১৮ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৬

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আন্তর্জাতিক তাগাদা বাড়ছে

সব দলের অংশগ্রহণে ভীতিমুক্ত পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু একাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এ নিয়ে কোনো না কোনো বিদেশি কূটনীতিক, বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগী কথা বলছেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ এবং স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ-বৈঠক বা মতবিনিময়ে জোরালোভাবে বিষয়টি আসছে। কূটনৈতিক পল্লীর দৈনন্দিন কর্মসূচি, ডিপ্লোমেটিক পার্টি কিংবা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিচ্ছেন বিদেশিরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে মুখ খুলেছেন। জাতিসংঘ, ইইউসহ বৈশ্বিক সংস্থা-সংগঠনের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশায় তাতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আগাম অঙ্গীকার ব্যক্ত করে চলেছেন। নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশিদের এসব তৎপরতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তার মতে, এটি কাঙিক্ষত, প্রত্যাশিত। উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিদেশিরাও বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন দেখতে চান। এজন্য তারা তাদের আকাঙক্ষা ব্যক্ত করছেন। ’৯৬-র ১৫ই ফেব্রুয়ারী বা ’১৪-র ৫ই জানুয়ারির মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কেউই চায় না মন্তব্য করে তিনি সমপ্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাই বলেছেন। সুতরাং এটি এখন কেবল বিদেশিদের চাওয়া নয়, সবার চাওয়া। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হলেও ওই নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল তা মানছেন সবাই। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। সেই নির্বাচনের ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। সংঘাতময় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। আগামী নির্বাচনটি সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আয়োজনে জোর তাগিদ দিচ্ছে ইইউ। ’১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে সব দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ঢাকায় দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী ইইউ দূত পিয়েরে মায়েদুন। ইইউ’র বৈশ্বিক এজেন্ডা হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করে যাবে জানিয়ে তিনি এ-ও আশা করেছেন যে তাদের আহ্বানে বাংলাদেশ সাড়া দেবে। পরবর্তী নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে এমন ধারণায় ইইউ তা পর্যবেক্ষণে আগাম পর্যবেক্ষক টিম পাঠানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে তারা সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছে। ইইউ সূত্র বলছে, মোট ৪টি ধাপে তারা পরবর্তী নির্বাচনটি পর্যবেক্ষণ করতে চায়। প্রথমত: নির্বাচন নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের মনোভাব, দলগুলোর প্রাথমিক প্রস্তুতি এবং ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত: নির্বাচন-পূর্ব মাসগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তৃতীয়ত: নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি, চতুর্থ এবং সর্বশেষ নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি। ইইউ’র পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা সেরেছেন ২৮ রাষ্ট্রের এ জোটের ঢাকাস্থ প্রতিনিধিরা। সর্বশেষ বিদায়ী ইইউ দূত পিয়েরে মায়েদুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে তাদের পরিকল্পনা ও প্রস্তাবের বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য পর্যবেক্ষক পাঠানো সংক্রান্ত ইইউ’র প্রস্তাবকে তাৎক্ষণিক স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সরকারপ্রধান ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নে ইইউ’র বিভিন্ন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এদিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মনোভাব বুঝতে জাতিসংঘের নির্বাচন বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল গত জুলাইতে ঢাকা সফর করেছে। তারা আগামী নির্বাচনের পরিবেশ এবং ভোট কার্যক্রমে জাতিসংঘের সহায়তা বিষয়ে আলোচনা করে গেছেন। ঢাকায় সিরিজ বৈঠকে জাতিসংঘ টিম মূলত আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে? কোন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনটি হতে পারে এবং তা অংশগ্রহণমূলক হলে এতে জাতিসংঘ কি সহায়তা দিতে পারে? তা জানা-বুঝার চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স কার্যালয়ের পাবলিক আউটরিচ অ্যাডভাইজার সভেতলানা গালকিনার নেতৃত্বাধীন টিমে ওই কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ দু’জন কর্মকর্তা লাস জোসেফালফোনস ডি গিয়ার ও ইয়াও ইভরাড কুয়াডিও ছিলেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্সও গত কয়েক মাসে ঢাকায় বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি জাতিংঘের আকাঙক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তার মতে, আগামী নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রও বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। নিউ ইয়র্কে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র স্টিফান দুজারিক সমপ্রতি বলেন, জাতিসংঘের অবস্থানে কোনো হের ফের নেই। আমরা সব সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আহ্বান জানাই। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতও প্রায় অভিন্ন ভাষাতেই আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙক্ষার বিষয়টি জানিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠকে সমপ্রতি রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভয়হীন, শংকামুক্ত এবং সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেখতে চায়। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সিইসি’র সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে ঢাকাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ঢাকাস্থ ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র সচিব এম. শহীদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করি। আমি নিশ্চিত, অন্য গণতন্ত্রের মতো এখানেও তেমনটি হবে। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় কি-না ভারত? এমন প্রশ্নে শ্রিংলা বলেন, ‘গণতন্ত্র মানে অংশগ্রহণ। আমি নিশ্চিত নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে। যদি কেউ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থাকতে চায় তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অংশ না নিলে সে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় থাকবে না।’ ওদিকে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন। গত সপ্তাহে ঢাকা সফরকারী বৃটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ প্রতিমন্ত্রীও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তার বিদায়ী বার্তায়ও এর উল্লেখ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশনার বেনওয়া পিয়েরে লারামিও সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কানাডা দূতের বিদায়ী বৈঠকে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বলেন, কানাডা সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ সময় স্বচ্ছ ভোটবাক্স চালুসহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উদ্যোগ ও অবদানের কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বছরের শুরু থেকেই তৎপর রয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। তারা এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সাড়া না পেয়ে এখন তারা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলছেন। সেখানে একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশন বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আহ্বানই জানাচ্ছেন বিদেশী বন্ধুরা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=79317