১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৫৭

চাল সঙ্কটের মূলে গোলমেলে শুমারি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারির সবশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। ২০১২ সালে ছিল ১৫ কোটি ২৭ লাখ। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৮ লাখে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ওই সময় দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৯০ লাখ। এর আগের আদমশুমারিতে ১৯৯১ সালে ছিল ১১ কোটি ২০ লাখ। সরকারি হিসাব মতে ১০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১ কোটি ৩১ লাখ ৯ হাজার। অথচ ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১০’ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিল। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ২৫ হাজার। অথচ তারও এক বছর পরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা রিপোর্টে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের চাল সঙ্কটের মূলে এমন গোলমেলে আদমশুমারি।

২০১০ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১৫ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার ৮৮৩ জন। এর আগে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬ কোটি। আবার ২০০৭ সালে সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৫ কোটি। একই বছর জাতিসঙ্ঘ এই সংখ্যা দেখায় ১৫ কোটি ৯০ লাখ। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে ইন্টারন্যাশনাল পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরো এবং আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের পৃথক পরিসংখ্যানে ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ। অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের পরিসংখ্যানে ছিল ১৪ কোটি ২০ লাখ। ইউএনএফপিএ ২০০৩ সালে বাংলাদেশের এই জনসংখ্যা দেখিয়েছিল ১৫ কোটি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জনসংখ্যার সঠিক সংখ্যা পরিসংখ্যানে উঠে না আসায় দেশের চালের চাহিদা নির্ধারণও সঠিকভাবে হচ্ছে না। একইভাবে চালের উৎপাদন এবং চাহিদা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে গোলমাল। ফলস্বরূপ প্রায় প্রতি বছরই চালকেন্দ্রিক নানা সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে। উপযুক্ত দাম না পেয়ে এক বছর কৃষক হতাশ হচ্ছেন, অন্য বছর অধিক দামে চাল কিনতে গিয়ে পকেট কাটছে ক্রেতার। চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকায় কখনো আমদানি শুল্ক বাড়াতে হচ্ছে, কখনো প্রত্যাহার করতে হচ্ছে। আবার কখনো প্রণোদনা হিসেবে দিতে হচ্ছে বিনা বিনিয়োগে আমদানি ঋণপত্র খোলার সুযোগ। এর সবই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। এ জন্যে সবার আগে সঠিক আদমশুমারি এবং পর্যায়ক্রমে সব নিত্যপণ্যের চাহিদা, উৎপাদন এবং আমদানি-রফতানির সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ধারণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাল সঙ্কটের অন্যতম কারণ ক্ষতি নির্ধারণে গোলমেলে অবস্থাও। সরকারি হিসাবে চলতি বছর ধানে ব্লাস্ট রোগ এবং হাওরে আগাম বন্যায় চালের উৎপাদন ১২ লাখ মেট্রিক টন কম হয়েছে। অথচ বেসরকারি হিসাবে উৎপাদন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। বিগত বছরগুলোয় বিদেশ থেকে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে চাল আমদানি করা হতো ১৫ লাখ টন করে। অথচ গত এক বছরে আমদানি হয়েছে মাত্র এক লাখ ২৮ হাজার টন। সরকারি গুদামে চালের মজুদ তলানিতে নেমে এসেছে। সারা বছর যেখানে গড়ে ১০ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার বা কমিয়ে আনার বিষয়টি দুই মাস ধরে এনবিআর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের হাতেও পর্যাপ্ত চালের মজুদ নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ লাখ টন চাল কম নিয়ে ২০১৭ সাল শুরু করেছেন তারা। ফলস্বরূপ গত এক বছরে ৩০ টাকার মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ৪২ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ৬০ টাকায় ঠেকেছে সরু চালের দাম। এমতাবস্থায় আগামী দিনগুলোতে চালের দাম আরো বাড়তে পারে এবং গরিব মানুষের ‘ভাতে মরা’র অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
অনুসন্ধান বলছে, চাল সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারণ সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করা। চরম ঘাটতির সময়েও সরকারের রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক বাজার ে থকে চাল কেনা হলে তার দাম পড়ত বর্তমানের চেয়ে কেজিতে প্রয় ৮ টাকা কম। এতে বলা হয়, ভারত থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল আমদানি করলে তখন দেশের বাজারে প্রতি কেজির সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াত ৩২ টাকার কিছু বেশি। পাকিস্তান থেকে আনলে তা কেজিপ্রতি প্রায় ৩৫ টাকা পড়ত। অন্য দিকে থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি পড়ত ৩২ টাকা ৪৪ পয়সা ও ভিয়েতনাম থেকে আনলে পড়ত ৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা। অথচ দেশে তখনো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজিদরে। কিন্তু গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর ফলে কেজিপ্রতি দাম যেখানে ছয় টাকা কমে আসার কথা সেখানে চাল আমদানি করতে হচ্ছে আরো বাড়তি দামে।
অভিযোগ রয়েছে, চাল সঙ্কট নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করলেও এখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কঠোরতা আরোপ করতে পারছে না সরকার। ঘাটতি মেটাতে এ বছর ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে এ চাল কিনতে চান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য টনপ্রতি ৪৭০ ডলার দাম অনুমোদন করেছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অথচ এরই মধ্যে প্রতি টন চাল ৪০৬ দশমিক ৪৮ ডলার দরে সরবরাহ করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক মেসার্স অ্যাগ্রোক্রপ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ১৫ লাখ টন চাল কেনার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তাতে কম করে হলেও ৭৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হবে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনায় বসে দরকষাকষি করা হলে এ দর আরো নিচে নেমে আসবে। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।
সঙ্কট নিরসনে সঠিক পরিসংখ্যান খুব বেশি প্রয়োজন মন্তব্য করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিত তথ্য না থাকায় আমাদের দেশে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা নিরূপণও সবসময় সঠিক হয় না। উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই সেটিও গৎবাঁধা। আবার বিভিন্ন কারণে উৎপাদনের যে ক্ষতি হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি কিংবা অনাগ্রহের কারণে সে তথ্যটিও সঠিকভাবে আসে না। ফলে চাহিদা, উৎপাদন, ঘাটতি, উদ্বৃত্ত কোনো কিছুই আগে ভাগে অনুমান করা সম্ভব হয় না। সঠিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হলে কৃষকও মার খেতেন না আবার ক্রেতাকেও বাড়তি দামে নিত্যপণ্য কিনতে হতো না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/243678