১৫ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:২১

বিপদসীমার ওপরে ২৪টি নদীর পানি

দেশের বাইরে থেকে নেমে আসা উজানের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে দেশ। আবার প্রাকৃতিক নানা ধরনের বাধায় এ পানি সমুদ্রে নেমে যেতেও দেরী হবে। এতে চলতি বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি ১০ বছর বা এর কিছু আগে-পরে বর্ষাকালটা প্রবল হয়ে উঠে নানা কারণে। এ সময় মওসুমি বায়ু অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। এ বছর বাংলাদেশের উত্তরে ভারত, নেপাল, ভুটান এবং চীনের বিভিন্ন অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় বন্যা হয়েছিল ২০০৪ সালে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর এবার দেশে ব্যাপক আকারের বন্যা হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বিভিন্ন পয়েন্টে ২৭ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত পানি বেড়েছে ৬৫ নদীতে। নদীর কোনো কোনো এলাকায় পানি বিপদসীমার সর্বোচ্চ ১৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর দুই তীরের আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীতে উজান থেকে প্রবল বেগে পানি আসছে। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি আরো তিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অন্য দিকে মেঘনা অববাহিকার সুরমা ও কুশিয়ারায় আরো ২৪ ঘণ্টা পানি বৃদ্ধি হতে থাকবে। আগামী পাঁচ দিন পর দেশের ৫৪ নদীর মধ্যে ৩৭ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। বর্তমানে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দেশের ২৪টি নদী।
বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ বিশ্বব্যাংকের সাবেক পানিবিষয়ক কর্মকর্তা ড. এস আই খান জানিয়েছেন, উজান থেকে যেভাবে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশে পানি প্রবেশ করছে তা একই বেগে বঙ্গোপসাগরে নেমে যেতে পারবে না। এ কারণে এবারের বন্যা হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে পানি পৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ফুট বেশি ওপরে উঠে আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের বেশি উচ্চতার কারণে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার নদীর পানি সহজে সমুদ্রে মিশতে পারছে না। নদীর পানি স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হতে না পারায় নদীতে জমে যাচ্ছে এবং নদীর দুই পাশে বন্যা হচ্ছে। ড. খান বলেন, এ ছাড়া ‘ব্যাক ওয়াটার এফেক্টের’ কারণেও নদীর পানি নিচে নেমে যেতে দেরী হবে। ড. এস আই খান বলেন, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি যমুনা নদীর চেয়ে একটু বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হয়ে থাকে। এ কারণে যমুনা নদীর পানি পদ্মায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, নীলফামারীতে যমুনার পানি নদীর দুই তীর ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
এবার নেপাল ও ভুটানে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে। প্রবল বর্ষণে নেপালের অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় অবস্থিত বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি ঢুকে গেছে এবং এ পানি গঙ্গা দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে রাজশাহী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গঙ্গা নদীতে ১০ শতাংশ পানি আসে চীন থেকে, ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ আসে নেপাল থেকে। পদ্মা গোয়ালন্দে এসে মিলিত হয় যমুনা নদীতে। যদিও এখন পর্যন্ত পদ্মা নদীর দুই তীরে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি তবে মুন্সিগঞ্জের ভাগ্যকূল ও সুরেশ্বরে পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। তবে বন্যার ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর দুই তীরে। এর বাইরে ধরলা, কংস, সুমেশ্বরী নদীর দুই তীরও ডুবে গেছে পানিতে। কুড়িগ্রাম, বদরগঞ্জ, গাইবান্ধা, নূনখাওয়া, চিলমারী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, সিংড়া, বাঘাবাড়ি, এলাসিন, দিনাজপুর, ফুলবাড়ি, ঠাকুরগাঁও, ভূষিরবন্দর, নওগাঁ, মহাদেবপুর, গোয়ালন্দ, কানাইঘাট, সিলেট, সুনামগঞ্জ, অমলশদি, শেওলা, দুর্গাপুর, জারিয়াজাঞ্জাইল এলাকার নদীর বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্র এশিয়ার শক্তিশালী নদীগুলোর অন্যতম। এ বছর চীনের দিকে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ধারার চারপাশে প্রবল বর্ষণের পানি ভারতের অরুনাচল, আসাম হয়ে বাংলাদেশে এসে পড়ছে। আসামে প্রতি বছরের মতো এবারো ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে। এর সাথে ভুটানের ২০টি উপ-নদীর পানিও ব্রহ্মপুত্রে এসে পড়ছে। উজানের বিশাল অঞ্চলের প্রবল বর্ষণের পুরো পানি ব্রহ্মপুত্র বহন করতে পারে না বলে ভারতসহ বাংলাদেশে বন্যা হয়ে থাকে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আসামে যে বন্যা হচ্ছে সেখানে আর নতুন করে পানি যোগ না হলেও সে পানি নিচের দিকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যেতেও কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না হলে। ফলে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র বেসিনে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে সময় লাগবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/244223