১৫ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:১২

অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যায় না

মানুষের মাথা খারাপ হলে তাকে পাগল বলে। পাগলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে পাগল বলা যায় না। যেমন চোরকে চোর বলা যায় না। পাগলকে পাগল বললে অথবা তার আচরণের কোনো দোষত্রুটি উল্লেখ করলে সে আরো ক্ষেপে যায় এবং এতই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, তার কারণে আশপাশের লোকজনের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হয়ে উঠে। তাকে তখন পাগলা গারদে পাঠানো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পাগলের এই অবস্থাকে আমার এক সহপাঠি পাগলের মাথাখারাপ অবস্থার সাথে প্রায়শঃই তুলনা করতেন। দেশের কোনো কোনো ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও এর শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কোনো নেতানেত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে পাগলের মাথা খারাপ অবস্থার কথাই মনে পড়ে। আওয়ামী লীগপন্থী আমার এক সহকর্মী বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ত্রাস, ছাত্র লীগের ফিরু ভাই বলে পরিচিত ক্যাডার বরিশালের সৈয়দ কামালুদ্দিন (যিনি ৭০ সালে পল্টন ময়দানে জামায়াতের পাবলিক মিটিং-এ হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন) অবশ্য ভিন্ন কথা বলতেন, তার মতে আওয়ামী লীগ করলে মাথার বুদ্ধি হাঁটুতে নেমে আসে। এই অবস্থায় তারা কখন কি করেন নিজেরাও জানেন না। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার পর ফিরু ভাই রক্ষীবাহিনীতে গিয়ে মেজর হয়েছিলেন এবং এরশাদের সময় তাকে অবসর দিয়ে সরকারি চাকরিতে absorb করা হয়েছিল। কথাগুলো এ জন্যই বললাম যে, অধুনা দলটির কিছু কিছু নেতানেত্রীর কথাবার্তা ও আচার-আচরণ বেপরোয়া হয়ে গেছে বলে মনে হয়। অবশ্য বেপরোয়া তারা আগেও ছিলেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ব্যাপারে আপীলেট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার পর তাদের বেপরোয়া আচরণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের লুটপাট, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ব্যাপক আকারের ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, ব্যাভিচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ পাচারের পুনঃপৌণিক ঘটনায় দলটি যখন দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচনায় বিধ্বস্ত তখন বেপরোয়া আচরণকেই তারা আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে নেয় বলে মনে হয়। ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের ঐতিহ্য উত্তরাধিকার নিয়ে বগুড়ার তুফান মা-মেয়ের উপর যে অত্যাচার করেছিল দেখা গেছে তা শুধু বগুড়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে ধর্ষণ-ব্যাভিচার সেখানেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ। আবার জেলা উপজেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মারামারি, সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি তথা খুন-খারাবিসহ জঙ্গি তৎপরতায়ও তারা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় যখন দেশে বিদেশে মুখ রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে তখন নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর কৌশল তারা গ্রহণ করে। সিলেটে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘাত ও এক গ্রুপ কর্তৃক অন্য গ্রুপের কর্মীদের হাত কাটার ঘটনাকে শিবিরের কাজ বলে মিথ্যা অপবাদ প্রচার করা হয়। আবার যে প্রতিষ্ঠানের সামনে এই ঘটনা ঘটে সেই প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ পুলিশকে সরবরাহ করায় সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ কর্মীরা উক্ত প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুর চালায়। সত্য প্রকাশিত হয়ে যাবার আতঙ্কে তারা দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাদের আচরণে দেখা দেয় বেপরোয়া প্রবণতা। দোষ স্বীকার এবং আচরণ সংশোধনের পরিবর্তে দলটি ভয়ঙ্কর অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য অন্য দলের উপর দোষারোপ করার আত্মবিনাশী কৌশলের আশ্রয় নেয়।
গত পয়লা আগস্ট সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নয় বরং জামায়াত-শিবির ও বিএনপি থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরাই আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগসহ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের নামে খুন-খারাবি, ধর্ষণ, ব্যাভিচার, চাঁদাবাজি, সম্পত্তি জবরদখল, সংঘাত-সংঘর্ষসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের যত রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে তা সত্য নয়। অপরাধীরা আওয়ামী পরিবারের কেউ নয়। এরা সবাই অনুপ্রবেশকারী। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গত ৮ বছরে ৬০ হাজারেরও বেশি জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে ঢুকেছে। সরকার ও দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতেই তারা আওয়ামী লীগে এসেছে, এমনটি মনে করছেন দলের হাই কমান্ড। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী দলটির সভানেত্রী সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগে কারা অনুপ্রবেশ করেছে, কার মাধ্যমে দলে ঢুকেছে তাদের একটা তালিকা তৈরি করে জমা দিন। কিছু লোক আওয়ামী লীগ হয়ে দলে ঢুকে তারপর অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে দল ও সরকারকে বিব্রত করে। এদের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি তার রিপোর্টে জানিয়েছে যে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরির কাজ দু’মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে।
দু’মাসের মধ্যে না হোক তিন মাসের মধ্যে হলেও দেশবাসী আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারী ভিন্ন দলের অপরাধীদের তালিকা প্রকাশিত হোক এটা দেখতে চায়। উল্লেখ্য যে, সরকারি দল ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে এই অনুপ্রবেশ ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরির কথা বলে আসছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনও তালিকা তারা প্রকাশ করতে পারেননি। আমার যত দূর মনে পড়ে ২০০৯ সালের শেষেরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র আবু বকরকে ছাত্র লীগের সন্ত্রাসীরা গুলী করে হত্যা করে। এই হত্যার দায় সরকারি দল নেয়নি বরং বলেছে যে, অনুপ্রবেশকারী জামায়াত-শিবির বিএনপির লোকেরা তাকে হত্যা করেছে। দলটি হত্যাকারীর পরিচয় নির্ণয়ের জন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। কিন্তু রিপোর্ট আর প্রকাশিত হয়নি। পত্র-পত্রিকায় অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ যুবলীগ শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয়সহ রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছিল এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে দলের পক্ষ থেকে তাদের সাসপেন্ড করা হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ থেকে দলীয় সভাপতি ইস্তফাও দেন। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা তখন কি জামায়াত-শিবির-বিএনপির অনুপ্রবেশকারী ছিল বলে কেউ দাবি করেছে? না করেনি। কিন্তু ছয় মাস পর দেখা গেল অবস্থা অথৈবচ বরং আরো খারাপ। সাসপেন্ডকৃত অভিযুক্ত সন্ত্রাসী আরো বড় পদে দলে ঠাঁই পেয়েছেন। এতে ছোট অপরাধীরা আরো উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বড় অপরাধ সংঘটনে এগিয়ে এসেছে। দলের বদনাম হয়েছে। অবস্থার অবনতি হতে হতে এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে এখন আর কেউ ভাল মানুষ আছে বলে চিন্তা করেন না। তারা মানুষের এত অত্যাচার-অবিচার ও শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন যে ক্ষমতাচ্যুত হলে তাদের পরিণতি কি হবে তা নিয়ে অনেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে যে পর্যবেক্ষণগুলো এসেছে তাতে দেশের প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন হয়েছে দেশবাসী মনে করেন। কিন্তু কথায় আছে, উচিত কথায় আহাম্মক রুষ্ঠÑ ক্ষমতাসীন দল এতে তুষ্ট হতে পারেননি, তারা রুষ্ঠই হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল ও সরকার, তাদের অনুসারী আইন প্রণেতা, বুদ্ধিজীবী সকলেই এই রায়ের ব্যাপারে অবমাননাকর মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, যতবার আদালত এ ধরনের রায় দিবেন ততবার তারা সংসদে এই সংশোধনী অনুমোদন করবেন। মনে হয় যেন তারা অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবেন। কেউ প্রধান বিচারপতির অপসারণ চাচ্ছেন। কেউ প্রধান বিচারপতিকে ইতিহাস বিকৃতির জন্য দোষারোপ করছেন। কেউ বলছেন তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। কারুর মতে, তিনি আওতা বহির্ভূত কাজ করেছেন, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছেন। একজন বলেছেন, তিনি হিন্দু নন। আরেকজন তথ্য দিয়েছেন যে এই রায়ের মুসাবিদা একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক তৈরি করে দিয়েছেন। কথাগুলো শুধু প্রধান বিচারপতির জন্য অপমানকর নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের জন্যও। কেন না প্রধান বিচারপতি এ ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে অপমান করা যায় না। মাথা খারাপ করার সীমা আছে, তা অতিক্রম করা উচিত নয়।
রায়ের কিছু কথা ও শব্দ Expunge করার কথা উঠেছে। সরকার ও সরকারি দলের পক্ষে তা হজম করা সম্ভব হচ্ছে না। এই জন্য আদালতের কাছে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনের একটি প্রক্রিয়া আছে। সে প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের একজন মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক রায় সংশোধনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি করার জন্য প্রধান বিচারপতির বাড়িতে যেতে পারেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি Judicial Process এর অংশ না হলে প্রশ্ন উঠতো না। রাজনৈতিক আলোচনা ও দরকষাকষি যদি বিচারবিভাগীয় রায় সংশোধনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাহলে হাইকোটর্, সুপ্রীম কোর্ট ও সম্মানিত বিচারকরা (যাদেরকে আদালতে My Lord বলে address করা হয়) রাজনীতিবিদদের কাছে নস্যি বলে গণ্য হতে পারেন। বিষয়টি সবার ভেবে দেখা দরকার।

http://www.dailysangram.com/post/296185-