উপলক্ষে গত ২ আগস্ট তিনি উত্তরা এলাকায় মেট্রোরেলের আরো একটি নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। বলা দরকার, প্রায় তিন-চার বছর ধরে চলমান মেট্রোরেলের একটি প্রকল্পের কারণে আগারগাঁও থেকে বৃহত্তর মিরপুর ও পল্লবী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সে প্রকল্প শেষ না করেই সরকার এবার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এমন এক প্রকল্প শুরু করলো, যে প্রকল্পটি শেষ হতে কত বছর সময় লাগবে তা সম্ভবত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও জানেন না। সেটা জানার দরকারও নেই তাদের। কারণ, প্রধান প্রশ্ন এখানে উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে ‘নগদ নারায়ণ’-এর আমদানি নিশ্চিত করা- অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘হরিলুটের’ ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, সরকারের নেয়া অনেক প্রকল্পের ব্যর্থতা ও অশুভ পরিণতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিস্টার মুহিত মাঝে-মধ্যেই ‘হরিলুট’ কথাটা ব্যবহার করে থাকেন।

এভাবেই ‘সম্ভব নয়’ থেকে ‘এটুকু’ এবং ‘হরিলুট’ পর্যন্ত নানা বাহারী কথার পাহাড় জমিয়ে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রশ্নসাপেক্ষ নীরবতার কারণে অসহায় জনগণের অবস্থা কতটা শোচনীয় হয়ে পড়েছে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য মাত্র দিন কয়েক আগের বিরামহীন বর্ষণের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আষাঢ়ের পর এবার শ্রাবণেও শুরু হয়েছিল টানা বর্ষণ। বৃষ্টির কারণে শুধু নয়, বন্যার পানিতেও তলিয়ে গেছে সারাদেশ। এমন কোনো জেলার কথা বলা যাবে না, যে জেলার গ্রামাঞ্চল পানির নিচে চলে না গেছে। রাজধানী ঢাকা তো অচল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলই, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ অন্য সব শহর ও মহানগরীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভয়ানকভাবে। কোথাও কোথাও মানুষকে গলা সমান পানি ভেঙে এবং জীবন বিপন্ন করে চলাচল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ শহরের পানিই সহজে সরে যেতে পারেনি।

কারণ সম্পর্কিত আলোচনায় স্বাভাবিক কারণেই রাজধানী ঢাকাকে এক নম্বরে রাখা হয়েছিল। এখনো বলা হচ্ছে, দুই সিটি করপোরেশন এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন খোঁড়াখুড়ি ও নির্মাণ কাজের কারণে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলি-গলি ও মহল্লা পর্যন্ত প্রতিটি এলাকায় প্রচন্ড পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও বা কোমর পর্যন্ত পানি জমেছিল। ওদিকে কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে রাজধানীর কোনো এলাকার সড়ক দিয়েই কোনো ধরনের যানবাহন নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারেনি। অনেক এলাকায় কোনো যানবাহন ঢোকানো পর্যন্ত পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার তো বটেই, যাত্রীবাহী বাসও অচল হয়ে পড়েছে যেখানে-সেখানে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো দৈনিকে রাজধানীর সড়কগুলোকে গাড়ির গ্যারেজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ সড়কেই শত শত গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। এর ওপর ছিল যানবাহনের তীব্র সংকট। মানুষকে গাড়ির জন্য কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এই একটি বিষয়ে স্কুলগামী শিশু-কিশোর থেকে অফিসগামী চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী পর্যন্ত প্রত্যেকেই সমান তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে। ওই দিনগুলোতে গুরুতর অসুস্থদেরও হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। সড়কে অ্যাম্বুলেসও চলাচল করতে পারেনি।

এভাবে সব মিলিয়েই মাত্র কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে ও পানিজটে রাজধানী ঢাকা মহানগরী আসলে অচল হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, মেট্রোরেল প্রকল্প, ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশন, তিতাস ও বিটিসিএলসহ কয়েকটি সংস্থা বছরের পর বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুড়ি ও নিত্য নতুন সড়ক ও ড্রেন ধরনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এক সংস্থা কোনো এলাকায় কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পরপর অন্য কোনো সংস্থা আবার একই এলাকায় তাদের মতো করে খোঁড়াখুড়ি ও নির্মাণ কাজ শুরু করে দেয়। এ প্রসঙ্গে একাধিক ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল প্রকল্প এসেছে প্রধান উদাহরণ হিসেবে। সবই চলছে কয়েক বছর ধরে। ফলে মানুষের ভোগান্তিরও অবসান ঘটছে না। স্বল্পকালের মধ্যে অবসান ঘটারও কোনো সম্ভাবনা নেই।

ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার এই দেশে মাত্র কয়েকদিনের বৃষ্টিতেই পুরো রাজধানী তলিয়ে যাবে, অচল হয়ে পড়বে এবং মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির শেষ থাকবে না- এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছে বলেই উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা একথা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাজধানী হিসেবে ঢাকা একটি ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ অশুভ পরিণতি বরণ করতে চলেছে। এমন আশংকা নিঃসন্দেহে ভীতিকর। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের অন্তত কিছুই করার নেই। কারণ, তারা অনেক আশায় তাকিয়ে আছে সেই রাজনৈতিক দলের দিকে, যে দলটি কেবলই সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার পন্থা এবং দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মহাকম্মে ব্যস্ত রয়েছে। এমন অবস্থার কারণেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে ‘সুদর্শন’ মেয়ররা পর্যন্ত ‘সম্ভব নয়’ শোনানোর এবং ধমক ও হুকুম দেয়ার সাহস দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে বেশি উদ্বিগ্ন ও ভীত-সন্ত্রস্তরা জনগণকে ‘সেদ্ধ’ হয়ে মারা যাওয়া ব্যাঙের গল্প না শুনিয়ে পারছেন না। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিষয়টি আদৌ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো কি না, নাকি গল্পের ওই ব্যাঙের করুণ ও অশুভ পরিণতি বরণ করা থেকে জনগণকে রক্ষা করার কোনো সুচিন্তিত পরিকল্পনা করা এবং সে অনুয়ায়ী সৎসাহসের সঙ্গে ‘সংগ্রামী’ উদ্যোগ নেয়া দরকারÑ সে কথা চিন্তা করার সময়ও কিন্তু দ্রুতই পেরিয়ে যাচ্ছে!

http://www.dailysangram.com/post/296662