১৫ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:২২

রায়ের সংক্ষুব্ধ পক্ষ হিসেবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ কি আইনসঙ্গত?

উচ্চ আদালতে ষোড়শ সংশোধনী বিল বাতিল করে দেয়া রায় ও তার পর্যবেক্ষণ নিয়ে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি এবং অস্বাভাবিক আচরণ জনসাধারণকে চরম বিস্মিত করেছে। কোন রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকারের বিধান আছে। কিন্তু এনিয়ে কোন পক্ষের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আইনসঙ্গত কি না- সে প্রশ্নও উঠেছে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়া এবং এর রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ও অভিমত প্রসঙ্গে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারের নেতা-মন্ত্রীগণ বিচারাঙ্গণ ছাড়িয়ে রাজপথ গরম করা শুরু করেছেন। রায় ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন ফোরামে তাদের এমনকি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত আছে। যা যেকোন বিচারে আদালত অবমাননার শামিল। আইনজ্ঞদের মতে, প্রতিটি রায়ের বিষয়েই সংক্ষুব্ধ পক্ষের প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রিভিউ দাখিল পর্যন্ত অবারিত আছে। কিন্তু সরকারের পক্ষের লোকেরা এর কোন তোয়াক্কা করছেন না। এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনসত্ত্বা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ (৪) এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য-পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ তেমনই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ এ বলা হয়েছে, ‘আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে আর আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত বিধান মানিয়া আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত যেকোনো রায় পুনর্বিবেচনা করিবার এখতিয়ার উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সাথে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের কথা স্বীকার করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির বাসায় গিয়েছিলাম। তার সাথে আমার দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ বা অবজারভেশন ছিল তা নিয়ে আমাদের পার্টির বক্তব্য জানিয়েছি। আরো অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে দীর্ঘক্ষণ।’ তবে আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে কিছু জানাতে চাননি ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘তার (প্রধান বিচারপতি) সাথে আলোচনা হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। আরো আলোচনা হবে, আলোচনা শেষ হয়নি। শেষ হওয়ার আগে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সময় হলে আপনারা সব কিছু জানতে পারবেন, আমিও বলব।’ এদিকে এই বৈঠক নিয়ে রাজনীতি ও বিচারাঙ্গনে তুমুল হৈচৈ ও বিতর্ক চলছে। দেশের বিচারাঙ্গণের অভিভাবক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বৈঠক ব্যাপক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। একটি বিশেষ রায় নিয়ে এধরণের বৈঠক ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে কোথায় নিয়ে যাবে- সে নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈঠকের কথা জানাজানি হলে তাতে চরম উদ্বেগ ও শঙ্কার কথা প্রকাশ করে বিরোধী দল বিএনপি। কেউ কেউ বলছেন, তাহলে কী ভবিষ্যতে এটাকে নজির হিসেবে ব্যবহার করে যে কেউ এমন সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন? কেননা, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং সবারই একই অধিকার পাওয়া উচিৎ। প্রধান বিচারপতির সাথে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বৈঠককে নজিরবিহীন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবীরা। বৈঠকের খবরে চরম উদ্বেগ ও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বাসায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বৈঠক ও নৈশভোজের খবরে আমরা বিস্মিত হয়েছি। কারণ ইতোমধ্যে এরাই (আওয়ামী লীগ) প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে সন্ত্রাস ও সঙ্ঘাতের ভাষায় কথা বলেছেন।’
উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৩ জুলাই বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহালের পক্ষে মত দেন। এরপর ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় কয়েকটি বিষয়ে পর্যবেক্ষণসহ প্রকাশ করা হয়। রায় ঘোষণার পর থেকেই সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে সরকারের পদত্যাগ দাবি তোলে। একদিকে সংসদে পাস হওয়া একটি বিল বিচারে গিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীদের সরকারের পদত্যাগ চাওয়ায় সরকারের ‘ইগো’তে আঘাত করে। রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ও অভিমতও তাদের কাছে অসহনীয় মনে হয়। ফলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েই এর বিরুদ্ধে মাঠ গরম করতে শুরু করে। এখন যদি কোন জবরদস্তির প্রক্রিয়ায় এই ‘অভিমত’ সংশোধিতও হয় তথাপি সরকারের জন্য তা ‘অমোচনী’য়ই থেকে যাবে এবং বিচার বিভাগের জন্যও তা ‘প্রশ্নবোধক’ হয়ে যাবে বলে ভাষ্যকাররা মনে করেন।
এদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ‘অবমাননা’ করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তাও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা খ-ন করেছে। অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা, প্রবীণ আইনজ্ঞ বিশিষ্ট আইনজীবী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্টতম সহযোগী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া বিচার বিভাগের রায়ের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে দেশে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা চলছে। এই প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক। শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদে যেভাবে কথা বলা হয়েছে তা দুঃখজনক। এনিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্যরা নিজে থেকেই প্রমাণ করেছেন যে তারা কতোটা অযোগ্য। যদিও বর্তমান সংসদের বেশিরভাগ সদস্যই বিনাভোটের। এই ভুয়া জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এর বেশি আশা করাও যায় না।’ প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি। এই সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার ক্ষমতা তার মেয়েরও নেই। যারা এখন এই সংবিধান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমাদের চাইতেও বেশি মায়াকান্না দেখাচ্ছেন তাদের অবস্থা ‘মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি’র মতো। এরা না জেনে না পড়ে সমালোচনা করছেন। আর আমাদের পাগল বলছেন। আমার না হয় বয়স আশি বছর। এ কারণে না হয় পাগলই হলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে আরো নয় জন অ্যামিকাস কিউরি (বিশিষ্ট আইনজীবী) এ বিষয়ে আদালতে শুনানিতে অংশ নিয়ে মতামত দিয়েছেন। সাতজন বিচারক ঐকমত্যের ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন- তাহলে কি তারা সবাই পাগল?’ ড. কামাল হোসেন এ ইস্যুতে যারা সমালোচনা করছেন তাদের আরো পড়াশুনা করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘দয়া করে একটু পড়ুন। জানার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে আমাদের সহায়তা নিন। চাইলে আমরা কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব। পড়ার পর সমালোচনা করুন। বাহাত্তর সালে আমি কী বলেছি, আর এখন কী বলেছি, মিলিয়ে নিন। তখনকার বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়- আমি সেটাই বলেছি। অন্যরাও একই কথা বলেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আসলে তারা পড়বেনই বা কখন? তারাতো অনেক ব্যস্ত, পড়ার সময় নেই। তারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে।’
অন্যদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিপক্ষে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে অভিযোগ করেন বিশিষ্ট আইনজীবী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। গত রোববার বিকেলে এক আলোচনা সভায় এ অভিযোগ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আজকে বির্তক তুলে এ রায়কে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সেটা দেশের জন্য হবে ভয়ংকর এবং ভয়াবহ। এর ফলে আপনাদের পতন আরো তরান্বিত হবে বলে আমি মনে করি। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে মওদুদ আহমদ বলেন, একেক মন্ত্রী একেক কথা বলছেন। আমি অবাক হয়ে যাই যে কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ পর্যন্ত চাচ্ছেন। এমন বক্তব্য দিচ্ছেন যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনে মনে হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তারা জনমত সৃষ্টি করছেন, সারা বাংলাদেশে কর্মসূচি দিচ্ছেন। কিসের জন্য? সরকারের প্রতি আহবান রেখে তিনি বলেন, আপনাদের দায়িত্ব হলো সরকার হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। আজকে আপনারা এমন একটা ক্রুসেড শুরু করেছেন যে কী করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, খুব খাটো করা যায়, ছোট করা যায়- সেই প্রচেষ্টায় আপনারা লিপ্ত। এর চাইতে দুঃখজনক আর কিছুই একটি গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/296153-