১৪ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১০:০৪

মেয়েদের ন্যাড়া করা হত্যার চাইতেও অবমাননাকর

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

মানুষ মাথা ন্যাড়া অনেক সময়েই করে। জন্মের পর থেকে এটা শুরু করে মানুষ। বিশেষত জন্মের কয়েকদিন পর বাচ্চার মাথা মুণ্ডন করা হয়। এনিয়ম রয়েছে বাংলাদেশ, ভারতসহ এ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বাচ্চাদের মাথা কামিয়ে দেয়া হয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। আর এটা করা হয় পবিত্রতা হাসিল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য। বিশেষত স্বাস্থ্যগত বিষয়টার গুরুত্ব দেয়া হয়।
শুধু যে জন্মের পরই বাচ্চাদের মাথা মুণ্ডন বা ন্যাড়া করা হয়, এমন নয়। এর ধারাবাহিকতায় ৫ থেকে ৭ বছর অবধি মাঝেমধ্যেই শিশু-কিশোরদের মাথার চুল ফেলে দেয়া হয়। অবশ্য অনেক শিশুই মাথা ন্যাড়া করতে চায় না একটু বড় হলে। কেউ কেউ কান্নাকাটিও করে। কিন্তু মা-বাবা অথবা অভিভাবকরা জোর করেই মাথা ন্যাড়া করান শিশু-কিশোরদের। তবে মাথা ন্যাড়া করলে গরমকালে কিছুটা স্বস্তিকর মনে হলেও টাকমাথা কিন্তু আসলেই সুন্দর মনে হয় না। বিশেষত শীতকালে ন্যাড়া করলে মাথায় ঠান্ডাও অনুভূত হয় অনেকের।
সাধু-সন্ন্যাসীরা কখনও কখনও চুলদাড়ি, নাভির নিচের অংশের লোম অক্ষত রেখে ব্রতচারী হলেও পুরোহিত ব্রাহ্মণরা প্রায়শ মাথামুন্ডন করেন। তাদের কেবল টিকি দেখা যায়। এছাড়া ভারত উপমহাদেশে হিন্দুদের মা-বাবা অথবা অন্য কেউ মারা গেলেও মাথামু-ন করে শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করা হয়। বৌদ্ধভিক্ষুরাও মাথামু-ন করেন। অপরদিকে হাজীসাহেবরাও হজ শেষে মাথা ন্যাড়া করেন। তবে মহিলা হাজীদের ন্যাড়া হতে হয় না। তাদের চুলের আগা সামান্য কাটলেই চলে। কাজেই সব চুলকাটা এক নয়। কোনও কোনও চুলকাটা হয় পারত্রিক কল্যাণের লক্ষ্যেও।
ছোটবাচ্চাদের মাথা বেল বা ন্যাড়া করলে বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করে। অনেক সময় কারুর ন্যাড়ামাথা দেখলে বড়রাও ছোটদের ক্ষেপান। এতে অনেক সময় অযথা এমন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে যায়। মারামারি, খুনোখুনি পর্যন্ত হতে দেখা যায়। এমন হলে তা কেবল অপ্রত্যাশিতই নয়, দুর্ভাগ্যজনকও। সেজন্য অকারণে ঠাট্টাবিদ্রুপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। বিশেষত শিশু-কিশোররা একটু বুদ্ধি হলে মাথা ন্যাড়াকরা খুব অপছন্দ করে। কিন্তু অভিভাবকদের অনেকে বাচ্চাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাথা ন্যাড়া করে দেন। এর ফলে শিশু মনোক্ষুণœ থাকে। কখনও কখনও কোনও কোনও শিশু ইচ্ছের বিরুদ্ধে মাথান্যাড়া করবার পর রাগ করে বাসা থেকে পালিয়েও যায়। তখন মা-বাবার কী পরিস্থিতি হয় কল্পনা করুনতো? তাই যখনতখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে শিশু-কিশোরদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া অনুচিত। এমন করলে বাচ্চারা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। এমনকি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ কিংবা আত্মহত্যার মতো দুর্ভাগ্যজনক কা- ঘটিয়ে ফেলে শুধুমাত্র মাথান্যাড়া করবার জেরে। তাই মাথান্যাড়া করবার কাজটি অতো সহজ নয় কিন্তু। বেশ ঝামেলার এবং ঝুঁকিপূর্ণও।
মাথান্যাড়া করা একটি গ্রাম্য শাস্তি। কেউ কোনওরকম অপকর্ম করলে গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা তাদের সমর্থকদের নিয়ে শালিস ডাকেন। এতে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে যেকোনও শাস্তি দেয়া হয় মাতব্বরদের ইচ্ছে অনুসারে। শাস্তিটা হয় প্রধানত অর্থদণ্ড এবং মাথামুণ্ডন। এটা কখনও সখনও মাথামু-নের পর সেই বেলমাথায় চুনকালি মেখে গলায় হাঁড়ির কাক্সক্ষা ঝুলিয়ে পাড়াময় মিছিল করে ঘোরানো হয়। অন্যথায় মাতব্বরদের মনোবাসনা পূর্ণই হয় না। আর এমন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় নারীঘটিত ব্যাপারেই বেশি। তবে এসব গ্রাম্য বিচার-শালিসে মোড়ল-মাতব্বরদের আপনজনেরা প্রত্যক্ষভাবে কেউ জড়িত থাকলেও তাদের তেমন শাস্তি প্রায়শ হয় না। শাস্তি নির্ধারিত থাকে গরিব ও নিরীহ মানুষের জন্য। বিশেষত অভিযুক্ত নারী হলে শালিস আহ্বানকারীদের সুবিধে হয় বেশি।
গ্রামে-গঞ্জে এমন প্রথা একসময় চালু ছিল যে, এখন শুনলে অনেকে হাসবেন। ঠাট্টা করবেন। আগের দিনে ভাসুর ও ভাইবউয়ে কিংবা মামাশ্বশুর অথবা ভাগ্নেবউয়ে কথা বলাবলি করলে খুব খারাপ মনে করা হতো। এমনকি ভুলক্রমে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন সম্পর্কের নারী-পুরুষে ঘেঁষাঘেঁষি হলেও সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যেতো। জরিমানা পর্যন্ত করা হতো উভয়কে। তবে এখন এমন সংস্কার প্রায়ই কমে গেছে।
অনেক আগে এক ভদ্রলোক ভুলবশত ভাগ্নেবউয়ের ঘরে ঢুকে পড়েন। বিষয়টি কোনওক্রমে গ্রামের মোড়লের কানে পৌঁছে যায়। ব্যস! আর যায় কোথায়? লোকটির বিরুদ্ধে বিরাট শালিস ডাকা হয়। শালিসে ভদ্রলোকের মাথা বেল করে দেবার রায় হয়। ভাগ্নেবউ অবশ্য মামাশ্বশুরকে বাঁচাতে সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ওই সময় ঘরে ছিলেনই না। মাতব্বররা কে কার কথা শোনে? শালিসে মামাশ্বশুরের মাথান্যাড়া করা হয়। তিনি এ অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এ ঘটনা এখনকার দিনে হলে শালিসকারীদের নির্ঘাত ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হতো।
যা হোক, এসব নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে অঘটন যে ঘটেই না এমন নয়। আবার সব ঘটনা আলোর মুখ দেখেও না। আজকাল অনেক মিডিয়া। এসব মিডিয়ার প্রতিনিধি গ্রাম অবধি ছড়িয়ে আছেন। তারা বলতে গেলে কান খাড়া করেই রাখেন। সামান্য ক্লু পেলেই ঢুকে পড়েন ঘটনার অন্দরমহলে। তবে মিডিয়ার লোকদের বদৌলতে তিল অনায়াসে তাল হয়ে যায়। আবার অনেক তালও তিল হয়ে পড়ে থাকে।
বলছিলাম বগুড়ার তুফান সরকারের কথা। তিনি যে তুফান তুলেছেন, সত্যই তা নজিরবিহীন। এ তুফান এখন দুর্বার গতিতে তোলপাড় তুলছে দেশময়। বড় বড় নেতাদের মুখে তুফানের নামে খৈ ফুটছে অহরহ। শুধু দেশে কেন, বাইরেও তুফান সরকার ও তার সহযোগীদের নামোচ্চারণ হচ্ছে বেশ উচ্চকণ্ঠেই। তবে তুফান সরকারদের দায়িত্ব কেউ নিতে চান না।
তুফান সরকার যেজন্য 'তুফানমেল ঘটনা'র সৃষ্টি করেছেন, সেটা হচ্ছে: একটি মেয়েকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবার নাম করে এনে তার শ্লীলতা হানি করেছেন। ঘটনাটি জানাজানি হলে মেয়েটিসহ ওর মাকে তুলে এনে অমানবিক জুলুমনির্যাতন চালিয়ে মা-মেয়ের মাথান্যাড়া করে দেন তুফান ও তার ঘনিষ্ঠরা। এর সঙ্গে জড়িত আছেন একজন মহিলা কাউন্সিলরসহ তুফানের লোকজন।
তুফান সরকার মানে তার কাজকর্মও তুফান বলতে পারেন। রাতারাতি অঢেল অর্থসম্পদ অর্জন করেছেন। চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসা, বেআইনি ত্রিহুইলারের লাইসেন্স দেবার নামে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। সব ভাই মিলে এমনিভাবে কামিয়েছেন বহু টাকা। আর শ্রমিক লীগের নাম ভাঙ্গিয়েও সরকারি সুযোগ বাগিয়েছেন এন্তার। তাই ধরাকে সরাজ্ঞানই করেছেন এতোদিন। অন্যথায় অন্য মেয়েকে ফুসলিয়ে ধর্ষণের মতো অপকর্ম করে পরে তার মাকেসহ তুলে এনে তাদের মাথা কামিয়ে বেল করে দেবার যে ধৃষ্টতা তুফান ও তার সহযোগীরা দেখিয়েছেন তা কেবল নজিরবিহীনই নয়, অপরাধজগতের শীর্ষ ঘটনাও বলা যায়।
ইতোমধ্যে তুফান সরকারসহ তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে। কেউ পুলিশী রিমান্ডে। কেউ রিমান্ড শেষে জেলখানায়। ভিক্টিমদেরও সেফহোম ও সেফসেন্টারে রাখতে হুকুম দিয়েছে আদালত। নিশ্চয় এসব ন্যায়বিচারের আলামত। আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
কারুর চুলকেটে মাথান্যাড়া করে দেয়া মারাত্মকরকম অপরাধ। নিদারুণ অমানবিক আচরণ। মানবতার লংঘন। বিশেষত মেয়েদের চুলকেটে ন্যাড়া করা ভয়াবহ এবং ন্যক্কারজনক কাজ। এর চাইতে হয়তো তাদের হত্যা করলেও এতোটা অমর্যাদা ও অপমান হতো না। চুল শুধু নারীর সৌন্দর্যই নয়। মর্যাদা ও সম্ভ্রমের প্রতীক। অলঙ্কারও। মেয়েদের যারা এই মর্যাদা ও সম্ভ্রমের হানি করে তারা কতবড় দানবিক অপকর্ম করেছেন তা ভাবা যায় না।
উল্লিখিত তুফান সরকার শুধু বগুড়ায় নয়। সারাদেশে গিজগিজ করছে। এরা যেমন জনগণের সম্পদ লুট করছে, তেমনই মানুষের ইজ্জত-আবরু লুটে নিতেও দ্বিধাবোধ করছে না। তবে ক্ষমতাসীনদের বারোটা বাজাতে তুফান সরকার ও তার সহযোগীদের 'অবদান' অনেক বলেই মনে হচ্ছে। এমনকি এজন্য বিএনপি ও এর সহযোগীদের মাঠে নামবারও দরকার তেমন নেই বলে মনে হয়।
তুফান সরকার ধোঁকা দিয়ে নিয়ে যেভাবে মেয়েটির শ্লীলতা হানি করেছেন এবং এরপর তাকে ও তার মাকে তুলে নিয়ে ঘনিষ্ঠদের সহযোগিতায় যেভাবে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে তা মানবতার চরম লংঘন। এই অবমাননার পর তাদের আর বেঁচে থাকবারই কথা ছিল না। পুলিশ ও অন্যদের সহায়তায় তারা আপাত বেঁচে গেলেও এর জের অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/296051-