দিনাজপুর শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ বিশ্বরোডটি দুই ফুট পানির নিচে রয়েছে। ছবিটি গতকাল বুধবার দুপুরে তোলা -সংগ্রাম
১৭ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪২

মানবিক বিপর্যয়ের অশনি সংকেত

যমুনা নদীর কাজিপুর পয়েন্টে পানির সমতল প্রবাহ বিপদসীমার স্মরণকালের সর্বোচ্চ ১৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল গতকাল বুধবার। এছাড়া এদিন যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও আরিচা পয়েন্টে বিপদসীমার যথাক্রমে ১৪৮, ১৩৪, ১২৬ ও ৫৯ সে.মি. ওপর দিয়ে বইছিলো। এর ফলে সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ৪৮টি ইউনিয়নের তিন শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়েছে প্রায় পৌনে ৩ লাখ মানুষ। প্রশাসন থেকে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বানসহ ত্রাণ তৎপরতার কথা বলা হলেও দুর্গতদের দুর্ভোগ বিন্দুমাত্র কমছে না।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ কারণে বন্যায় বাঁধের উপরে আশ্রয় নেয়া লোকজনকে বাঁধ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু এতো বন্যাকবলিত মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে? টাঙ্গাইলেও গতকাল দুটি বন্যা রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ৩০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এমনি করে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো বন্যাকবলিত হয়ে লাখ লাখ বানভাসি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। খাদ্য, সুপেয় পানি, পানিজনিত রোগের চিকিৎসা সহ মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়াকে বন্যা দূর্গত এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ের অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষক মহল।
একদিকে সরকারি ত্রাণ সাহায্য অপ্রতুল, অন্যদিকে চালের অগ্নিমূল্য বন্যা দুর্গতদের গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম গতকাল সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, চালের দাম একবারে ১০-২০ টাকা কমবে এমন আশা করা ঠিক না। দাম সবার ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনও হা-হুতাশ নেই। চালের মজুদ সম্পর্কে কিছুই জানাননি মন্ত্রী। একই দিন পৃথক এক সাংবাদিক সম্মেলনে সচিবালয়ে অনেক কথা বললেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিবের চলতি দায়িত্বে থাকা মো. গোলাম মোস্তফা দূর্গতদের আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো খবর দিতে পারেননি। যদিও চাঁদপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম এবং ঢাকায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অঅবদুল মুহিত দাবি করেন, বন্যায় কেউ খাদ্য সংকটে পড়বে না।
সাধারণত গঙ্গা অববাহিকায় আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও নেপালে বন্যা হয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বলা হচ্ছে ১৯৮৮ সালের বন্যা পরিস্থির চেয়ে অবনতি হতে পারে এবারের বন্যায়।
১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। স্থানভেদে এই বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলি জমি ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কলেরা আর ডায়রিয়াসহ নানা রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়ার পর পানি কমতে শুরু করেছে উত্তরাঞ্চলের প্রধান দুই নদী তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রে। একে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ বলছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন। তবে পানি বাড়ছে গঙ্গা অববাহিকার নদীগুলোতে, যা মধ্যাঞ্চলে বন্যার বার্তা দিচ্ছে।
চলতি বর্ষা মওসুমে এখন ২০টি জেলা বন্যার কবলে রয়েছে বলে সরকারের হিসাব; এর মধ্যে অধিকাংশই তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র পাড়ের। কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুরে বহু এলাকা প্লাবিত হয়ে কয়েক লাখ মানুষ এখন বন্যাদুর্গত।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল সকালে জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে তা এখনও বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি ৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে। তবে তা এখনও বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার উপরে। বাহাদুরাবাদ এবং ফুলছড়ি পয়েন্টে পানি স্থিতিশীল আছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে।
তিস্তার পানিও কমছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তায় পানি কমছে। নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে (ব্রহ্মপুত্র) পানি কমেছে। এ কারণে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলায় পানি কমে যাচ্ছে বলে আমরা জেনেছি।
প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, উজানের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করেছে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়েছে বলা যায়।
তবে যমুনার পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সেখানেও পানি দু’-একদিনের মধ্যে কমবে বলে আশা করছেন রিয়াজ।
যমুনার পানি জামালপুরের সারিয়াকান্দিতে ৯ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ২০ সেন্টিমিটার এবং আরিচা পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার বেড়েছে। সারিয়াকান্দিতে পানি বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। মেঘনা অববাহিকার ভারতীয় অংশে পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেঘনা অববাহিকার অধিকাংশ নদীর পানিও কমছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি আগামী ৭২ ঘণ্টায় বাড়লেও তা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে বলে জানায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, বন্যায় এখন পর্যন্ত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২২ লাখের বেশি মানুষ, বিভিন্ন জেলায় মারা গেছে ৩৯ জন।
বন্যায় ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে : এখন পর্যন্ত বন্যায় ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য গত ৪৮ ঘণ্টায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে ৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকেলে রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের বন্যা উপদ্রুত ২১ জেলায় ১ হাজার ৮২৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি শোধনের বড়ি মজুত আছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩ লাখ লোক : দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ জনে। অন্যদিকে বন্যাকবলিত ২১ জেলায় ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিবের চলতি দায়িত্বে থাকা মো. গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান।
গোলাম মোস্তফা জানান, প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে বন্যার্তদের আশ্রয়ের জন্য ১ হাজার ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রও খোলা হয়েছে। এগুলোতে আশ্রয় নেয়া মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ১১ হাজার।
তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে দাবি করে এ কর্মকর্তা বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। ইতিমধ্যে ৯ আগস্ট থেকে এ পর্যস্ত ৩ হাজার ২৫৫ মেট্রিক টন চাল দেয়া হয়েছে। নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ। আর ১৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে।
তবে গোলাম মোস্তফা ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর জানালেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত তিন দিনে বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যার্তদের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েন : দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হওয়ায় সরকারের নির্দেশে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে এখন পর্যন্ত ২৯ প্লাটুন সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
আইএসপিআর’র সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রেজা-উল করিম শাম্মী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুনভাবে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে প্রয়োজনীয় স্পিডবোট ও উদ্ধার সামগ্রীসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের পূর্বাঞ্চলে আক্রান্ত দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও সৈয়দপুরে সেনাসদস্য ও উদ্ধার সরঞ্জামাদি বাড়ানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বন্যার্তদের উদ্ধার ও বাঁধ রক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সেনাবাহিনী বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ওইসব এলাকা থেকে সেনাবাহিনী দুই হাজারেরও অধিক মানুষকে উদ্ধারসহ বিপুল পরিমাণ গবাদিপশু ও গৃহস্থালি সামগ্রী উদ্ধার করেছে।
সেনাবাহিনী সৈয়দপুর ও গাইবান্ধায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করছে। সেনাবাহিনী নিবিড়ভাবে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং বন্যাদুর্গত এলাকায় যেকোনো ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
যমুনার পানি বিপদসীমার ১৫১ সে: মি: উপরে : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি ও শাহজাদপুরের গোপালপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পানির প্রবল তোরে ভেঙে যাওয়ায় জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষায় নির্মিত ব্রক্ষপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এই বাঁধের গোনেরগাতী থেকে পাঁচঠাকুরী পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি চুয়ে বের হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালির বস্তা ফেলে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত জেলার ৩৩টি ইউনিয়নের ২৯০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল দুপুর ৩টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বুধবার ভোর রাতে গোপালপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১শ’ মিটার ভেঙে যমুনার পানির প্রবল ¯্রােত হুরাসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, জালালপুর, বেলতৈল ইউনিয়নের অন্তত হাজারো একর আমন ধান তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে কিছু ঘর-বাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি এসব জমিতে পলির পরিবর্তে বালু পড়ায় জমি অনাবাদী হবার আশংকায় কৃষকেরা।
সাপাহারে পুনর্ভবা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে বন্যায় জন জীবন বিপর্যস্ত
সাপাহার (নওগাঁ) সংবাদদাতা : নওগাঁর সাপাহার উপজেলার সীমান্তবর্তী পাতাড়ী ইউনিয়নে পুনর্ভবা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় দেড় হাজার পরিবার বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
পাতাড়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুকুল হোসেন জানান, গত কয়েক দিনের টানা অতি বর্ষণে পুনর্ভবা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় গত ১৪ আগস্টের মধ্যে রাতে পুনর্ভবা নদীর পূর্ব তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩/৪টি স্থান ভেঙ্গে জাল সুখা, হাড়িপাল, কাওয়া ভাসা, কাড়িয়া পাড়া, উত্তর কলমুডাঙ্গা, বলদিয়া ঘাট গ্রাম প্লাবিত হয়।
অপরদিকে বন্যা দুর্গত লোকজন জানান, গত ১৫ আগস্ট বিকেলে আদাতলা সীমান্তের ২৪৪ পিলার এলাকার অদূরে ভারতের অভ্যন্তরে তপন থানার শিয়ালমারী নামক স্থানে পুনর্ভবা নদীর বাঁধ ভারতীয় লোকজন প্রকাশ্যে স্কেবেটর দ্বারা কেটে দেয়। যার ফলে মুহুর্তের মধ্যে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির তোড়ে সীমান্তবর্তী আদাতলা, উত্তর পাতাড়ী, দক্ষিণ পাতাড়ী, তিলনী, বৈকণ্টপুরসহ আশে পাশের বিভিন্ন গ্রাম একের পর এক পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে পুনর্ভবা নদীর বন্যার পানির সাথে ভারতের বাঁধ কেটে দেয়ার কারণে উজানের ঢলের পানি এক হওয়ায় এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে।
অনেকের অভিমত গত কয়েক দিনেও ওই এলাকায় সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণের ত্রাণ সামগ্রী না পৌঁছায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এতে অনাহারে থাকতে হচ্ছে অনেক বানভাসি মানুষকে।
হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বন্যাদুর্গত অসহায় লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। ইতোমধ্যে পাতাড়ী ফাজিল মাদ্রাসা, উত্তর পাতাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলমুডাঙ্গা জোহাকিয়া মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন মসজিদ ও উঁচু রাস্তার উপর লোকজন আশ্রয় নিয়েছে।
গত কয়েকদিন থেকে অবিরাম বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি হুহু করে বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পুর্ণভবা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নদী এলাকার শত শত জনবসতি পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
বন্যা দুর্গত লোকজন পরিবার পরিজন ও গবাদী পশু নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্যার পানির তোড়ে পাতাড়ী ইউনিয়নের অনেক রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বন্যার ফলে ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রোপা আমন ধান, পুকুর, থৈ থৈ পানির নিচে ডুবে আছে।
এদিকে সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এএফএম গোলাম ফারুক হোসেন জানান, এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে ৩ হাজার ৮৬ হেক্টর রোপা আমন ধান, আউস ও সব্জি ফসল ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় ২০৫ টি (৩৩৯ বিঘা) পুকুর ডুবে গিয়ে প্রায় ৪৯লক্ষ ৬৫ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা : কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সামান্য উন্নতি হলেও নতুন করে উলিপুর উপজেলার বামনাছড়া মৌজার সোনারী পাড়াসহ কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকছে এবং গত কয়েকদিনে আক্রান্ত বন্যার্তদের মাঝে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংক চলছে। পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। মাত্র ২৪২টি আশ্রয় কেন্দ্রে সাড়ে ১৯ হাজার পরিবার আশ্রয় নিলেও জেলার হাজার হাজার পরিবার বাধের রাস্তার পাশে এবং উঁচু স্থানে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নিয়েছে। ৪৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ১৪০.৫০কিঃমিঃ কাচা রাস্তার ক্ষতি। ভেসে গেছে প্রায় ১৮’শ পুকুর ও জলাসয়ের মাছ। নদ-নদীর পানি এখনো বিপদ সীমার উপরে। বেড়েছে দুর্ভোগ। ভেসে গেছে হাঁস মুরগি। গো-খাদ্যের চরম সংকট। বেড়ে গেছে চাল ডালসহ নিত্য পন্যের দাম। বিদ্যুতের লোডশ্যাডিংতো আছেই।
সরেজমিনে খোজ নিয়ে জানাগেছে পানির তীব্র ¯্রােতে কুড়িগ্রামর টগরাইহাট এলাকায় ১১৫ফিট দৈর্ঘের রেল সেতুর ৫টি পিলার’র মধ্যে ১টি সম্পুর্ন দেবে গেছে আরো ২টি পিলার এখনো চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে।
কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৬টি নদ-নদীর মধ্যে ধরলা সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ৮৮সোন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার এবং পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমারের পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত ৫দিনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার সর্বত্র শুধু পানি আর পানি। বানভাসি মানুষের আহাজারি। চরম বেকায়দায় বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে পরিবারের লোকজন। ভিশুদ্ধ পানি খাদ্য জ্বালানি ও আবাসন সমস্যায় মহাসংকটে রয়েছে বন্যায় আক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৪লাখ মানুষ।
জেলার রৌমারী, রাজিবপুর, চিলমারী, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ৭২ইউনিয়ন’র মধ্যে ৫৫ ইউনিয়নের প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষ।
কৃষির ক্ষয়ক্ষতি ৪২ হাজার, ৩৫১ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
আশ্রয় কেন্দ্রঃ ২৪২টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ১৯ হাজার ২২৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ উচঁ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে বন্যা কবলিত হাজার হাজার পরিবারের মানুষজন। বাধের রাস্তার দু’ধারে আশ্রিত মানুষ আর গবাদি পশুর এক সঙ্গে বাস করায় বিষাক্ত হয়ে পড়েছে এলাকার পরিবেশ। পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে লাখ লাখ মানুষ। অনেক বানভাসি পরিবার খেয়ে না খেয়ে নিদারুন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। মশার কামরের অসহনিয় যন্ত্রনাতো আছে। তার উপর ভেসে আসা বিষধর সাপের ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে বসে।
এদিকে উলিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ হায়দার আলী উপজেলার থেতরাই ও গুনাইগাছ ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝে ৫কেজি চাল, ২কেজি ডাল, ২কেজি চিড়া ১লিটার তেল খাবার স্যালাইন ও মুড়িসহ ১হাজার ৫৫০টি প্যাকেট করে ১, ৫৫০ পরিবারকে বিতরণ করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, এ পর্যন্ত বন্যার্তদের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ ৫ হাজার টাকা, ৬শ ৫১ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বন্যার্তদের মাঝে যে পরিমান ত্রাণ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনের তুলুনায় তা অপ্রতুল।
শ্রীনগর (মুন্সিগঞ্জ) সংবাদদাতা : মুন্সিগঞ্জে বুধবার নিন্মঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শ্রীনগর, লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার। পদ্মা তীরের বাড়িঘর ছাড়াও বহু ফসলী জমি তলিয়ে গেছে।
চর এলাকায় বান ভাসি মানুষ দুর্ভোগে পরেছে। পদ্মার পানি বুধবার সকালে ভাগ্যকূল পয়েন্টে বিপদসীমার ৬ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। পানি বৃদ্ধী অব্যাহত থাকায় আজ সকাল থেকে মাওয়া শ্রীনগর উপজেলার কবুতর খোলা, টঙ্গীবাড়ি হাসাইল, বানারী, পাচনখোলা, নগর যোয়ার, পাঁচগাঁও, কামারখাড়া, লৌহজং উপজেলার কনকশার, যসলদিয়া সহ বপিদসীমার ৬ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যসহকারী মোঃ জয়নাল বলেন এই সময়ে মাওয়ায় শ্রীনগর, লৌহজং, ভাগ্যকুল এলাকায় পানি বৃদ্ধী পেয়েছে। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মনির হোসেন বলেন, প্রশাসন জলমগ্ন এলাকার মানুষের পাশে রয়েছে। সরকারিভাবে সবরকম প্রস্তুতি রয়েছে। লৌহজং উপজেলায় মোট ১১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তিনি আরো বলেন সার্বিক পরিস্তিতির উপর বিবেচনা করে সরকারের কাছে, ত্রাণ সামাগ্রীর চাহিদা জানানো হয়েছে।
বন্যাকবলিত মানুষের সুচিকিৎসা দেয়ার জন্য, উপজেল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিম গঠন করে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ডাঃ দিয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে করে এলাকার বানভাসি মানুষ দুর্ভোগে কেউ চিতিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
বিপদ সীমার অতিক্রম করে ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৬ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছে দুপুর ১টা পর্যন্ত। আরও কয়েকটি গ্রমের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
বগুড়া অফিস ঃ বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির তোড়ে সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ২০টি জায়গা দিয়ে পানি ঝরছে। যেকোন মুহুর্তে বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা করছেন এলাকাবাসী। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ধুনটের চুনিয়াপাড়ায় মানাস নদীর মুখে যমুনার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধেঁর নিচ দিয়ে পানি ঝরছে। চুনিয়াপাড়ার আরেকটি জায়গায় ইদুরের গর্ত দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করেছে। এছাড়াও শিমুলবাড়ীর দুটি পয়েন্ট, বানিয়াজানের দুটি পয়েন্ট, রঘুনাথপুরের একটি পয়েন্ট এবং পুকুরিয়া ভুতবাড়ীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে পানি ঝরছে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালু ভর্তি বস্তা ফেলে পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে এলাকার মানুষ। তারা স্বেচ্ছায় বাঁধ মেরামতের কাজ করছে।
এলাকাবাসী জানায়, চুনিয়াপাড়ার আরেকটি পয়েন্টে ইদুরের গর্ত দিয়ে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। আস্তে আস্তে গর্তের মুখ বড় হয়ে পানি ঢুকছে। স্থানীয় লোকজন সেখানে মাটি দিয়ে পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকদের খবর দিলেও তারা আসতে বিলম্ব করেছে। শুধু দশ বারোটা বালুর বস্তা দিয়ে পানি বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। তারা আরও জানান, ইদুরের গর্ত দিয়ে পানি ঝরা বিপদজনক। ২০০৪ সালে পাশেই শিমুলবাড়ীতে ইদুরের গর্ত দিয়ে পানি ঝরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধঁ ভেঙ্গে গিয়েছিল। ইদুরের গর্ত ভালোভাবে বন্ধ না করলে শিমুলবাড়ীর মত ট্র্যাজেডি ঘটে যেতে পারে বলে এলাকাবাসী আশংকা করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব-এসিস্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো: হারুনুর রশীদ জানান, ধুনটের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধেঁর দশটি পয়েন্টে পানি ঝরছে। সেখানে বালুর বস্তা দিয়ে পানি বন্ধ করার কাজ চলছে। গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মঈনূল হাসান মুকুল জানান, মঙ্গলবার বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ চুনিয়াপাড়ার ফাটল এলাকা পরিদর্শন করেছি। সেখানকার অবস্থা ভাল না। দ্রুত কাজ না করলে বড় ধরনের কিছু ঘটে যেতে পারে। এদিকে, বাঁধের পশ্চিম পাশের বাসিন্দাদের মাঝেও বন্যার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। যেকোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে গেলে বিশাল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে এমন আশংকায় রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
অপরদিকে, নওগাঁর আত্রাইয়ে ছোট যমুনার বাঁধ ভাঙ্গার ফলে বগুড়ার কাহালু উপজেলায় নাগর নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে। এতে বীরকেদার ইউনিয়নের দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানির গতি কম থাকায় সেখানে বন্যা পরিস্থিতি এখনো মারাত্বক আকার ধারণ করেনি বলে জানাগেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রুহুল আমিন জানান, বাধেঁর যেসব জায়গায় পানি ঝরছে সেখানে আমাদের লোকজন পানি বন্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি বাধেঁর পানি ঝরা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
জেলা ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলা ১৫টি ইউনিয়নের ১ লাখ ২হাজার ২৪৪ জন বন্যায় ক্ষতিগড়্রস্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যেই ১০০ মেট্রিক মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৫০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ১ লাখ টাকা। সোনাতলায় ৩০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা এবং ধুনটে ২০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। চাল বিতরণ শুরু হলেও নগদ টাকা এখনো দুর্গতদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়নি বলে স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে। এদিকে, দূর্গথ এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বাঁধে আশ্রয় নেয়া দূর্গত মানুষদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমান টিউবঅয়েল না থাকায় এবং অস্থায়ী ভাবে বসানো টিউবঅয়েলগুলোর বেশির ভাগই ব্যবহারের অনুপযোগি হওয়ায় মানুষর দুর্ভোগ বেড়েছে। সেই সাথে গণশৌচাগারের স্বল্পতার কারণেও মানুষের কষ্ট বাড়ছে।
ভারত থেকে ধেয়ে আসা বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের কৃষিখাত। শুধুমাত্র বগুড়া অঞ্চলের তিন জেলায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রথম দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় দফা বন্যায় ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া আঞ্চলিক অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ জানান, চলতি বন্যায় বগুড়া অঞ্চলের তিনটি জেলা বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটে মোট ১৯ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিরে ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে বগুড়ায় ৬ হাজার ৯৭০ হেক্টর, সিরাজগঞ্জে ৭ হাজার ৮৩০ হেক্টর এবং জয়পুরহাটের প্লাবিত হয়েছে ৫ হাজার ১৪২ হেক্টর ফসলি জমি। তিনি আরও জানান, শুধুমাত্র বগুড়ায় ১ হাজার ২২০ হেক্টর জমির আউশ, ৩০ হক্টের আমনের বীজতলা, ৫ হাজার ৫৮২ হেক্টর জমির রোপা আমন, ১৩৩ হেক্টর জমির শাক-সবজি এবং ৫ হেক্টর জমির কলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। দ্রুত পানি সরে না গেলে এসব ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিলে বগুড়াসহ এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলী জমি প্লাবিত হতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন।
লালমনিরহাট সংবাদদাতা : লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির বুধবার আরো উন্নতি হয়েছে। ফলে জেলার পাঁচ উপজেলার বেশ কিছু এলাকা থেকে ইতিমধ্যে পানি নেমে গেছে। এসব এলাকায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া বানভাসি মানুষজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। তবে তিস্তা-ধরলা নদী সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলের অনেক এলাকায় ঘরবাড়ী থেকে পানি ধীরগতিতে নামায় দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসিরা। এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারিভাবে যে পরিমান ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার অনেক বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ এখনো পৌঁছায়নি বলে ভুক্তভোগীরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এদিকে, বন্যার্ত পরিবার পুনর্বাসনে এবং দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে বুধবার থেকে লালমনিরহাটের বিজিবিসহ সেনাবাহিনীর তিনটি টিম মাঠে কাজ করছে। লালমনিরহাটের বন্যাদুর্গত এলাকায় রংপুর সেনা নিবাসের সদস্যরা বর্তমানে লালমনিরহাটের বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের চিকিৎসা সেবা ও ওষুধপত্র দিচ্ছেন। ব্যারাজ ডালিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তিস্তা নদীর পানি এখন প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা : বানের পানি গত ২৪ ঘন্টায় পানি ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নাদীর পানি এখন বিপদসীমার ১৫০ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুরসহ ৫টি উপজেলার আড়াইশ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষেরা খোলাকাশের নীচে মানবেত জীবন যাপন করছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ী ঢল ও ভারিবর্ষণে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি অব্যহাত থাকায় গোটা জেলাবাসীর মনে আতংক বেড়েই চলছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার আড়াই শতাধিক গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পরেছে। ইতিমধ্যেই ১৫৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০ জন বানভাসি মানুষ আশ্রয়গ্রহণ করেছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। ইতিমধ্যেই নদী তীরবর্তী অনেক নীচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে যা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তিনি আরো জানান জেলার মোট ৭৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ৬/৭ কিলোমিটার ঝুকির মধ্যে রয়েছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধের ঝুকিপূর্ণ এলাকাগুলি নজরদারীতে রেখেছে।
দিনাজপুর সংবাদদাতা : দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়া শুরু করলেও বেড়েছে বানভাসী মানুষের অবর্ণনীয় দুভোর্গ। পানিবন্দী ৬ লাখ বানভাসী মানুষ বিভিন্ন উচু স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৩’শ ৮৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। গবাদি পশু’র খাদ্যেরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। জ্বর-সর্দি, আমাশয়, ডায়রিয়া, পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দিয়েছে বানভাসী মানুষের। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ১২৫টি স্বাস্থ্য ক্যাম্প খুলেছে। বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং বিজিবিও চালিয়ে যাচ্ছে বানভাসী মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা। দিনাজপুরে বন্যায় এ পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা ত্রাণ ও পূর্ণবাসন অফিসার মোখলেসুর রহমান। পানিতে ডুবে, সাপে কেটে এবং দেয়াল চাপায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী রাতভর বন্যা দুর্গত মানুষের সাহায্যে কাজ করে যাচ্ছে। ৫০ মিটার ভেঙ্গে যাওয়া দিনাজপুর শহর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর বিশেষ দল। বন্যায় দিনাজপুরের অধিকাংশ সড়ক ও মহাসড়ক পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় সেসব সড়ক ও মহাসড়কের অধিকাংশ স্থান ভেঙ্গে গেছে। এতে দিনাজপুর জেলার সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলাসহ রাজধানী ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। রেল লাইন ডুবে যাওয়ায় ৫ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে পাবর্তীপুর-পঞ্চগড় রেল যোগাযোগ। হিলি স্থলবন্দর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গত শনিবার থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। বানভাসী মানুষের আশ্রয় এবং বন্যায় পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ায় দিনাজপুরের ২৬৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৬৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং জেলা শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। তবে জেলার সবগুলো নদীর পানি কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই নগদ ১১ লাখ টাকা, ২’শ ৭৫ মেট্রিক টন চাল ও দু’হাজার প্যাকেট (চিড়া, গুড়, মুড়ি, বিস্কুট) শুকনো খাবার বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ করেছে। এছাড়াও বন্যার্তদের জন্য ৫০ লাখ টাকা এবং ৩০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পর্যাপ্ত সরবরাহ করা হয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হলেও বানভাসী মানুষেরা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট চাহিদামত পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডাঃ মওলা বক্স চৌধুরী জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় ও জনস্বাস্থ্য বিভাগে রয়েছে। যখন যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সরবরাহ করা হবে। এ বিষয়ে কোন সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, হুইপ মহোদয় এখানে সার্বক্ষণিক রয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে আমরা পরিকল্পনা করছি এবং সে অনুযায়ী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হচ্ছে। প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে এলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ করেছেন পানিবন্দী মানুষেরা।
এদিকে সেনাবাহিনীর জেএসি মেজর জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক গতকাল বুধবার দিনাজপুরে বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন ও বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। দিনাজপুর সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম সরেজমিনে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। দিনাজপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর আনোয়ারুল ইসলাম তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা বিরামপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ ও দুর্গত মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আফতাব উদ্দীন মোল্লাও বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে অর্ধ লক্ষাধিক টাকার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন বলে জানা গেছে। বীরগঞ্জ পৌর মেয়র মোহাম্মদ হানিফ তাঁর এলাকার বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। অপরদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গতকাল বুধবার বিকালে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে বন্যা পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এক জরুরী সভা চলছিল। সভায় হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি, মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি, জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলমসহ সকল সরকারি দপ্তরের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় নতুনভাবে ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পতœীতলা (নওগাঁ) সংবাদদাতা : নওগাঁর পতœীতলায় শিশু ডায়রিয়ায় ৩ জনের মৃত্যু বন্যায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত , ২ হাজার ৯ শত ৯ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা গেছে পতœীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব বাঁধটি দুই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়ে প্রায় শতাধিক গ্রামের ১ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন এবং গতকাল বুধবার পতœীতলা উপজেলার ইছাপুর গ্রামের আবুল কালাম আজাদের পুত্র সেলিম রেজা(১১) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং একই দিনে ধামইরহাট উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের শিশু আলম (৮) এবং একই গ্রামের শিশু রাসেল (৭) ডায়রিয়ায় মারা যায় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা স্কুল কলেজ রাস্তা ঘাট বন্যা নিয়ন্ত্রণ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলো পতœীতলা উপজেলার পতœীতলা ইউনিয়নের আবাদিয়াপাড়া, পতœীতলা বাজার গোডাউন পাড়া, বালুঘা, কনচিপুকুর, কল্যানপুর, মহেষপুর, সম্ভুপুর ও উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চকবল্লভ, বিষ্টপুর, পানিওড়া, চকআবদাল, ডাঙ্গাপাড়া, বরইল, এছাড়া পার্টিচড়া ইউনিয়নের ছালিগ্রাম এলাকায় বাঁধ ভেঙে ৬০-৭০ টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি এখন বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া মিরাপুর বৈরাগীতলা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকালে পতœীতলা উপজেলা প্রশাসনের উদ্দ্যোগে বানভাসী মানুষদের মাঝে চিড়া, চিনি, স্যালাইন, ঔষধ ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কালে উপস্থিত ছিলেন পতœীতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মালেক, উপজেলা আওয়ামীলীগের থানা সভাপতি আলহাজ্ব ইছাহাক হোসেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। গতকাল সকাল ১০ টায় এলাকাবাসী ইর্শ্বাপরায়ন হয়ে উপজেলার সুইছগেট এলাকায় বাঁধ কেটে পানি বের করার কালে স্থানীয় চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোস্তফা শাহ্ চৌধুরী বাধা দিতে গেলে গ্রাম বাসীর হাতে লাঞ্চিত হয়েছে বলে চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন। বন্যা এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, সর্দি জ্বর সহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী : জেলার সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যানুযায়ি সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন এবং গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে গত ৩দিনে পানিতে ডুবে এক শিশুসহ ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউপির তালুককানুপুর রফিকুল ইসলামের মেয়ে গ্রামের রিয়ামনি (৩), কাটাবাড়ী ইউপির বেলাল হোসেনের নাতি সিফাত (১৫) ও রাখালবুরুজ ইউপি’র আজিমুদ্দিন (৬০) পানিতে ডুবে মারা গেছে।
এদিকে গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের ডেভিড কোম্পানীপাড়া, বাহারবন, চকমামরোজপুর, কাজলঢোপের ৮টি পয়েন্ট একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এরমধ্যে মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত আকস্মিকভাবে ডেভিড কোম্পানীপাড়ার ৪টি পয়েন্টে বাঁধের ছিদ্র পথে পানি চোঁয়াতে শুরু করে। এসময় পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল ও পৌরসভার মেয়র অ্যাড. শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ তৎপরতার সাথে বালুর বস্তা দিয়ে ও রিং তৈরী করে পানি চোঁয়ানো বন্ধ করে বাঁধটিকে ধ্বংসের হাত রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এছাড়া বহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়া-রতনপুর ও কাতলামারী দুটি পয়েন্টে বহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর বন্যার পানির তোড়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব পয়েন্টে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে জেলা শহরসহ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। এ কারণে বাঁধ সংলগ্ন এলাকাগুলোর লোকজনের মধ্যে বেশি আতংক বিরাজ করছে।
অন্যদিকে পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের কিশামত চেরেঙ্গা এলাকায় করতোয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১শ’ মিটার অংশ মঙ্গলবার ভেঙ্গে যাওয়ায় ১৫টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে চেরেঙ্গা, কিশামত চেরেঙ্গা, শালমারা, ঝাপড়া, দৌলতপুর, কড়িআটা, জগন্নাথপুর, শালমারা, শাহিনদহ, চাকলা।
অপরদিকে উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের টোংরারদহ এলাকায় করতোয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০ মিটার অংশ অংশ ধ্বসে যেকোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। এতে ওই ইউনিয়নের বড় শিমুলতলা, তেকানী, প্রজাপাড়া, কেশবপুর, চকবালা, সগুনা, পশ্চিম মির্জাপুর, কাশিয়াবাড়ী, কিশোরগাড়ী, গনকপাড়া, হাসানখোর, জাফর, মুংলিশপুরসহ ১৩টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। ওইসব গ্রামের আমন ধান ক্ষেত, বীজতলা, শাকসবজির ক্ষেত, পানের বরজ, আখক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এছাড়া সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী-ভাঙ্গামোড় সড়কের নীলকুঠি এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১০৩ সে.মি. উপর দিয়ে, ঘাঘটের পানি বিপদসীমার ৮৫ সে.মি. উপর দিয়ে এবং করতোয়ার নদীর পানি বিপদসীমার ৩৪ উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি এখন বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল জানান, এবারের বন্যা কবলিত মানুষদের জন্য এ পর্যন্ত ৫শ’ মে. টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ১শ’ ৫০ মে.টন চাল ও সাড়ে ৩ লাখ টাকা বন্যা দুর্গত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে।
এ দিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় ২ হাজার বানভাসী মানুষরা এখন ওয়াবদা বাঁধসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের গরু ছাগল, হাঁস মুরগি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। সেই সাথে হাজার হাজার একর রোপা আমন ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানাগেছে, ব্রক্ষ্মপুত্রের পানি ২০.৮৩ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপদ সীমার ১০১ সে.মি অতিক্রম করছে। ফলে উপজেলায় বন্যার পানিতে ভরতখালী ইউনিয়নের কুকড়াহাট থেকে ভরতখালী গো-হাট পর্যন্ত মিনি বিশ্বরোড ভাঙ্গনের আশংকা দেখা দিয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে বালুর বস্তা ফেলে রাস্তা রক্ষা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি।
সরেজমিনে গেলে সাঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন সুইট জানান, বাঁশহাটা, গোবিন্দী, হাসিলকান্দী, হাটবাড়ী, উঃ সাথালিয়া ও ৫টি আশ্রয়ন কেন্দ্রসহ প্রায় ১৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কিন্তু সরকারীভাবে যে পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে তা অতি নগন্য। হলদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী জানান, হলদিয়া ইউনিয়নের উঃ দিঘলকান্দী, দঃ দিঘলকান্দী, পাতিলবাড়ী, গাড়ামারা সিপি, চরহলদিয়া, নলছিয়া, বেড়া, গোবিন্দপুর, কালুরপাড়া, সহ ১৪টি গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হলদিয়া ইউনিয়নে পরপর ২বার বন্যায় মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। জুমারবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রোস্তম আলী জানান, ব্যাঙ্গারপাড়া, থৈকরেরপাড়া, পূর্ব-আমদিরপাড়া, কাঠুর, চান্দপাড়া, পূর্ব বসন্তেরপাড়া, পূর্ব জুমারবাড়ী সহ ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভরতখালী ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল আজাদ শীতল জানান, চিথুলিয়া, বরমতাইড়, উঃ উল্যা, দঃ উল্যা, সানকিভাঙ্গা, বালুরচর, ভাঙ্গামোড়ের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও মিনি বিশ্বরোড।
কচুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান জানান, রামনগর, পশ্চিম কচুয়া, চন্দনপাঠ গ্রামের কিছু অংশের প্রায় ১ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নৌকা দিয়ে এসব গ্রামের মানুষ চলাচল করছে। অধিকাংশ বাড়ীর আঙ্গিনায় এবং ঘরে পানি উঠেছে। ফলে তাদেরকে সাংসারিক কাজ করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বন্যা কবলিত অনেক পরিবারই তাদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিভিন্ন উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকা সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার ঘোষ, গাইবান্ধা নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিইডি) মাকছুদুল আলম, সাঘাটা উপজেলা প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিঠুন কুন্ডু পরিদর্শন করেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়ে গোবিন্দগঞ্জ - ঘোড়াঘাট সড়ক হাটু পানির নিচে তলিয়ে গেছে । গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কন্টোলরুম থেকে জানিয়েছেন করতোয়া নদীর পানি কাটাখালী ও তরফমনু পয়েন্টে বিপদ সীমার ৪৪ সেমি: উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে করতোয়া নদীর বাঁধের একাধিক স্থানে ভেঙ্গে গিয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে । ফলে পৌর সভা সহ ১২টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে । এবং বন্যার পানিতে ডুবে ৩ জন নিহত হয়েছে ।
টাঙ্গাইল সংবাদদাতা : “স্যার মঙ্গলবার থেকে না খাওয়া। শুকনো খাবার চিড়া মুড়ি যা ছিলো সব শেষ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্য বন্যার পানি খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। আর পারছিনা। আমরা ত্রাণ চাইনা। একটু খাবার পানির ব্যবস্থা করে দেন। কোনো রকম জীবনটা বাঁচিয়ে রাখিয়ে। দুইটা পায়ে ধরি। একটু দয়া করেন।” এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন ঘরের চালার উপর আশ্রয় নেয়া গাবসারা ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ ও তার পরিবার। লতিফের পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবারের আর্তনাদ শোনার মতো কেউ নেই। সরকারিভাবে এখন পর্যন্তও কোনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়নি। এগিয়ে আসেনি কোনো বেসরকারি সংস্থাও। স্থানীয় এমপি বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় অবস্থান করলেও সম্ভাব্য কোনো এমপি প্রার্থীরও দেখা মিলছেনা বন্যার্তদের পাশে। বন্যার পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ঘরের মধ্যে উঁচু বাঁশের মাঁচান পেতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, অন্যের উঁচু জমি ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কোনো ভালো গাড়ি রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করালেই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছে গাড়ির কাছে। কিন্তু ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে গাবসারা, অর্জুনা, গোবিন্দাসী, নিকরাইল ও অলোয়া ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকার ১৭ হাজার বসতবাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এতে দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, বোনা আমন, আউশ, বীজতলা ও সবজি বাগান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫০টি পোল্ট্রি খামার ও ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর। ক্লাশ রুমে পানি প্রবেশ করায় ৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৬টি দাখিল মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থগিত করা হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চলমান দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। নিমজ্জিত হচ্ছে ফসলি জমি। পুরো উপজেলাই বন্যা কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বন্যার পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ঘরের মধ্যে উঁচু বাঁশের মাঁচান পেতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ী, অন্যের উঁচু জমি ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পৌছেনি কোনো সাহায্য। এছাড়া টাঙ্গাইল-তারাকান্দি সড়কের ভূঞাপুরের অর্জুনা, কুঠিবয়ড়া, তাড়াই, ভরুয়া ও গোলপেঁচা নামকস্থানে লিকেজ দেখা দেয়ায় এ সড়কটি হুমকির মুখে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি ভেঙে গেলে টাঙ্গাইলের গোপালপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতী উপজেলা তলিয়ে যাবে।
গাবসারা ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের ফরিদা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ‘বানের পানিতে ঘরবাড়ি ডুইবা গেছে। বিপদের মইধ্যে আছি। কেউ খোঁজ নিতে আসে নাই। ভোটের সময় আইলেই আমগর দাম বাইড়া যায়। অহন আমগো কোনো দাম নাই।’ জয়পুর গ্রামের মুকুল এবং তার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে রান্না-বান্নার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত না খেয়ে আছে বলে জানায়। এ পর্যন্ত তারা কোনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছ থেকেই কোনো খাদ্য খাবার পায়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ বিদ্যালয়গুলো পানির নিচে তলিয়ে আছে। গাবসারা ইউনিয়নের দুইটি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে পাকা কেন্দ্রটি গত বন্যায় ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। বর্তমান যেটি রয়েছে সেটি টিনের তৈরি। সেটি পুরোটাই পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। সেখানে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। যমুনার নদীর পূর্বপাড় সংলগ্ন গোবিন্দাসি ইউনিয়নের সুনামধন্য গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়টি যমুনা নদীর একেবারে তীরবর্তী হওয়ায় এবং গোবিন্দাসী থেকে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু পর্যন্ত গাইড বাধের বাহির হওয়ায় সেখানেও বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
অর্জুনার রামাইল গ্রামের আব্দুল আজিজ (৫৫) বলেন, ‘যমুনার পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। গরু-ছাগল ও পরিবার নিয়ে জোমারবয়ড়া স্কুলে আশ্রয় নিয়েছি। ৩ দিন যাবৎ কেবল চিড়ামুড়ি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছি।’
গোবিন্দপুর বাজারের দোকানি আলি হোসেন (৪০) বলেন, ‘চরাঞ্চলের মানুষের কেনাকাটার একমাত্র স্থান গোবিন্দপুর বাজার তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেনা। এতে তারা চরম বেকায়দায় পড়েছে।
গাবসারা ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন পুরোটাই পানির নীচে। এতে অর্ধলক্ষ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ সরকারিভাবে কোনো সাহায্যই পাচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্তরা।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উঁচু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে বন্যার্তরা আশ্রয় নিতে পারে। আটকে পড়াদের উদ্ধারে নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। পর্যাপ্ত শুকনা খাবারের ব্যবস্থা রাখা আছে।’

http://www.dailysangram.com/post/296379-