স্ত্রী মাহমুদা আকতারসহ রফিকুল ইসলাম ১৫ দিন ধরে হজ ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করছেন
১৮ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ৮:০২

হজ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ভোগান্তি রেকর্ড ভেঙেছে

আরো দু’টি হজ ফাইট বাতিল

চলতি বছর হজ ব্যবস্থাপনায় পদে পদে অনিয়ম ও ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাক-নিবন্ধন থেকে শুরু হয়ে ফাইট পর্যন্ত ভোগান্তির এ চিত্র অব্যাহত রয়েছে, যা বিগত কয়েক বছরের অনিয়ম-ভোগান্তির সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হাজী ও হজ এজেন্সি সবাইকেই এ ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।

প্রাক-নিবন্ধন : এ বছরের পবিত্র হজ নিয়ে শুরু থেকেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রাক-নিবন্ধন দিয়ে এ জটিলতা শুরু হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রাক-নিবন্ধন করতে গিয়ে অনেকেই আগে টাকা জমা দিয়েও সিরিয়ালে অনেক পেছনে পড়ে যান। এ কারণে তারা মূল নিবন্ধন করতে না পারায় এ বছর হজে যেতে পারছেন না। এ জন্য ১১৬২টি বেসরকারি এজেন্সি থাকলেও এ বছর মাত্র ৬৩৫ এজেন্সির অধীনে হজযাত্রীরা সৌদি আরব যাচ্ছেন। বাকিরা কোটাবঞ্চিত হয়েছেন। শতাধিক এজেন্সি কোনো হজযাত্রীর নিবন্ধন করাতে পারেনি। কোটাবঞ্চিত হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠনের আহবায়ক মাহফুজ বিন সিরাজ নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাক-নিবন্ধনের সময় অনেক অনিয়ম করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৫০ জনের টাকা জমার রসিদ একবারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিলেও কিছু এজেন্সি তা মানেনি। কিন্তু তাদের শাস্তি না দিয়ে বরং পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর হঠাৎ করে এক ঘণ্টা সময় বাড়ানো হয়েছে। এতে আগেই জানা থাকা হাব সংশ্লিষ্টরা ব্যাংককে ব্যবহার করে সুবিধা নিয়েছেন। অন্যরা জানতে না পারায় বঞ্চিত হয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে যোগসাজশ করে অনেকে টাকা জমা দিয়ে সাথে সাথেই সিরিয়াল পেয়েছেন। আর অনেকে সকালে টাকা জমা দিয়েও সিরিয়াল পেয়েছেন সন্ধ্যায়। এতে তারা সিরিয়ালের অনেকে পেছনে পড়ে গেছেন। এ কারণে তাদের হজযাত্রীরা এ বছর হজে যেতে পারছেন না।

ই-ভিসা পদ্ধতি : গত ২৪ জুলাই থেকে এ বছরের হজ ফাইট শুরু হয়েছে। এর পর থেকে নানা জটিলতা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি সরকার এ বছরই প্রথম ই-ভিসা পদ্ধতি চালু করায় ভোগান্তিতে পড়েন হজযাত্রী ও এজেন্সি মালিকেরা। সৌদি ই-হজের সার্ভার জটিলতাসহ নানা কারণে সময়মতো ই-ভিসা পাননি অনেক হজযাত্রী। এ কারণে নির্ধারিত ফাইটে সৌদি যেতে পারেননি তারা। পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে ফাইটে ওঠার শেষ মুহূর্তেও ভিসা না পাওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফেরত যেতে হয়েছে অনেককে। এ ছাড়া এ বছরই প্রথম দ্বিতীয়-তৃতীয়বার হজ করলে বাড়তি দুই হাজার রিয়াল দেয়ার বিধান করে সৌদি সরকার। এ কারণে হাজীপ্রতি প্রায় ৪৪ হাজার টাকা বেশি প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের হজযাত্রী রয়েছেন প্রায় সাত হাজার। যারা হজ গাইড হিসেবে কাজ করে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে এত টাকা বেড়ে যাওয়ায় এজেন্সি মালিকরা গাইডদের এ টাকা বহন করতে সম্মত ছিলেন না। গাইডরাও এত টাকা দ্রুত জোগাড় করতে পারেননি। যার কারণে তাদের ভিসা হওয়ার পরও টিকিট কাটেননি। ফলে তাদের অধীন হজযাত্রীরা যেতে পারেননি। এতে দেখা দেয় ফাইট বিপর্যয়।

ফাইট বিপর্যয় : পর্যাপ্ত সংখ্যক হজযাত্রী না পাওয়ার কারণে গতকাল আবারো বিমানের দু’টি হজ ফাইট বাতিল হয়েছে। বাতিল হওয়া ফাইট দু’টি হচ্ছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সকাল ৬টা ৫ মিনিটের বিজি-১০৭৩ ও বেলা ১টা ২৫ মিনিটের বিজি-৫০৭৩ ফাইট। এ নিয়ে বিমানের ফাইট বাতিল হলো ২৫টি। এ ছাড়া সৌদি এয়ারলাইন্সের চারটি ফাইট বাতিল হয়েছে। বাতিল হওয়া এসব ফাইটে প্রায় ৯ হাজার যাত্রী যাওয়ার কথা ছিল। ফাইট বাতিল হওয়ার কারণে অনেক হজযাত্রী হজ ক্যাম্পে এসেও ফিরে যেতে বাধ্য হন।

মোয়াল্লিম চুক্তি নিয়ে জটিলতা : এ বছর সরকার ঘোষিত দু’টি হজ প্যাকেজের মধ্যে নি¤েœর প্যাকেজ অনুসারে হজযাত্রীদের ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা দেয়ার কথা। কিন্তু অনেক হজযাত্রী ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন এজেন্সিকে। এ কারণে হজ এজেন্সিগুলো সৌদিতে কম মূল্যের মোয়াল্লিমের সাথে চুক্তি করে থাকে। কিন্তু অন্যান্য বছর আগস্ট মাসে প্রাক-নিবন্ধন শুরু হলেও এ বছর সরকার ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে প্রাক-নিবন্ধন করে। এতে নিবন্ধনেও দেরি হয়। এ কারণে এজেন্সি মালিকেরা সৌদি আরবে গিয়ে দেখেন সর্বনি¤œ অর্থাৎ ডি ক্যাটাগরির মোয়াল্লিম অন্যান্য দেশের হজ এজেন্সিগুলো বুক করে ফেলেছে। এ কারণে ৯১টি এজেন্সির ১৪ হাজার হাজীকে দেড় হাজার রিয়ালের সি ক্যাটাগরির সুবিধার মোয়াল্লিম চুক্তি করতে হয়। তবে তারা এক হাজার রিয়াল দিয়ে প্রাথমিকভাবে চুক্তি করেন। পরে বাকি পাঁচশ রিয়াল পরিশোধের কথা রয়েছে। এ কারণে এ চুক্তির আওতায় থাকা হজযাত্রীরা সৌদি আরবে গিয়েও হজ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুনঃ হজে খরচ বেড়েছে : গত ২০১৫-১৬ সালে যারা হজ করেছেন তাদের মধ্যে যারা এ বছরও হজে যাবেন, তাদের ভিসা করতে অতিরিক্ত দুই হাজার রিয়াল (৪৪ হাজার টাকা) লাগবে। ফাইট শুরুর এক দিনের মাথায় আকস্মিক সৌদি আরব কর্তৃপ এ ধরনের একটি সার্কুলার জারি করায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তির শিকার হন এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট হজযাত্রীরা। এ ধরনের হজযাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাত হাজার বলে জানা গেছে। যারা গাইড হিসেবে কাজ করে থাকেন। এদের অনেকে এ বছর হজে যেতে পারছেন না বলে জানা গেছে।

হজযাত্রীদের টাকা নিয়ে পালানো : দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ৩২ জন হজযাত্রীর বিমান ভাড়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ প্রায় ৮০ লাখ টাকা নিয়ে এক বেসরকারি এজেন্সি শরীফ এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী শরিফুল ইসলামের গত ১০ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন প্রতারণার শিকার হজযাত্রীরা। অভিযোগে জানা যায়, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা ও এর আশপাশের ৩২ জনকে এ বছর হজে পাঠানোর নাম করে ৮০ লাখ টাকা আদায় করে ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজারের ওই এজেন্সি। কিন্তু হজে যাওয়ার প্রাক্কালে শরিফুল ইসলাম হঠাৎ ৮০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ঘটনাটি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ জামে মসজিদের দেয়ালে টাঙানো শরীফ এয়ার ট্র্যাভেলসের সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং মসজিদের অজুখানার ওপরে অবস্থিত এজেন্সি অফিসে তালা ঝুলতে দেখা যায়।

রিপ্লেসমেন্ট : হজনীতিমালা অনুযায়ী এজেন্সির মোট হাজীর ৪ শতাংশ রিপ্লেসমেন্ট (প্রতিস্থাপন) করার কথা। কিন্তু এ বছর কয়েক দফা বাড়িয়ে গতকাল সর্বশেষ ১৫ শতাংশ রিপ্লেসমেন্টের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাবের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান সঙ্কটের কিছু উপশম হলেও এতে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করছেন হজ সংশ্লিষ্টরা। কারণ এ রিপ্লেসমেন্টের সুযোগে অনেকে বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের অপেক্ষমাণ হজযাত্রীদের ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে হজে পাঠানো হচ্ছে। এ দিকে ২০১৬ সালের অপেক্ষমাণ হজযাত্রীদের এ বছর রিপ্লেসমেন্ট না করার সরকারি ঘোষণা থাকার পরও এ বছর তাদের রিপ্লেসমেন্টের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
হজের অনিয়ম-ভোগান্তি নিয়ে কয়েকজন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিক বলেন, হজের প্রতিটি পদক্ষেপেই ভোগান্তি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হতে হয়। হজের মত একটি পবিত্র কাজেও অনেক সময় ঘুষ দিতে হয়। এ কারণে অনেকে হাজীদের সেবা দেয়ার মতো একটি মহান কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কথা ভাবছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাজী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের নয়া দিগন্তকে বলেন, এ বছর হজে অনেক সমস্যা হয়েছে। আগামীতে যাতে আর সমস্যা না হয় সে জন্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এরপর দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা হলে আগামীতে আর অনিয়ম-দুর্নীতি হবে না।

এ বিষয়ে হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতি বছরই হজকার্যক্রমে কিছু অনিয়ম দেখা যায়। অন্যান্য বছর দেখা যায় এজেন্সিগুলো টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এ বছর তেমনটি খুব বেশি দেখা যায়নি। তা ছাড়া এ বছর বেশ কিছু নতুন নিয়মকানুন চালু হয়েছে। যার সব কিছু সরকার বা আমাদের হাতে ছিল না। এ কারণে সমস্যা হয়েছে। আমরা এগুলোর সমাধান করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আব্দুল জলিল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতি বছরই কিছু হজযাত্রী হজে যেতে পারেন না। শেষ দিকে রোগব্যাধিসহ বিভিন্ন কারণে এ সমস্যা হয়। এ বছরও চিকুনগুনিয়া, বন্যাসহ বিভিন্ন কারণে সমস্যা হয়েছে। তারপরও এ বছর ৯৭ ভাগের বেশি হজযাত্রী হজ পালন করতে পারবেন বলে আশা করছি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/244990