আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। উজানের পাহাড়ি ঢল প্রলয়-রাক্ষসের মতো নেমে এসেছিল বাংলাদেশের জনপদের ওপর দিয়ে। বৃষ্টি আরও হবে। উজানের ঢলের তো কেবল শুরু। আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন যে, এ বছর গত ২০০ বছরের মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ বন্যা হবে এই জনপদে। বাংলাদেশে নেমে আসবে সর্বগ্রাসী ঢল। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এই জনপদের মাঠের ফসল, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ। আর নেবে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। তার আলামত এখনই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ষাট বছরের মধ্যে বেশি পানি প্রবাহিত হচ্ছে যমুনায়। প্রলয়ঙ্করি যমুনা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দু কূলে যা পাচ্ছে, সব কিছু। যমুনার কী দোষ। সে আর ধারণ করতে পারছে না বৃষ্টি ও উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি। পারছে না, কারণ তার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ভরাট হয়েছে, কারণ আমরা সারা বছর এই নদীকে নব্য রাখতে পারিনি। যদি পারতাম, তা হলে এর তলদেশে জমতে পারত না মিটার মিটার পলি। ভারতের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিতে দিতে আমরা নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে পারিনি। নদী তো রুখে দাঁড়াবেই। তার ওপর এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নদী তো নেবেই। নিচ্ছে।
ভারতের কী চাই, কী চাই না, আমার তো তা দেখার কথা ছিল না। আমি আমার নদীর নব্যতা চাই। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ চাই। চাই, পলিগুলো ধুয়ে চলে যাক বঙ্গোপসাগরে। নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা অটুট থাকুক। আমাদের শাসকরা মসনদের মোহে উজানের দেশ ভারতকে তোষণ করতে সব অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। ভারত একতরফাভাবে আমাদের নদ-নদীগুলোর পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমরা তা হতে দিয়েছি। একমাত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কেউ নদ-নদীগুলোর পানি ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। কিন্তু এই পানি ছিল আমার অধিকার, কোনো দয়ার দান নয়। ফলে ফুঁসে উঠেছে নদী, প্রকৃতি। শুধু যমুনা কেন, পদ্মা তো এখন চেনাই যায় না। এক সময় প্রমত্তা ছিল পদ্মা। এখন শুধুই ধূ ধূ বালুচর। বাংলাদেশের যে মানুষটার বয়স ৪০, তিনি জানেনও না পদ্মার কী তীব্র প্রবল প্রমত্তা রূপ ছিল। তার কাছে এটা গল্পের মতো শোনাবে। আসলে আমাদের শাসকরা সত্যকে গল্প বানিয়ে ফেলেছেন। পদ্মাও প্রতিশোধ নেয়। বানের পানির ঢল যখন নেমে আসে, তখন সে দু কূলে যা কিছু পায় তচনছ করে দিয়ে যায়।
প্রকৃতির প্রথম প্রতিশোধের ধাক্কাটি এবার এসেছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর সিলেটে ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে। ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোটা হাওড় এলাকা। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙেছে। হাওরের ফসল গেলো। মাছ গেলো। সাজানো সংসার গেলো। পানিবন্দী বিপন্ন হয়ে পড়লেন লাখ লাখ মানুষ। পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে শুরু করলেন তারা। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। সরকার ত্রাণের নামে মানুষের সঙ্গে তামাশা করলো। এই সরকারের লুঠেরা চরিত্র কারও কাছে অজানা নয়। ত্রাণেও করা হলো চরম দলীয়করণ। কিন্তু তাও ছিল লোক দেখানো। হাজার হাজার মানুষ গলা পানিতে দাঁড়িয়ে সরকারি ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু শ’ খানেক লোককে ত্রাণের প্যাকেট দিয়ে কেটে পড়লো সরকারি লোকেরা। লুট হয়ে গেলো সব। একজন বলেছিলেন, তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন বানে। কিন্তু কোনো ত্রাণ পাননি। কেন তিনি এমন অভিযোগ করলেন, সেজন্য সরকারি ষ-ারা তাকে কান মলে কান ধরে উঠবস করিয়েছে। সেই বিপন্ন কান-মলা খাওয়া মানুষটির ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মানবতার এই অপমানের কোনো বিচার হয়নি।
সরকারি গুদামে চাল নেই। ত্রাণমন্ত্রী আর আদালত কর্র্তৃক দণ্ডিত খাদ্যমন্ত্রী এতোটাই অথর্ব যে, তারা এ নিয়ে চিন্তা করারও কোনো ফরসুত পাননি। বা এতো সব দুর্নীতি তাদের নাড়া দেয়নি। এখন থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশে চাল কেনার জন্য ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে তারা বিচলিত বলে মনে হয় না। কারণ তারা এখন ব্যস্ত আছেন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে। শুনেছিলাম, আমরা নাকি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে রফতানি শুরু করেছি। এখন প্রমাণিত হলো, তার সবই ছিল ধোকা। চাল নেই। চাল যে গুদামে নেই, সে বিষয়ে আদালতে দ-িত খাদ্যমন্ত্রী অবহিত ছিলেন বলে মনে হয় না। তা হলে আগেই তার টনক নড়তো। তিনি ব্যস্ত ছিলেন ও আছেন বিএনপিকে গালাগাল করতে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর অবস্থা আরও করুণ। এই যে সারাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে, তাদের আশ্রয় নেই, খাদ্য নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। দিনাজপুরের মতো যে সব শহর কোনোদিন সেখানে পানি দেখেনি, আজ সেখানে কোমর পানি হয়ে গেছে। এ বিষয়ে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। এলাকায় এলাকায় মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে জীবন যাপন করছেন নৌকা কিংবা ভেলায়। কিন্তু দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। খাদ্যমন্ত্রীর কাজও একই। তিনি শেখ হাসিনার অনুকম্পা লাভের আশায় অবিরাম বিএনপিকে নানা ভাষায় গালাগাল করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ জনগণের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে এরা মোটেও চিন্তিত নন। যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত আছেন সবাই।
এর মধ্যে এসেছে নতুন এক ইস্যু। আর সেটা হলো, সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা। এই ষোড়শ সংশোধনী ছিল বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা। এই সংশোধনীর বিষয়ে আদালতে রীট হয়। তাতে হাইকোর্ট প্রথমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। তা নিয়ে সরকার পক্ষ আপিল করে। সে আপিলের দীর্ঘ শুনানি হয়। আদালতের তরফ থেকে এ বিষয়ে মতামত নেয়ার জন্য দেশের শীর্ষ স্থানীয় সিনিয়র নয় জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিযুক্ত করেন। আপিল বিভাগের সাত জন বিচারপতি ও অ্যামিকাস কিউরিদের একজন বাদে বাকী সকলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মতামত দেন। শেষ পর্যন্ত আদালত চূড়ান্তভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেন। এরপরই যেন সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
গরকার তো নি¤œ আদালত নিয়ন্ত্রণ করে আসছেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তারা উচ্চ আদালতের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য ছিল, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতেই ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে এক সামরিক ফরমানের মাধ্যমে এই ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে স্থানান্তর করা হয়। অতএব সরকারের লোকেরা সরল হিসাব করে ফেলেন যে, ’৭২-এর সংবিধানের চেয়ে সামরিক ফরমান কেন সুপ্রীম কোর্টের কাছে এত প্রিয় হয়ে গেলো। কিন্তু আদালতের সমালোচকরা মাঝখানের খানিকটা অংশ আমাদের ভুলিয়ে দিতে চান। কিংবা তাদের ধারণা, আমরা তা ভুলেই গেছি। ১৯৭২ সালের সংবিধান যদি অতো পবিত্র দলিলই হবে, তা হলে শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালেই তা চারবার সংশোধন করার প্রয়োজন পড়তো না। এর মধ্যে চতুর্থ সংশোধনী ছিল ভয়াবহ। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। যা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল চেতনার বিরোধী। স্বাধীনতা আন্দোলন তো ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে তা রদ করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, কোনো নির্বাচন ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যেন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেনÑ এই বলে। সেই সংশোধনীতে বিচারপতি নিয়োগ বা বরখাস্তের সকল ক্ষমতা এককভাবে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের হাতে ন্যস্ত করা হয়; সংসদের হাতে নয়। আজকে বিচার বিভাগের সমালোচকরা আমাদের এই বাস্তবতা ভুলিয়ে দিতে চান। অর্থাৎ সংসদের হাত থেকে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আওয়ামী লীগই প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করেছিল। তা হলে আজ এই মায়াকান্না কেন।
আবার বলা হচ্ছে, আদালত সামরিক শাসনের ফরমানকে বেশি ভালোবেসেছে। তাই যদি হয়, সামরিক শাসক এরশাদ তো সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছিলেন। সরকার তাকে বেশি ভালোবেসে তা রেখে দিতে গেলো কেন। গালমন্দ যতো পাওয়া যায়, এসব প্রশ্নের জবাব ততো মেলে না। একদিকে বলা হচ্ছে, রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অনুদান-খেকো বিচারপতি খায়রুল হকের পর্যবেক্ষণ বড় ভালো লেগেছিল। মুন সিনেমা হলের মালিকানার মামলায় তিনি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ। তার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সরকার সংবিধান সংশোধন করে সে ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিলেন। তিনজন বিচারপতি এর পক্ষে আর তিন জন বিচারপতি এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। অনুদান- খেকো খায়রুল কাস্টিং ভোট দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায়ে যা বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা একেবারে ওলট-পালট করে দেন। সরকারের সেটি বড় ভালো লেগেছিল।
তবে জাতির এই মুহূর্তের সঙ্কট সেটা নয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায় সকলেই মেনে নিতে বাধ্য। এ কথা আওয়ামী লীগই আমাদের বারবার শুনিয়েছে। কারণ সে সব রায় তাদের অনুকূলে ছিল। আজ রায় পছন্দ হয়নি বলে নানা খিস্তি খেউড় চলছে। কিন্তু সঙ্কট এখন বিপন্ন মানুষ। লাখ লাখ মানুষ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। শীগগীরই বন্যাদুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে ব্যাপকভাবে পানিবাহিত রোগ। তার নিদানের কী ব্যবস্থা আছে, আমাদের জানা নেই। আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস, বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসছে। তাতে পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে আরও মারাত্মক হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি হওয়া বিচিত্র নয়।