ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় আশকোনা হজক্যাম্পে অবস্থান করছেন হজযাত্রীরা :নয়া দিগন্ত
১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৫৮

হজযাত্রায় শেষ দিকে চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা

অতিরিক্ত ফ্লাইটের দাবি

 

হজ মওসুমের শেষ দিকে জটিলতা আরো বাড়তে পারে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় শেষ দিকে চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এতে প্রায় পাঁচ থেকে ১০ হাজার ব্যক্তি এবার হজে যেতে পারবেন না বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য শেষ দিকে অতিরিক্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব এবং হাজী কল্যাণ পরিষদ।
কোনোভাবেই পাল্টাচ্ছে না হজ যাত্রীদের ভোগান্তির চিত্র। ধর্মমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, হাবের দায়সারা জবাব আর কর্তৃপক্ষের আশার বাণীর দোলাচলে বেড়েই চলছে যাত্রীদের বিড়ম্বনা। হজযাত্রায় ফ্লাইট বাতিলের মহড়ায় শনিবারও যোগ হয়েছে একটি। এ নিয়ে বাতিল করা হলো ৩০টি ফ্লাইট। এ অবস্থায় যারা এখনো যেতে পারেননি ভয় আর শঙ্কা নিয়ে দিন পার করছেন তারা। শেষ পর্যন্ত কি তারা যেতে পারবেন হজ পালনে?
গত বৃহস্পতিবার ধর্মমন্ত্রী খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেন হজের আর কোনো ফ্লাইট বাতিল হবে না। কিন্তু তার পরদিনই শুক্রবার ভিসা জটিলতায় যাত্রীসঙ্কটে বিমানের একটি এবং সৌদিয়ার একটি হজ ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এ ছাড়া হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুন লাগার কারণে আরো ৯টি ফ্লাইট দেরিতে ছেড়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় হজযাত্রীদের। গতকালও বিমানের একটি ফ্লাইট বাতিল করা হয় যাত্রীসঙ্কটের কারণে। বেলা ১টা ৫ মিনিটে ফ্লাইটটির সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল।
গতকাল আশকোনা হজ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, হজ পরিচালকের কক্ষে এজেন্সি মালিক ও প্রতিনিধিদের ব্যাপক ভিড়। কেউ এসেছেন ভিসা জটিলতা নিয়ে, কেউ মাহরাম সমস্যা নিয়ে। একজন এজেন্সি মালিক বলেন, তার হাজীদের মধ্যে চারজনকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। দুইজন মহিলা হজযাত্রীর ভিসা হলেও তাদের মাহরামদের এখনো ভিসা হয়নি। ফলে তাদের চারজনের হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ই-ভিসা জটিলতার কারণে উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে সব যাত্রী হজে যেতে পারবেন কি না তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভিসা ও টিকিট কনফার্ম করার জন্য হজ এজেন্সিগুলোকে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারির পাশাপাশি প্রত্যেক হজযাত্রীকেও বার্তা পাঠাচ্ছে হজ অফিস। তবে হজযাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা টিকিট সিন্ডিকেট চক্রের রাশ না টানলে ভোগান্তি আরো বাড়বে বলে মনে করছে হাজী কল্যাণ পরিষদ।
হজ ফ্লাইট শুরুর পর গত ২০ দিনে সৌদিয়া এয়ালাইন্সের পাঁচটি ফ্লাইট বাতিল হলেও বিমানের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে ২৫টি। বিমানের ফ্লাইটগুলো বাতিল না হলে আরো প্রায় ১২ হাজার যাত্রী হজে যেতে পারতেন সৌদি আরবে। এ ছাড়া বিমানের ফ্লাইট বাতিল হওয়ার সাথে সাথে প্রতিদিনই ফাঁকা যাচ্ছে আসন। শুধু গত তিন দিনেই বিমানের আটটি ফ্লাইট উড়াল দিয়েছে ৮০০-এর বেশি আসন ফাঁকা রেখে। এ অবস্থায় ভিসা ও টিকিট না পাওয়ায় যেতে পারছেন না অনেক হজযাত্রী।
হজ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ভিসা হয়েছে প্রায় এক লাখ তিন হাজার হজযাত্রীর। এখনো ভিসা হয়নি ২৪ হাজার হজযাত্রীর। আগামী ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ভিসার জন্য আবেদন করা যাবে। আর ২৮ আগস্ট যাবে সর্বশেষ ফ্লাইট। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৯৬০ জন হজযাত্রী ঢাকা ছেড়েছেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ২৭ হাজার চারজন এবং সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স ৩০ হাজার ৯৫৬ জন হজযাত্রী পরিবহন করেছে। বাকি ১৬ দিনে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৭০ হাজার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হজ এজেন্সিগুলোকে হুঁশিয়ারির পাশাপাশি প্রত্যেক হজযাত্রীকেও ভিসা সম্পন্ন করার জন্য তাগাদা দিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে হজ অফিস। এ ছাড়া ভিসা হওয়ার পরও যাত্রীদের হজে পাঠাতে গড়িমসি করছে এমন ৩৭৭টি এজেন্সিকে গত বৃহস্পতিবার হজ অফিসে ডেকে সতর্ক করেছে ধর্মমন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (হজ-২) এস এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেসব এজেন্সি হজযাত্রীদের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেনি, সেগুলোকে ১৩ আগস্টের মধ্যে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ডিও ইস্যুর জন্য হজ পরিচালকের কাছে পাসপোর্ট পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, ব্যর্থতার জন্য দায়ী এজেন্সির হজ লাইন্সেস বাতিল, জামানত ও হজযাত্রীর অনুকূলে জমাকৃত উড়োজাহাজ ভাড়া বাজেয়াপ্ত করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ভিসা ইস্যুর সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের সাথে জানানো যাচ্ছে, এখনো অনেক এজেন্সি ভিসা আবেদন পাঠায়নি। এ কারণে হজযাত্রীদের ভিসা পেতে সমস্য সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় যেসব এজেন্সি হজযাত্রীর ভিসা আবেদন সম্পন্ন করেনি, তাদের ১৩ আগস্টের মধ্যে ভিসা আবেদন সম্পন্ন করে ডিও ইস্যর জন্য পরিচালক (হজ), আশকোনা পাসপোর্ট পাঠাতে অনুরোধ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। একই সাথে এ কাজে ব্যর্থতার জন্য দায়ী এজেন্সিগুলোর হজ লাইন্সেস বাতিল, জামানত ও হজযাত্রীর অনুকূলে জমাকৃত উড়োজহাজ ভাড়া বাজেয়াপ্ত করা হবে বলেও জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (হজ) এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে যেন হজযাত্রীরা ভিসা পান, এ জন্য ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আশা করি, এজেন্সিগুলো এ সময়ের মধ্যেই ভিসা আবেদন সম্পন্ন করবে। না হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ দিকে জানা গেছে, হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় আগে এজেন্সিগুলো হজযাত্রী পাঠাতে পারেনি। তারা এখন আর সৌদিতে হজযাত্রীদের পাঠাতে আগ্রহী নয়। কয়েকজন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিক জানান, এখন হজযাত্রীদের পাঠালে তাদের অনেক দূরের বাড়িতে রাখতে হবে। এতে হাজীরা মনোক্ষুণœ হতে পারেন। এ জন্য তারা শেষের দিকে হজযাত্রী পাঠাতে চান। আর এ কারণেই অনেক এজেন্সি ভিসা পাওয়ার পরও হজযাত্রী পাঠাচ্ছেন না।
একজন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিক বলেন, এবার সব ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে গেছে। সরকারি অনেক সিদ্ধান্তও এসেছে পরে। মোয়াল্লেম ফি নিয়ে জটিলতায় বাড়ি ভাড়া করতে দেরি হয়েছে। এরপর ভিসা জটিলতা তো রয়েছেই। ফলে অনেকে আগের ফ্লাইটগুলোতে যেতে পারেননি। সরকার ১৪টি স্লট পেলেও এর মধ্যে অর্ধেকও ব্যবহার করা যাবে না। এতে শেষ দিকে অনেক হজযাত্রী ফ্লাইট সঙ্কটে যেতে পারবেন না বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ হাজী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের নয়া দিগন্তকে বলেন, শেষ দিকে ফ্লাইট সঙ্কটে পাঁচ থেকে ১০ হাজার হজযাত্রী সৌদি না যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য তিনি আগামী ২১ থেকে ২৫ আগস্ট মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক অন্য বিমানে ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন।
এ দিকে হজযাত্রী পাঠানোর সাথে ৬৩৫টি এজেন্সি সম্পৃক্ত থাকলেও বিমানের কাছ থেকে টিকিট পেয়েছে মাত্র ১১৫টি এজেন্সি। হাজী কল্যাণ পরিষদ বলছে, হজযাত্রা নিয়ে কৌশলে গড়ে ওঠা টিকিট সিন্ডিকেটকে থামানো না গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ভিসা জটিলতায় ফ্লাইট বাতিলের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে দাবি করে এ ঘটনায় দায়ীদের খুঁজে বের করতে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন সংগঠনটির সভাপতি নাসের।
একইভাবে শেষ দিকে হজযাত্রীদের সমস্যা আরো জটিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম। তিনি বলেন, সব হজযাত্রী যেতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি। তবে বেশ জটিলতা হবে বলে মনে হচ্ছে। এ জন্য তিনি এজেন্সিগুলোকে আরো তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে তিনি জটিলতার জন্য মাত্র দুটি বিমান সংস্থা থাকার সমালোচনা করে বলে কোনো দেশেই এভাবে দুটি বিমানের মাধ্যমে হজযাত্রী পরিবহন করে না। সঙ্কট কাটাতে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ভিক্তিক অন্যান্য এজেন্সিকে হজ ফ্লাইটের কাজে সংযুক্ত করতে সরকারের কাছে দাবি জানান। সেই সাথে সৌদি সরকারের কাছ থেকে আরো ২৫টি স্লট নেয়ারও দাবি জানান তিনি। তবে হজ অফিসের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, নিবন্ধিত সব হজ যাত্রীকে হজে পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। প্রতিদিনই ভিসার আবেদন বাড়ছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবার ভিসা হয়ে যাবে। সব হজযাত্রী সৌদি আরবে যেতে পারবেন।
এ বছর মোট এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চার হাজার ২০০ জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ২২ হাজার ৯৯৮ জন হজযাত্রী নিবন্ধন করেছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/243681