লালমনিরহাটে বিপন্ন বন্যা দুর্গত মানুষ -সংগ্রাম
১৬ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৩:৪০

খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে লাখ লাখ বন্যার্ত

* আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ-গবাদিপশু এক সঙ্গে
* তিন-চারদিনের মধ্যে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশংকা
 টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে প্রতিমুহূর্তই বাড়ছে নদীর পানি। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন স্থানে আরো ভেঙ্গে গেছে রক্ষা বাঁধ। ডুবে গেছে হাজার হাজার হেক্টর ফসলী জমি। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। গতকাল মঙ্গলবার জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১৯৮৮ সালের বন্যার রেকর্ড ছাড়িয়ে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও বাসস্থান সংকটে পড়েছে লাখ লাখ বন্যার্ত মানুষ। সীমিতসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ ও গবাদিপশুকে এক সঙ্গে থাকতে হচ্ছে। এদিকে, আগামী তিন-চারদিনের মধ্যে রাজধানী ঢাকার পূর্বাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানিও বাড়তে শুরু করেছে; তবে তা এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, টঙ্গী খাল, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গার পানি সর্বোচ্চ ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। এসব নদীর পানি এখনও বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হলেও আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যে তা বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
যমুনার নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। সে পানি কয়েকদিন পর মধ্যাঞ্চল অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এ কারণে আগামী ৩-৪ দিন পর থেকে মধ্যাঞ্চলের পানি বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি গতকাল বলেন, বাহাদুরাবাদে যমুনার পানি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সে পানি কমতে শুরু করেছে। যমুনার পানি যেহেতু মধ্যাঞ্চলে আসে, সে কারণে একটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
এবারের বর্ষায় দ্বিতীয় দফার বন্যায় সারা দেশে ২০টি জেলা এখন কবলিত বলে সরকার জানিয়েছে, এর অধিকাংশ জেলাই উত্তরাঞ্চলের। মোট ৬ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী হয়ে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। উত্তরের পানি মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে বলে মধ্যাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সেক্ষেত্রে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গার পানি ঢাকা পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ডেমরায় বালু নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার, শীতলক্ষ্যার পানি নারায়ণগঞ্জে ১১ সে.মি., মিরপুরে তুরাগ নদীর পানি ৮ ও টঙ্গী পয়েন্টে টঙ্গী খালের পানি ৫ সে.মি. বেড়েছে। এছাড়া কালীগঙ্গা নদীর পানি তরাঘাট পয়েন্টে ২৫ সে.মি., ধলেশ্বরী জাগির পয়েন্টে ১৯ এবং রিকাবী বাজার পয়েন্টে ৬ সে.মি. এবং বংশী নদীর পানি নয়ারহাট পয়েন্টে ৮ সে.মি. বেড়েছে।
বুড়িগঙ্গার পানি ঢাকায় এখনও বিপদসীমার ১৩৮ সে.মি. নিচে বইছে। বালু বিপদসীমার ৭৫ সে.মি., শীতলক্ষ্যা ৫০ সে.মি., তুরাগ ৮৮ সে.মি., টঙ্গী খাল ৬৮ সে.মি. নিচ দিয়ে বইছে। এছাড়া কালীগঙ্গার পানি তরাঘাটে ৯৩ সে.মি., ধলেশ্বরী নদীর পানি জাগির পয়েন্টে ১৫১ ও রিকাবীবাজারে ৮৮ সে.মি. এবং বংশী নদীর পানি নয়ারহাটে বিপদসীমার ১৯১ সে.মি. নিচে বইছে।
মাঝারি বা ভারি বৃষ্টি হলে পুরো রাজধানী শহরই তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় খালবিল ও প্লাবনভূমি ভরাট করে প্রচুর আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠায় এবার বন্যা পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ফলে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলের ৪০ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেমরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ৩১ কিলোমিটার এলাকায় অন্তত ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সবগুলো নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই পানি পুরান ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী নদীপথে ঢাকা এবং চারপাশের নদীগুলোয় ঢুকবে। নদীগুলোর পানি এখন পর্যন্ত বিপদসীমার নিচে রয়েছে। তবে দ্রুত বিপদসীমার ওপরে উঠে যেতে পারে। আগামী ২১ আগস্ট অমাবস্যার কারণে পানি বঙ্গোপসাগরে যাবে ধীর গতিতে। ফলে এই পানি সরতে সময়ও লাগবে।
পাউবোর ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৮ সালে ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপরে উঠে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের পানি নদীতে না গিয়ে উল্টো নদীর পানি নিম্নাঞ্চলে চলে আসে। ওই সময় পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে ছিল। এবারও সে রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নদীর পানি অনেক বাড়ার কারণে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ত্রিমোহিনী, দাসেরকান্দি, ফকিরখালী, বেরাইদসহ আশপাশের এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে। এসব এলাকা সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থার বাইরে। বর্ষাকালে প্রতিবছরই এসব এলাকা পানিবদ্ধ থাকে। এর বাইরেও ডেমরার আমুলিয়া, পাইটিসহ আশপাশের এলাকা এবং বাসাবো, মাদারটেক, নন্দীপাড়া ইত্যাদি এলাকা বন্যার কবলে পড়তে পারে। গত সপ্তাহের বৃষ্টিতে এসব এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৯৮৮ ও ’৯৮-এর বন্যার সময় এসব এলাকায় আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন ডেমরা, আমুলিয়া, মান্ডা, বেরাইদ, সাঁতারকুল প্রভৃতি এলাকায় অন্তত ২৫টি বেসরকারি আবাসন প্রকল্প হয়েছে। পানি ধারণের নিচু জায়গা ভরাট করে এসব আবাসন প্রকল্প উঠেছে। ফলে নদীর পানি বাড়লে আগের তুলনায় আরও দ্রুতগতিতে এসব এলাকা তলিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যেভাবে আবাসন প্রকল্পগুলো হয়েছে, তাতে করে বন্যা হলে নিম্নাঞ্চলের অনেক মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করবে। অনেকে ঘর থেকেও বের হতে পারবে না। এসব এলাকার মানুষ পানি আসার আগেই যেন নিরাপদ জায়গায় চলে যায়, সে বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া উচিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক, পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা করতে হলে অন্তত ৪৫ শতাংশ (৬০ বর্গকিলোমিটারের মতো) খালি জায়গা ও জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। নিচু জায়গা ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) মানচিত্রে আছে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি।
উত্তরের কয়েকটি জেলায় পরিস্থিতির আরো অবনতি : বাসস জানায়, টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে গেছে উত্তরের ২০টি জেলা। গত দুই দিনে বন্যায় ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি নদী রক্ষা বাঁধ। বন্যায় বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। তবে বেসরকারিভাবে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘন্টায় অব্যাহত থাকবে। গতকাল সকাল ৯ টা পর্যন্ত গত চব্বিশ ঘন্টায় পানি পর্যবেক্ষণের ৯০ টি পয়েন্টের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৬ টি পয়েন্টে এবং হ্রাস পেয়েছে ৩২ টি পয়েন্টে। এরমধ্যে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৩০ টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত ১ টি ও তথ্য পাওয়া যায়নি ১ টি পয়েন্টের। এর মধ্যে যমুনার কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমার সবচেয়ে বেশি উপর দিয়ে (১৩৫ সে.মি.) প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহে পানি হ্রাস পেয়েছে।
এদিকে নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা। ছোট যমুনা নদীর ফ্লাড ওয়ালের আউটলেট দিয়ে পানি প্রবেশের ফলে নওগাঁ শহরের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শহরের বন্যাপ্লাবিত মহল্লাগুলোর রাস্তাসহ বাড়িঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় এসব এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমোর-এ তিনটি নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। এ জেলার ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
১৯৮৮’র রেকর্ড ছাড়িয়ে যমুনার পানি : জামালপুুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১৯৮৮ সালের প্রলংকরী বন্যার রেকর্ড ছাড়িয়েছে যমুনা নদীর পানি। গতকাল সকালে এই পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় এই পয়েন্টে পানি ছিল বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপরে।
এদিকে নতুন করে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে জামালপুর সদর ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। মাদারগঞ্জের চাঁদপুর-নাংলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দেড়শ’ মিটার ভেঙে এই উপজেলার ১৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সবমিলিয়ে জেলার ৭টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন।
ইসলামপুর রেল স্টেশন মাস্টার আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে গিয়ে জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো.আব্দুর রাজ্জাক জানান, বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এ পর্যন্ত ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় কাজ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে। ভেঙে পড়েছে স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে বন্যা দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে।
এছাড়া যমুনার পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দুই-তিন দিনের মধ্যে একশ’ বছরের রেকর্ড ভঙ্গের আশঙ্কা করবে জানিয়ে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়ায় চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী লোকালয়ে পানি ঢুকে শত শত ঘরবাড়ি ডুবে গেছে।
এদিকে যমুনায় অস্বাভাবিক হারে পানি বাড়ায় জেলার সদর, চৌহালী, কাজীপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি, কাওয়াকোলাসহ বিভিন্ন এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যা কবলিত মানুষগুলো গবাদি পশু ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছে। নৌযানের অভাবে তারা নিরাপদ আশ্রয়েও যেতে পারছে না। যমুনার প্রবল ¯্রােতের কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে।
এদিকে সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানিয়েছেন, বন্যা মোকাবিলায় সিরাজগঞ্জ ত্রাণ অফিস সব সময়ের জন্য প্রস্তুত। বন্যা মোকাবিলায় জেলায় ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। বন্যা কবলিতদের জন্য ১৭০ মেট্টিক টন চাল ও সাড়ে ৮ লাখ টাকা মজুদ রাখা হয়েছে।
‘আইজ হামরা কোনো খাই নাই বাহে’ : ‘আইজ হামরা কোনো খাই নাই বাহে, বাসি মুখত আছি’ -কথাগুলো বন্যার্ত মহসেনা বেগমের। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই মহসেনা নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের সৈয়দপুর কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। সেখানেই আছেন আরেক বন্যার্ত ছাবেদুল ইসলাম (৩৮)। বললেন, ‘যেদিন খাবার পাও, সেদিন সবায় একসাথে দেয়। তার বাদে মেলা খাবার নষ্ট হয়। আইজ সকাল থাকি কোনো খাওনাই, কাহো দেয়ও নাই।’ গতকাল সকালে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে মানুষের এমন দুর্দশা দেখতে পেয়েছেন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা।
সৈয়দপুর কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে প্রায় তিনশ’বন্যার্ত মানুষ। ওই কেন্দ্রে মানুষ আর গরু-ছাগল একসঙ্গে রয়েছে। গতকালও আশ্রয়কেন্দ্রের আঙিনায় হাঁটুপানি। একই অবস্থা দেখা যায়, শহরের কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাশিরাম ইউনিয়নের হাজারীহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রেও।
হাজারীহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ লুৎফর রহমান চৌধুরী জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি রান্না করা খাবার বন্যার্ত মানুষকে দিচ্ছেন।
কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনামুল চৌধুরী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি বরাদ্দ কম মেলায় জনপ্রতিনিধিদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।
সৈয়দপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার জন্য ১৫ মেট্রিক টন চাল ও ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বজলুর রশীদ জানান, আজ বুধবার এসব তালিকা অনুযায়ী বিতরণ করা হবে।
সৈয়দপুর উপজেলা প্রকৌশলী আবু মোহাম্মদ সফিউল আযমের তথ্য মতে, বন্যায় পৌরসভাসহ পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ছয় কোটি টাকার সড়ক অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি নামার পর প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
সৈয়দপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপা রানী বিশ্বাস বলেন, উপজেলার প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হোমায়রা মন্ডল বলেন, রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
পদ্মার ভাঙনে বিলীন চরভদ্রাসনের ২৯টি বসতভিটা : টানা বর্ষণে পদ্মা নদীর ভাঙনে ফরিদপুর চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গীতে বিদ্যুতের খুঁটিসহ ২৯টি বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে থাকা দিশেহারা মানুষগুলো এখন আশ্রয় নিয়েছে সরকারি রাস্তার ওপর। এছাড়া ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে একই ইউনিয়নের মোল্লাডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফাজেল খাঁরডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বড় বালিয়াডাঙ্গী, এম কে ডাঙ্গী গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার।
গত সোমবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুলতান মাহমুদ ভাঙন কবলিত স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, চরভদ্রাসনকে ভাঙন হতে স্থায়ীভাবে রক্ষা করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়া স্থান আমি দেখে এসেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সদর ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ খান জানান, নতুন করে ভাঙন কবলিত স্থানের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ পর্যন্ত ২৯টি বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ৫৩টি বাড়ি। প্রায় এক হাজার মিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট ব্যুরো : গত ৬ দিনে টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করছে। সুরমা নদী উপচে পানি নগরীতে ঢুকছে। উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন নগরবাসী। সুরমা নদীর পানি নগরীর বিভিন্ন নালা ও খালে ভিতর দিয়ে ঢুকে নগরীর কুয়ারপার, শেখঘাট, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, খরাদিপাড়া, কুমার পাড়া, সোবহানীঘাট, উপশহর, দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই, ভার্থখলা, কায়েস্থরাইল ও মুছারগাওয়ে হাজারো মানুষ পানিবন্দী। সুরমা ও কুশিয়ারার পানিতে ডুবছে নগর, ডুবছে গ্রাম। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সুরমা ও কুশিয়ারা তীরবর্তী মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।এদিকে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার ৩/৪ টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তীত রয়েছে। গত বৃহষ্পতিবার থেকে টানা ৬ দিনে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রায় আড়াই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ রয়েছেন পানি বন্দী।
গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সাথে সিলেট শহরের যোগাযোগের একমাত্র ও প্রধান সড়ক সালুটিকর-গোয়াইনঘাট, সারী-গোয়াইনঘাট রাস্তা বিচ্ছিন্ন ভাবে পানিয়ে তলিয়ে যাওয়ায় শনিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উপজেলার নন্দীরগাও, তোয়াকুল, রুস্তুমপুর, পশ্চিমজাফলং, পূর্বজাফলং, আলীরগাঁও, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ীসহ ফতেহপুর ইউনিয়নের ১৮ টি গ্রামের মানুষ সম্পূর্ণ পানিবন্দী রয়েছেন। ইতোমধ্যে জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৮ টন জি.আর চাল ত্রাণের জন্য বরাদ্ধ করা হয়েছে।
সোমবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী বন্যার্তদের মধ্যে এসব চাল বিতরণ করেন। তিনি জনসংখ্যানুপাতে ত্রাণের চাল কম হওয়ায় ডৌবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফ ইকবাল নেহালকে সাথে নিয়ে ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের ৪’শ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
অপরদিকে তোয়াকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খালেদ আহমদকে সাথে নিয়ে ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের ৪’শ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুব আহমদকে সাথে নিয়ে ইউনিয়নের ৩ টি ওয়ার্ডের ৪’শ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
রুস্তুমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন শিহাব তার ইউনিয়নে ৩ টি ওয়ার্ডের ৪’শ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস কামরুল হাসান আমিরুল তার ইউনিয়নে ৩ টি ওয়ার্ডের ৪’শ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। উল্লেখ্য চলতি বছরের মার্চ থেকে গোয়াইনঘাটে বারবার বন্যা হওয়ায় সম্পূর্ণ রূপে ৬ হাজার ৮’শ হেক্টর জমির বুরো ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় বর্তমানে বন্যার কারণে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর রোপা আমন ও ৫’শ একর বীজতলা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। তবে উপজেলা কৃষি অফিসার জানান ‘বর্তমানে উপজেলার ৩ হাজার হেক্টর রোপা আমন ও ২০০ হেক্টর আমন বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে।’
নেত্রকোনা সংবাদদাতা : নেত্রকোনায় জেলায় ক্রমশ বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমতে থাকায় বানভাসি মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। দুর্গত মানুষের মাঝে ফিরে আসছে কিছুটা স্বস্তি।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাক্কলনিক শাহ্জাদা নূর উদ্দিন চৌধুরী জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর পানি কমেছে ৭০ সেন্টিমিটার। এ নদীতে এখন পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে। পূর্বধলার জারিয়া কংশ নদে কমেছে ১৫ সেন্টিমিটার। তবে, এখানে এখনো পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ১৬২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। কলমাকান্দার উব্দাখালি নদীতে কমেছে ৫৭ সেন্টিমিটার। এখানে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।
জেলা প্রশাসক ড. মো. মুশফিকুর রহমান জানান, বিগত কয়েক দিনের অবিরাম ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, নেত্রকোনা সদর ও বারহাট্রা উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের প্রায় ১ লক্ষ ২১ হাজার মানুষ বন্যায় কবলিত হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২ লক্ষ টাকার শুকনো খাবার ও ২৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
বগুড়া অফিস : ভারত থেকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা পানির চাপে বগুড়ার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্বক অবনতি হয়েছে। হুহু করে বাড়ছে যমুনা নদীর পানি। প্রতি ঘন্টায় এক সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। বর্তমানে যমুনা নদীর পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানিয়েছে।
জেলা ত্রাণ অফিসের তথ্যমতে, নতুন করে সৃষ্ট বন্যায় জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৮৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ২৫ হাজার ৯৮২ টি পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ। এরমধ্যে সারিয়াকান্দিতে ১৮ হাজার ৯৩৭টি, সোনাতলায় ৪ হাজার ৮০৫টি এবং ধুনটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ২৪০টি পরিবার। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম আবু হেনা জানান, বন্যাদুর্গতদের এজন্য এপর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৫০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ১ লাখ টাকা, সোনাতলায় নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং ধুনটে ২০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসেন আলী জানান, ইতোমধ্যেই তিন উপজেলায় মোট ৭৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। একারণে সারিয়াকান্দিতে ৫৪টি, সোনাতলায় ১৪টি এবং ধুনটে ৫টি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, দ্বিতীয় দফা বন্যায় ফসলের ব্যপক ক্ষতির আশংকা আছে। ইতোমধ্যেই এই অঞ্চলের ৪হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলে গেছে। উল্লেখযোগ্য ফসলের মধ্যে আউস ৭১৫, আমন বীজতলা ২০, রোপা আমন ৩৯৭২, শাকসবজি ১২৮ হেক্টর।
সিরাজগঞ্জ থেকে আবদুস সামাদ ঃ সিরাজগঞ্জে থেমে ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ী ঢলে সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গত ২৪ ঘন্টায় ১৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ২ শত ৫৬ টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই ১৫৬ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র গুলিতে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০ জন বানভাসী মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। ইতোমধ্যেই নদী তীরবর্তী অনেক নীচু এলাকা পানিতে তলীয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান যমুনার পানি বৃদ্ধি একশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তিনি আরো জানান, জেলার মোট ৭৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ৬/৭ কিলোমিটার ঝুকির মধ্যে রয়েছে। সেনাবাহিনী ইতিপুর্বে বাহুকাতে মেরামতকৃত বাঁধ এলাকায় কারিগরি সহযোগীতা দিচ্ছে।
মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী, সিংড়া (নাটোর) : নাটোরের সিংড়ায় বন্যার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আত্রাই নদী ও চলনবিলে গত দুদিনে অস্বাভাবিক ভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্য নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৩১ সে:মি: উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে পৌরসভার কয়েকটি মহল্লায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। মহেশচন্দ্রপুর মহল্লায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুকিপূর্ণ। সেখানে যে কোন সময় ধসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সকালে মহেশচন্দ্রপুর মহল্লা পরিদর্শন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি। পরে তিনি পৌর শহরের গাইনপাড়া এলাকাও পরিদর্শন করেন। এসময় উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক, পৌরসভার মেয়র মো: জান্নাতুল ফেরদৌস, ইউএনও নাজমুল আহসান, পিআইও সৈয়দ আরিফ্লু ইসলাম, সিংড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ সহ সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে কতুয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে পানি ঢুকায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবার উপক্রম। উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল আহসান বলেন, বন্যার পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারিভাবে আমাদের সব রকম প্রস্তুুতি রয়েছে।
মোঃ লাভলু শেখ, লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। তিস্তার পানি কমে দোয়ানী পয়েন্টে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় বিপদসীমার ৫০সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পাউবো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। তবে বানভাসিদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। জেলার কয়েকটি দুর্গত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করলেও এখনো পানিবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে ৫ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক পরিবার। পানিবন্দী লোকজনের মাঝে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার ও গো-খাদ্যও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী পরিবার গুলোর মাঝে এ পর্যন্ত ২ শত ৪২ টন চাল ও ৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হলোও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল্য বলে জানিয়েছেন বন্যা কবলিত পরিবার গুলো । তারা জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অনেক দুর্গত এলাকায় এখনো সরকারী কিংবা বেসরকারি ভাবে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে পানির নীচে। ঝুঁকিতে রয়েছে মহাসড়কের একাধিক ব্রীজ ও রেলপথ। এখনো বন্ধ রয়েছে বুড়িমারী সাথে রেলপথ যোগাযোগ। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ জানান, ইতোমধ্যে সারা জেলায় ২ শত ৪২ টন চাল ও ৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকাসহ শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায় ক্রমে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখা হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। লালমনিরহাট রেলবিভাগ জানান সকাল থেকে যথা নিয়মে ট্রেন চলাচল করেছে।
রাজশাহী অফিস : রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ভীমনগর নামক স্থানে শিবনদীর বেড়ি বাঁধ ভেঙার পর এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রতি ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ¯্রােতের তোড়ে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে যাচ্ছে শত শত বিঘা আবাদি জমি। এতে মোহনপুর ও তানোর উপজেলার ৬০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বেড়ি বাঁধ এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্রবল ¯্রােতে হু হু করে পানি ঢুকতে দেখা যায়। ওই পয়েন্টে থাকা একটি গভীর নলকূপের কাজে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক খুঁটি বিলমাইল বিলে তলিয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত মোহনপুর উপজেলার ধুরোইল ইউনিয়নের ভীমনগর, লক্ষীপুর, পালসা, খানপুর, মজলিশ বাড়ি, মল্লিকপুর, পিয়ারপুর এবং ঘাষিগ্রাম ইউনিয়নের মহিষকু-ী, শ্যামপুর, আতা নারায়নপুর, ঘাষিগ্রাম, পাইকপাড়াসহ দুই ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। পাশাপাশি তানোর উপজেলার ১০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে মোহনপুর উপজেলার বাকশিমুইল, জাহানাবাদ, রায়ঘাটি, মৌগাছি ইউনিয়নসহ পশ্চিম বাগামারা। এখনই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে এই গ্রামগুলোতেও শিবনদীর পানি ঢুকে প্লাবিত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, বেড়ি বাঁধের ওই পয়েন্টে প্রবল ¯্রােতে পানি ঢুকছে। ¯্রােতের তোড়ে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই মুহূর্তেই নিতে পারছেন না তারা। তবে এজন্য বালি ভর্তি জিও ব্যগ তৈরী করা হচ্ছে। স্রোত একটু কমলেই বস্তা ফেলে মেরামতের কাজ শুরু করা হবে। মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, ভীমনগর বেড়ি বাঁধ ভেঙে এই পর্যন্ত ৬৭৯ বিঘা জমির ফসল প্লাবিত হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শিবনদীর বেড়ি বাঁধের স্লুইসগেট দিয়ে পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ করে বিশ্বজিৎ নামের এক ব্যক্তি বিলমাইল বিলে মাছ চাষ করছিল। এর ফলে বন্ধ থাকা সুইস গেটের পাশ দিয়ে ছোট ছোট গর্ত দিয়ে পানি বের হতে থাকে। এরই মধ্যে কয়েকদিনের ভরী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নদী ফেঁপে গিয়ে ওই স্থানটি পানির চাপে ভেঙে যায়।
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী : বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গতকাল থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১শ’ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৭ সে.মি. ও সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
গাইবান্ধায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পনিবন্দী : ত্রাণের জন্য হাহাকার : গত ৫ দিনের টানা বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পানি বৃদ্ধির ফলে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, করতোয়া নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও বিস্তীর্ণ চর এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা এবং গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৪০ ইউনিয়নের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পনিবন্দী হয়ে পড়েছে।
পাশাপাশি এসব এলাকার রোপিত আমন ক্ষেত, বীজতলা, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলী জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
সোমবার সকাল পর্যন্ত (গত ২৪ ঘন্টায়) ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং ঘাঘট নদীর পানি ৬৪ সেন্টিমিটার এবং করতোয়া নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে বন্যকবলিত এলাকায় সরকারী ভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বিতরণ দেখা যায়নি ফলে বন্যা কবলিত মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রান্না করার শুকনো জায়গার অভাবে অনেকের দিন কাটছে অনাহারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, জেলার প্রায় ৭৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ফুলছড়ির সিংড়িয়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ১০টি পয়েন্টে লিকেজ দেখা দেয়। বালির বস্তা এবং বাঁশের পাইলিং করে ওই স্থানগুলো রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঠিকাদারের শ্রমিক ছাড়াও রংপুর-৬৬ ডিভিশনের সেনা বাহিনীর ৮৫ জনের একটি টিম ওইসব স্থানগুলোতে কাজ করছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ওইসব ইউনিয়নের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ডুবেছে ৩২ হাজার ৫৫টি। ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ৬৯টি। এইসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছে প্রায় ৬ হাজার জন মানুষ। এছাড়া বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ ও ধ্বসের আশঙ্কা থাকায় বাঁধ সংলগ্ন লোকজনকে তাদের স¤পদ নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে।
এ দিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামদিয়া ,গুমানীগঞ্জ, দরবস্ত , তালুককানুপুর , নাকাই , হরিরামপুর , মহিমাগঞ্জ ও শালমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ছাহেরা বানু জানান, টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে পানির নিচে তলিয়ে গেছে এলাকার ৩ হাজার ২৫০ হেক্টর আমন ফসল। সেই সাথে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ও গবাধী পশু পানিবন্দী হয়ে পরেছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কন্টোলরুম থেকে জানিয়েছেন করতোয়া নদীর পানি কাটাখালী ও তরফমনু পয়েন্টে বিপদ সীমার ৩০ সে:মি: উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গোবিন্দগঞ্জ - ঘোড়াঘাট সড়কের তরফমনু নামক স্থানে সড়কটি যে কোনো সময় ভেঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন ধারণা করছেন।
এ দিকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের করতোয়া নদীর উপর কাটাখালী ব্রীজটি হুমকির মুখে রয়েছে। যে কোনো সময় ব্রিজটি দেবে অথবা ভেঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশংকায় আতংকিত এলাকাবাসি।
এ ছাড়াও পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে নদী ভাঙ্গন। ইতি মধ্যেই নদীর তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙ্গনে অর্ধশত বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
পতœীতলা (নওগাঁ) সংবাদদাতা : নওগাঁর পতœীতলায় গত ৫ দিনের ভারি বর্ষণে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পতœীতলা উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মিরাপুর বৈরাগীপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, গোপীনগর, পানবোরাম, চকবল্লভ, বিষ্টপুর, কনচিপুকুর সহ কয়েকশত গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যায় পানিবন্দী মানুষেরা তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে স্কুল, মাদ্রাসা, রাস্তা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর ঝুঁকিপূর্ণভাবে আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দী মানুষেরা অভিযোগে জানায় চাউল আটাসহ খাবার সবকিছু পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। অনুসন্ধান করে জানা গেছে বর্তমান বন্যা কবলিত এলাকাগুলিতে শিশু বৃদ্ধসহ অনেকের জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়াসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে। এছাড়া হাজার হাজার বিঘা জমির ফসল বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে ও শত শত পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দী মানুষেরা অভিযোগে আরো জানায় এখনো কোনো ত্রাণ সামগ্রী আমরা পাইনি। বন্যা কবলিত এলাকাগুলিতে খাবার সালাইন বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে পতœীতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল মালেক এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বন্যা দুর্গতদের মাঝে দ্রুত ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো হবে। এ ব্যাপারে নওগাঁ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি রক্ষার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিযে যাচ্ছি। খোলা আকাশের নিচে বন্যা কবলিত নারী পুরুষেরা ত্রাণ সামগ্রীর আশায় পথ চেয়ে রয়েছে।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দিনাজপুর : দিনাজপুরের বন্যায় এ পর্যন্ত মোট ২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। ৪ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার বিকাল থেকে শহরের উত্তর প্রান্তের বিভিন্ন এলাকার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তা খুবই ধীরে ধীরে কমছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তবে শহরের দক্ষিন প্রান্তের বিভিন্ন এলাকা নতুনভাবে প্লাবিত হবারও খবর পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার উপশহর এলাকাসহ সদরের গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা নতুনভাবে প্লাবিত হয়েছে। এবারের ভয়াবহ বন্যায় শহরের দু’য়েকটি এলাকা ছাড়া পুরো দিনাজপুর শহর পানির নীচে তলিয়ে যায়। সেই সাথে শহরের বালুবাড়িস্থ বিদ্যুৎ কন্ট্রোল রুমে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ থাকায় সোমবার থেকে পুরো শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় পানি নিষ্কাশন পর সীমিতভাবে বিদ্যুৎ চালু করা হয়। ভয়াবহ এ বন্যায় দিনাজপুরে ৪ দিনে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুম।
জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুম প্রধান এবং জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা মোখলেছার রহমান জানান, দিনাজপুরে বন্যায় এ পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দিনে বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জে ৫ জন এবং রাতে চিরিরবন্দর উপজেলার ৪ জনের মৃত্যুর পর এ সংখ্যা দাঁড়ায়। এর মধ্যে বীরগঞ্জ উপজেলায় মো. আমানুল্লাহ (১০) এবং আমির হামজা (৫) নামে ২ জন পানিতে ডুবে, নবাবগঞ্জ উপজেলায় মতিয়ার রহমান (৬০) পানিতে ডুবে ও জনাব আলী (৬৫) নামে অপর এক ব্যক্তি দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছে এবং বিরল উপজেলার মাটিয়াইন গ্রামে পানিতে ডুবে এক কন্যা শিশু মারা গেছে। এর আগে রোববার দিনাজপুরে মারা যায় ১৩ জন। এছাড়া হুমায়ুন (১৫) নামে এক কিশোর নিখোঁজ রয়েছে। এদিকে টানা বর্ষণ ও উজানের পানিতে সৃষ্ট স্মরণকালের বন্যায় দিনাজপুরের ৪৩০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ২৬৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৬৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ। অন্যদিকে দিনাজপুরে বন্যাদুর্গত ৫শ’ পরিবারের জন্য ত্রাণের শুকনো খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী এসেছে। দুর্গতদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ৫০ লাখ টাকা ও ৩০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর এ সামগ্রী এলো। যা এলাকার দূর্গত মানুষের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চারিদিকে হাহাকার শুরু হয়েছে। দুর্গত মানুষ এখন খোলা আকাশের নীচে উচু স্থানে অবস্থান করছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়ছে। পানি কমতে শুরু করলেও জমে থাকা পানিতে নানা রোগ-জীবানু থাকায় পানিতে বেড়িয়ে মানুষের বিভিন্ন ঘা-পাচড়াও হতে শুরু করেছে। এদিকে বানভাসি মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ায় বাসা-বাড়িতে ছিচকে চোরের উপদ্রপ বেড়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে চুরি হবার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও কিছু পাওয়া যাচ্ছে তার দাম আকাশ ছোয়া হয়ে গেছে। একটি পন্য আসলেই বেশি টাকা দিয়ে হলেও মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/296240-