১৬ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৩:৩১

৫৭ ধারা ও আইনের অপপ্রয়োগ

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

একজন সিনিয়র আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলাম, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় কী আছে? তার জবাব ছিল, এটি কুৎসা প্রতিরোধবিষয়ক আইন। কেউ যদি অনাকাক্সিক্ষতভাবে কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, তথা মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করে তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এই ধারায় তা বিচার্য বলে বিবেচিত হবে। তার মতে, ৫৭ ধারাটা বহাল থাকা উচিত। কারণ, বাকস্বাধীনতার নামে কারো চরিত্র হননের সুযোগ কাউকে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু এর অপপ্রয়োগটা বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এই আইনজীবী ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। মন্ত্রী কয়েক দিন আগেই এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘৫৭ ধারা বাতিল নয় বরং এর অপপ্রয়োগটা বন্ধ হওয়া উচিত। আবার তথ্যমন্ত্রী দাবি করে বসেছেন, ‘এই ধারা নিয়ে সাংবাদিকেরা উষ্মা প্রকাশ করলেও এই আইনে কোনো সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি।’ অথচ এই ধারায় সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে বলেই গণমাধ্যমে খবর আসছে।
এমনকি, ছাগল মরার খবর শেয়ার করায় খুলনার ডুমুরিয়ার স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক আব্দুল লতিফ মোড়লকে গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে এই আইনেই। তাই এটাকে গণমাধ্যমকর্মীরা ‘কালো আইন’ বলে এর বাতিল দাবি করছেন। এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আইনের অপপ্রয়োগের কারণেই। অপপ্রয়োগের কারণে ‘সাদা’ আইনও যে কালো হয়ে যায়, তা ৫৭ ধারার যথেচ্ছ অপপ্রয়োগই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
দাবি করা হচ্ছে, বর্ণিত ধারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয় কিংবা এই ধারায় সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে না। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এই আইনের আওতায় অনলাইন পোর্টাল বাংলা মেইলের সাংবাদিক শাহাদাত উল্লাহ খান, মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও প্রান্ত পলাশ এবং শিক্ষা ডটকম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের রবিউল্লাহ রবি, রফিক মোহাম্মদ, শাখাওয়াত হোসেন বাদশাহ, শাখাওয়াত হোসেন, আহমদ আতিক ও আফজাল বারী গ্রেফতার হয়েছিলেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই আইনে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা অব্যাহত আছে।
৫৭ ধারায় যারা ভিকটিম, তাদের প্রায় সবাই গণমাধ্যমকর্মী। ‘৫৭’ ধারার এই আইনে বলা হয়েছে, ‘ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশসংক্রান্ত অপরাধ এই ধারায় গণ্য হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তার কারণে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হলে, তা অপরাধ বলে গণ্য হবে’। এই আইনটা যে গণমাধ্যমের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই এ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি অবস্থান যৌক্তিক বলে মনে করছেন না বোদ্ধামহল।
স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন স্বীকৃত নয়, তেমনি আইন প্রয়োগের নামে অপপ্রয়োগও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। স্বেচ্ছাচারিতা ও অপপ্রয়োগ ক্ষমতাহীনদের চেয়ে ক্ষমতাবানেরাই বেশি করে থাকেন।
কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত কারণে কিংবা ভিন্নমতকে দমন অথবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যদি এই আইনের অপব্যবহার হয়, সেটাই মূলত উদ্বেগের। এই আইনের যত প্রয়োগ হয়েছে তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপপ্রয়োগের বিষয়টিই দৃশ্যমান। এসব সমস্যার সমাধান রয়েছে আইন ও সাংবিধানিক শাসন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাঝে।
আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি অপপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে, এর দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এই অপপ্রয়োগ যে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে হয় বা সরকারই পরিকল্পিতভাবে করে, সব ক্ষেত্রে এমনটা মনে করার কারণ নেই। সরকারে সুযোগ সন্ধানীদের অস্তিত্ব আগেও ছিল, এখনও আছে। বরগুনার ইউএনও তারেক সালমনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে মামলা ও পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে, ব্যক্তিগত আক্রোশে সরকারের মধ্যে থাকা অতিউৎসাহী ব্যক্তিরা এই মামলা করেছিলেন। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই একজন আমলা হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হয়েছেন। ফলে শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও আমাদের সম্মানহানি ঘটেছে।
ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। আর এসব অপরাধের সাথে সরকারসংশ্লিষ্টদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। বগুড়ায় নারী ধর্ষণ ও মা-মেয়েকে ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনার প্রধান আসামি শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার। এসব অপকর্ম আমাদেরকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে? আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমন অপরাধ বেড়েই চলেছে। ফলে দেশটা যে অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
সঙ্ঘবদ্ধভাবে এসব অপরাধ করে যাচ্ছে একশ্রেণীর সমাজবিরোধী লোক। এ জন্য তারা সরকারি দলকে প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। এরা নির্বিঘেœ অপরাধ করার জন্য দলকে ‘ছাতা’ হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেই সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। সে সুযোগটাই কাজে লাগায় এসব অপরাধী। ফলে দেশে সুশাসন হচ্ছে তিরোহিত। আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়ে যাচ্ছে সুদূরপরাহত। তাই দেশে এখন তুফান সরকাররা অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সরকার যদি এসব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের মানুষ সরকারকেই ওদের পৃষ্ঠপোষক মনে করবে। আর সরকারসংশ্লিষ্টরা যতই গলাবাজি করুক, নিজেদের এ কলঙ্ক কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না।
সরকারপক্ষ প্রতিনিয়ত দাবি করে যাচ্ছে, তারা দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসনে বিশ্বাসী। বিরোধী দলগুলোর দাবির বিষয়ে তারা সব সময় আইন, সংবিধান ও আদালতের প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা বলে এসেছেন এত দিন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকারসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলে বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু এবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যা বলেছেন তা সচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি সর্বোচ্চ আদালত ও বিচারকদের নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমনও বলেছেন যে, ‘সরকার বিচারকদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। তাই সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার সুযোগ নেই।’ এমনকি তিনি ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে বারবার পাস করার কথা বলেছেন। তার এই বক্তব্যে আদালত অবমাননা এবং সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে বলে মনে করছেন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞরা। সরকারের শীর্ষপর্যায়ে থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও সংবিধানের প্রতি এমন অশ্রদ্ধা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আদালতের রায় নিজেদের অনুকূলে গেলেই গ্রহণযোগ্য হবে আর প্রতিকূলে গেলে তা নিয়ে যথেচ্ছ মন্তব্য করবেনÑ এমনটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলে না। এর আগেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী ও ত্রয়োদশ সংশোধনীও আদালত বাতিল করে দিয়েছিলেন; তখন কিন্তু সরকারের পক্ষে এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, অর্থমন্ত্রী আবেগতাড়িত হয়ে এমন কথা বলেছেন। যদি তাই হয় তাহলে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন বলেই মনে হয়। কারণ, মন্ত্রীরা সব ধরনের আবেগ, অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে কর্তব্য পালনের শপথ গ্রহণ করেন।
সবার আগে আইন মানতে হবে সরকারকেই। তাহলেই দেশের মানুষ আইন ও সংবিধান মানতে অভ্যস্ত হবে। সরকারই যদি আইন ও সংবিধানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে, তাহলে দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না। বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতা যেমন কাম্য নয়, তেমনি ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ কেউ কামনা করে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বেচ্ছাচারিতা স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত আইন ভেঙে দলীয় বিবেচনায় বহু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের অনেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে অন্য ক্ষেত্রে কী হচ্ছে, তা ঠাহর করাও কষ্টসাধ্য নয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই অশুভ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মোট কথা, সবার আগে সরকারকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।
smmjoy@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/244430