১৫ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:১৭

যমুনায় পানি বৃদ্ধিতে রেকর্ড বন্যায় ভাসছে উত্তরাঞ্চল

বন্যায় ভাসছে দেশের উত্তরাঞ্চল। বানের পানিতে একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নদ-নদীর পানি উঠে যাচ্ছে বিপদসীমার ওপরে। দিনাজপুরে রেলপথ ও মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ এবং ঢাকার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামের টগরাইহাট এলাকার বড় পুলেরপাড় সংলগ্ন রেলসেতু দেবে যাওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে কুড়িগ্রামের রেল যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নওগাঁ, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জে ব্যাহত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। কয়েকটি জেলায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হু-হু করে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। উত্তরের কয়েকটি জেলায় বন্যার্তদের সাহায্যে আরও সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
সোমবার ৮ জেলায় আরও ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ৭, দিনাজপুরে ৫, লালমনিরহাটে ৪, নীলফামারীতে ৩, ময়মনসিংহে ১, জামালপুরের বকশীগঞ্জে ১, নেত্রকোনায় ১ ও কুমিল্লায় ১ জন মারা যান। এদের মধ্যে অনেকে বন্যার পানিতে পড়ে নিখোঁজ ছিলেন। এদিন তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে বন্যায় তিন দিনে ৪৩ জনের প্রাণহানি ঘটল।
এদিকে সোমবার দেশের প্রধান ২০ নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপদসীমার ওপরে।
দু’দিনের মধ্যে ১শ’ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারে যমুনার পানি বৃদ্ধি। বানের পানি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ধেয়ে আসছে ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলের দিকে। এতে বন্যার প্রভাব পড়তে পারে রাজধানী ঢাকায়ও। সোমবার পদ্মার সঙ্গে যমুনার পানি যোগ হয়েছে। এর ফলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে এ মৌসুমে প্রথমবারের মতো পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করেছে। বিপদসীমার নিচে থাকলেও ঢাকার আশপাশের পাঁচ নদীর পানি বাড়ছে। তবে আগামী তিন দিনে বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই।
আবহাওয়া এবং বন্যাবিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৭ আগস্ট পর্যন্ত নদ-নদীতে পানি বাড়তে থাকবে। মূলত তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের রাজ্যগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাত হবে। এ কারণেই এ পরিস্থিতি হবে। তবে ১৭ আগস্টের পর বৃষ্টিপাত কিছুটা কমবে। কিন্তু ২১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ও এর সন্নিহিত ভারতীয় রাজ্যগুলোতে ফের ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হবে। ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ৮০ শতাংশ পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। ফলে উজানের ঢল আর দেশের ভেতরের অতিবৃষ্টির পানি মিলে আগস্টজুড়ে দেশে বন্যা থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ই-মেইলে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে জানান, ‘দেশের ভেতরে-বাইরে বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এ বছর এখন পর্যন্ত ভালো নয়। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের মতো বড় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মিঠা পানির তিন প্রধান উৎস গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মেঘনা অববাহিকা। তিস্তা আলাদাভাবে ভারত থেকে এলেও তা ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় মিলেছে। অতীতে এই তিনটিতে যখন একসঙ্গে পানি বেড়েছে, তখনই বন্যা হয়েছে। এবারও প্রবণতা সেদিকে যাচ্ছে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বাংলাদেশ অংশে পানি বৃদ্ধির হার গড়ে ৪৭ সেমি.। ফলে বানের পানি হু-হু করে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। মানুষজন বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। অনেকেই নিজেদের গবাদিপশু-হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার নতুন করে নুনখাওয়া, চিলমারী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি এবং সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এদিন সকাল ৯টায় বিপদসীমার যথাক্রমে ৭৩, ১১৮, ৯০ এবং ৯৬ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় এই নদীর পানি ৪০-৪৫ সেমি. পর্যন্ত বাড়তে পারে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। তবে তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার অববাহিকার নদীর পানি কমতে শুরু করায় ওই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গঙ্গা-পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও তা বর্তমানে বিপদসীমার ১.২৫-১.৭৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অববাহিকার উজানে নেপাল ও বিহারে বন্যার কারণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। মেঘনা অববাহিকায় সুরমা কুশিয়ারার বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় অবনতিশীল থাকবে।
বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলামও ই-মেইলে যুগান্তরকে একই তথ্য জানান। তিনি বলেন, ১৩ আগস্ট নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একইদিন যমুনেশ্বরী নদী বদরগঞ্জে এবং ধরলা কুড়িগ্রামে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সীমায় প্রবাহিত হচ্ছে।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় (ইউএনআরসিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইসিএমডব্লিউএফ) ১০ আগস্ট বৈশ্বিক বন্যা পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অঞ্চলগুলোতে পানি বাড়ছে, যা ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এই ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাত হবে। এরপর বৃষ্টি কমলেও ২২ আগস্ট থেকে ফের বৃষ্টিপাত হবে।
সারা দেশ থেকে যুগান্তর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
দিনাজপুর : জেলার সব ক’টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় দিনাজপুরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়কের বেশ কিছু অংশ প্লাবিত হওয়ায় দিনাজপুর-ঢাকা সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক সড়কগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে ১১টি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে সোমবার আরও ৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে বীরগঞ্জ উপজেলায় ২ জন, নবাবগঞ্জ উপজেলায় ২ জন এবং বিরল উপজেলায় ১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা গেছে। বীরগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে মো. আমাল্লাহ (১০) এবং আমির হামজা (৫) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে তিন দিনে দিনাজপুরে ১৮ জনের মৃত্যু হল। ১৩টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দিনাজপুর শহরে বন্যার পানি ঢুকে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সোমবার দুপুরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দিনাজপুর শহররক্ষা বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করেছে বলে জানান দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়জুর রহমান। দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট গোলাম মোস্তফা জানান, সদর উপজেলার কাউগাঁও এবং পার্বতীপুরের মন্মথপুর এলাকায় রেললাইন ডুবে যাওয়ায় দিনাজপুরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্যায় জেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু বাঁধ ও দিনাজপুর জেলার প্রায় ২ হাজার ৯শ’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম জানিয়েছেন, জেলায় সরকারিভাবে ২৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, দিনাজপুরের বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ হিসেবে ১৬৭ মেট্রিক টন চাল এবং ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম, ফুলবাড়ী, উলিপুর, নাগেশ্বরী ও রৌমারী : বানের পানিতে ডুবে আরও ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন- উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের বগাপাড়া গ্রামের মিস্টার আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (৭), ফুলবাড়ী উপজেলার ঘোগারকুটি এলাকার রইচ উদ্দিনের স্ত্রী হালিমা বেগম (৩৫) ও ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের নজরমামুদ গ্রামের মৃত. আবুল হোসেনের ছেলে আজাহার আলী (৭০), নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে মিজানুরের প্রতিবন্ধী, ছেলে আবদুল করিম ওরফে মনসুর (১৪) ও ফান্দেরচর জামাল গ্রামের কোরবান আলীর কন্যা প্রতিবন্ধী ফুলবানু (৩১), ভুরুঙ্গামারীর দেওয়ানের খামার এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে মজিবর রহমান (১৫) এবং উলিপুরের বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ফকিরপাড়া এলাকার বানভাসা রহমান (৬৫)। এ নিয়ে চলতি বন্যায় জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ জনে। এদিকে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এসব মানুষের ঘরে ঘরে এখন খাদ্য সংকট। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল। ভয়াবহ বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ। কুড়িগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ চালু হলেও রেল যোগাযোগ এখনও বন্ধ রয়েছে। কুড়িগ্রাম-তিস্তা রেলপথে টগরাইহাট নামক এলাকার বড়পুল ব্রিজের সেতুর গার্ডার দেবে যাওয়ায় কুড়িগ্রামের সঙ্গে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন ভেঙে যাওয়া বাঁধ এলাকা : ছিনাই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার খালিদ হোসেন জানান, শনিবার রাত আড়াইটার দিকে আকস্মিক কালুয়ারচর ওয়াপদা বাঁধের ২০০ মিটার ছিঁড়ে যায়। চোখের পলকে শতাধিক বাড়ি পানির তোড়ে ভেসে যায়। মানুষজন জীবন বাঁচাতে পারলেও কোনো সম্পদ রক্ষা করতে পারেনি। বাড়ি ছেড়ে পালাতে গিয়ে পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয় রিফাত (৭) ও ফাতেমা বেগম (৩৫)। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কালুয়ারচর গ্রামে। এরপর চতুরভুজ, কিশামত ছিনাই ও জয়কুমর গ্রামের। এ চার গ্রামের ৭শ’ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী একতা বাজার ও সংলগ্ন বাঁধের দেড় কিমি. এলাকায়। বাড়ি থেকে গরু-ছাগল নিয়ে আসতে পারলেও হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। সঙ্গে আনতে পারেনি ধান-চাল। ফলে সবার ঘরে ঘরে এখন খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। রোববার চিড়া-মুড়ি দেয়া হয়েছে। সোমবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাফর আলী খিচুড়ি পাঠিয়েছেন। আর সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ সোমবার পাওয়া গেছে। আজ ৫শ’ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হবে।
লালমনিরহাট : হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পানিবন্দি অবস্থায় চরাঞ্চলে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধারে সরকারি কোনো তৎপরতা নেই। রোববার সদর উপজেলার কুলাঘাট এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় ভেলাডুবির ঘটনায় সোমবার আরও তিনজনের লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। তারা হলেন- পূর্ব বড়–য়া গ্রামের আবদুল হামিদ ওরফে সামাদের স্ত্রী আছমা বেগম নাসিমা, একই গ্রামের মোজাম উদ্দিন রবিউলের ছেলে আলিফ ও মোজাম উদ্দিন রবিউল। এছাড়া পৃথক ঘটনায় নিখোঁজ আবদুল মজিদ নামে আরও এক মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে হাতীবান্ধায় পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া প্রায় ৮০ ফিট রেলপথ সংস্কার না হওয়ায় দু’দিন ধরে বুড়িমারী স্থলবন্দরের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জেলার বেশকিছু রাস্তা, ব্রিজ কালভার্ট ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
নীলফামারী, সৈয়দপুর ও ডিমলা : বন্যায় তলিয়ে আছে প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান। পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার। এদিকে তিস্তায় উজানের ঢল কিছুটা কমলেও ভাঙন আতঙ্কে ভুগছেন তিস্তা পারের মানুষ। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক বাড়িঘর তিস্তায় বিলীন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাসান ফেরদৌস জানান, প্রায় ২০ হাজার পুকুরের মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া সৈয়দপুর শহররক্ষা বাঁধ রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করে চলেছেন। এদিকে বন্যাকবলিতদের জন্য ১৮০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে প্রশাসন। এদিকে সৈয়দপুরে বাঁধ ভেঙে যাওয়া পানিতে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারিয়েছে ২ কিশোর। তারা হল সিরাজুল ইসলাম রতন (১৮) ও আরিফ (১৪)। এছাড়া নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়ে ডুবে মারা গেছেন জাকারিয়া (৪১) নামে এক ব্যক্তি। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে।
সিরাজগঞ্জ : সোমবার বিকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেছেন, যমুনার পানি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামী দু’দিনের মধ্যে একশ’ বছরের রেকর্ড ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যমুনার প্রবল স্রোতের ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। সদর উপজেলার রতনকান্দি ও খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের ৩টি স্থানে বাঁধের নিচ দিয়ে পানি চুয়াচ্ছে। এসব স্থানে বালিভর্তি বস্তা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তিনি জানান, জেলার সব নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধগুলোর ওপর দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রাজশাহী : মোহনপুরে শিব ও বারনই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রামের ২০০ হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে ধান ও সবজিক্ষেত এবং পানের বরজ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজারও মানুষ।
নওগাঁ : আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আটটি স্থানে ভেঙে গেছে। এর মধ্যে মান্দায় ৬টি, আত্রাইয়ে ১টি ও পত্নীতলায় ১টি। এতে জেলার প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৫০ হাজার লোক। বাঁধের রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সোমবার সকাল থেকে জেলার আত্রাই উপজেলার সঙ্গে মান্দার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুই উপজেলার ২২টি বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ : সীমন্তবর্তী উপজেলাগুলোর অনেক সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। সোমবার সুরমা নদীর পানি বেড়ে পৌর এলাকার ষোলঘর, কাজীর পয়েন্টসহ বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, দিরাই, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশাসহ ১১টি উপজেলার ৭০০ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা, ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন নষ্ট হয়েছে।
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ। ৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৮টি উচ্চ বিদ্যালয় পানির নিচে থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সোমবার গোয়াতলা হরিপুর গ্রামে এক শিশু বন্যার পানিতে পড়ে মারা গেছে।
ভুঞাপুর (টাঙ্গাইল) : তিন দিনের অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিতে ভুঞাপুরের ৪ ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রায় ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে বীজতলা ও সদ্য রোপণকৃত ধান।
জামালপুর, বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ : বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার ওপর। এটি সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। সোমবার বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়নের গাজীপাড়া গ্রামে ইলিয়াস গাজী (১৪) নামে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্র পানিতে পড়ে মারা গেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন ও রেল ইয়ার্ড।
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সোমবার সকালে কালিতলা হার্ড পয়েন্ট এলাকায় বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ফসল ও পুকুর-খামারের মাছ।
নেত্রকোনা : জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ছোট-বড় সব নদীর পানি বিপদসীমার ওপর। কলমাকান্দার কৈলাটী ইউনিয়নের বীর সিধলী গ্রামের আবদুল আজিজ (৭৮) নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর সোমবার দুপুরে লাশ উদ্ধার হয়েছে। বেনুয়া গ্রামের মিলিটারি বাড়ির সামনে সোমেশ্বরী নদী থেকে এলাকাবাসী তার লাশ উদ্ধার করে। বন্যার পানিতে ভাসমান গাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।
সিলেট : সুরমা, কুশিয়ারা নদীর সবগুলো পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদী উপচে সিলেট শহরের বিভিন্ন এলাকা দিয়েও ঢুকছে পানি। পানি বেড়েছে সীমান্ত নদী ধলাই, পিয়াইন, বড়গাঙ, সারীতেও। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্থগিত করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাও।
কমিল্লা ও বুড়িচং : কুমিল্লায় পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তের ৫ উপজেলার ফসলি জমি। এদিকে বুড়িচংয়ে পাহাড়ি ঢলের সে াতে তলিয়ে যাওয়া শিশুর ক্ষতবিক্ষত লাশ ৩ দিন পর উদ্ধার করা হয়েছে।
রংপুর, বদরগঞ্জ ও কাউনিয়া : তিস্তা, ঘাঘট ও যমুনেশ্বরীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক পরিবার। গঙ্গাচড়ায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দুর্গম চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আটকে পড়া মানুষজনকে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দুর্গত মানুষের মাঝে সরকারি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সিকিভাগ। বদরগঞ্জ-পার্বতীপুর সড়কের একাংশ পানির নিচে।
গাইবান্ধা : সোমবার বিকাল ৫টায় তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৯০ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ১১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় সেগুলোতে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। ৪ উপজেলায় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় সব রাস্তাঘাট ও ক্ষেতের ফসল ডুবে গেছে।
জয়পুরহাট : রোববার রাতে জয়পুরহাট সদর উপজেলার বম্বু ইউনিয়নের ধারকি-কালিতলা এলাকার তুলসীগঙ্গা নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ওই ইউনিয়নের নতুন করে আরও অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রাম ও পাড়া জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ও পুকুর।
দাগনভূঞা : ছোট ফেনী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর। তলিয়ে গেছে নিন্মাঞ্চল।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/15/148207/