১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৫৩

সাত হাজার হজযাত্রীর যাওয়া অনিশ্চিত

বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহন চলবে আর ১৫ দিন। এখনো ৬৯ হাজারের বেশি হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছানোর বাকি আছে। কিন্তু যাত্রীসংকটের কারণে গতকাল শনিবারও একটি হজ ফ্লাইট পাঠানো যায়নি। বিমান ও হজ অফিস–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গতকাল পর্যন্ত যে হিসাব-নিকাশ, তাতে প্রায় ৭ হাজার হজযাত্রীকে পাঠানোর বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, হজ এজেন্সিগুলো সময়মতো বাড়ি ভাড়া না করায় এই অনিশ্চয়তা ও সংকট তৈরি হয়েছে। আর বাড়িভাড়ার বারকোড ছাড়া হজ ভিসা হয় না, তাই শুরুর দিকে হজযাত্রীদের এক বড় অংশের সময়মতো ভিসাও হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ওই এজেন্সিগুলো সৌদি আরবে দেরিতে বাড়ি ভাড়া করেছে। শেষ দিকে বাড়ি ভাড়া করলে ভাড়া কমে আসে। আবার এই ক্ষেত্রে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির বিষয়টিও সামনে এসেছে। মন্ত্রণালয় আগে থেকে দক্ষতার সঙ্গে নজরদারি করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষ মনে করছে।
পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ায় গতকালও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একটি হজ ফ্লাইট পিছিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে গত ১৫ দিনে বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনসের ২৬টি হজ ফ্লাইট বাতিল বা পেছানো হলো। গতকাল সৌদি এয়ারলাইনসের তিনটি ও বিমানের চারটি ফ্লাইটে ২ হাজার ৯৩৯ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে গেছেন।
বিমান সূত্র বলছে, ফ্লাইট বাতিলের কারণে প্রায় ১১ হাজার যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা হারিয়েছে (ক্যাপাসিটি লস) বাংলাদেশ বিমান। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৭ হাজার যাত্রীর সৌদি আরবে যাওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
হজ অফিসের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ফ্লাইটগুলো রয়েছে তাতে এত হজযাত্রী পাঠাতে জটিলতা বা জটের সৃষ্টি হবে। তবে আমরা আশাবাদী।’ তিনি বলেন, হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
হজ অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার বাংলাদেশ থেকে হজ করতে যাবেন মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। গত ২৪ জুলাই থেকে হজযাত্রী পরিবহন শুরু হয়, চলবে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত। গতকাল পর্যন্ত ৫৮ হাজার ১৮৮ জন সৌদি আরবে পৌঁছেছেন। বাকি আছেন ৬৯ হাজারের বেশি। এখন ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট নিয়ে যাত্রার অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৪৫ হাজার যাত্রী।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বিমান কর্তৃপক্ষ তাগাদা দিলেও যেসব হজযাত্রীর ভিসা হয়ে আছে, তাঁদের এখনই ফ্লাইটে পাঠাচ্ছে না এজেন্সিগুলো। হাবের একটি সূত্র জানায়, এজেন্সিগুলো ১৮ আগস্টের পরের ফ্লাইটগুলোতে যাত্রী পরিবহন করতে চাইছে। তাদের দাবি, হজ নীতিমালা অনুযায়ী কোনো হজযাত্রী ৪২ দিনের আগে ফেরত আসতে পারবেন না। হজের পরে সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া কম থাকে। তাই এজেন্সিগুলো যাত্রীদের শেষের দিকে নিয়ে ঈদুল আজহার পরে বেশি দিন রাখতে চায়।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, একে অন্যকে দোষারোপ করার সময় এখন নয়। পরিবহন সক্ষমতার বেশি হজযাত্রী রয়ে গেছে। তাঁদের সৌদি আরবে পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু অসম্ভব নয়। তিনি দাবি করেন, অধিক মুনাফার জন্য দেরিতে ঘর ভাড়া করছে অনেক এজেন্সি, এ অভিযোগ ঠিক নয়।
অনেক হজযাত্রীর ভিসা হওয়ার পরও বিমানযাত্রার জন্য না পাঠানোয় গত বৃহস্পতিবার ৩৭৭টি হজ এজেন্সিকে কারণ দর্শনোর নোটিশ পাঠায় ধর্ম মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে ৯০টি এজেন্সি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একজন যাত্রীও সৌদি আরবে পাঠায়নি। ওই নোটিশে বলা হয়, ভিসা থাকার পরেও এজেন্সিগুলো সৌদি আরবে হজযাত্রী না পাঠানোয় হজ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন হচ্ছে।
এই ৯০ এজেন্সির একটি ময়নামতি এভিয়েশনের ১৯৯ জন হজযাত্রীর ১৮৭ জন ভিসা পেয়েছেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁদের একজনকেও সৌদি আরব পাঠায়নি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মজিবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমাদের ৪৩ জন যাত্রী গেছে। বাকিদের টিকিট করা আছে।’
এসব এজেন্সির সঙ্গে গত শুক্রবার বৈঠক করে মন্ত্রণালয়। এই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকায় ১৯টি এজেন্সিকে আবার নোটিশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
হজ অফিসের পরিচালক সাইফুল ইসলাম গতকাল এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এজেন্সিগুলোর পেছনে অব্যাহতভাবে লেগে আছি। অধিকাংশ এজেন্সি ভিসাপ্রাপ্ত যাত্রীদের জন্য কোন এয়ারলাইনসে কত তারিখে বুকিং দিয়েছে, তার প্রমাণপত্র দেখিয়েছে।’
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় পেরিয়ে যায়নি। আগে গুরুত্ব দিচ্ছি হজযাত্রীদের পৌঁছানোতে।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এয়ারক্রাফট নিয়ে তৈরি। এজেন্সিগুলো যাত্রী না দেওয়ায় আজকেও একটি ফ্লাইট রি-শিডিউল (ফ্লাইটসূচি পুনর্নির্ধারণ) করতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, এখনো যত যাত্রী পাঠানো বাকি আছে, তাঁদের সবার যাওয়া নিশ্চিত করতে কষ্ট হবে।
মোট হজযাত্রীর মধ্যে ৬৩ হাজার ৫৯৯ জন হজে যাবেন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে। বাকিরা যাবেন সৌদি এয়ারলাইনসে। বিমানের ফ্লাইটসূচি অনুযায়ী, মোট ১৭৭টি ফ্লাইটে বরাদ্দকৃত সব হজযাত্রী পরিবহন করার কথা। এর মধ্যে ১৪৪টি বিশেষ হজ ফ্লাইট, বাকি ৩৩টি নিয়মিত ফ্লাইটে যাবেন। বিশেষ হজ ফ্লাইটের প্রতিটির অবতরণের অনুমতি মানে একটি স্লট। এ ধরনের যেসব ফ্লাইট বাতিল হয়েছে, সেসব স্লট নষ্ট হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমান আবার সৌদি কর্তৃপক্ষের আছে আবেদন করে ১৪টি অতিরিক্ত স্লট পায়। কিন্তু এরপরও ফ্লাইট বাতিল অব্যাহত ছিল। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমদ বৃহস্পতিবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ১৪টির মধ্যে ৭টি স্লট তাঁরা ব্যবহার করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমান স্লট নেওয়ার আগে এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথা বলেনি। আমরা বিমানকে বলেছি, ২০ তারিখের পরে ২৫টি স্লটের জন্য চেষ্টা করতে। স্লটগুলোর ব্যবহারের প্রয়োজনে অন্য আন্তর্জাতিক স্টেশন কিছুদিন বন্ধ রাখতেও অনুরোধ করেছি।’
ফ্লাইট বাতিল হওয়া নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে আশকোনায় হজ ক্যাম্পের হজযাত্রীদের মধ্যে গতকালও উদ্বেগ দেখা গেছে। নওগাঁ থেকে আসা মো. বাবুল আলম বলেন, ‘একসঙ্গে ৮৫ জন এসেছি। আগামীকাল ফ্লাইট হতে পারে বলে জানিয়েছে। পাসপোর্ট, টিকিট এখনো হাতে দেয়নি। ফ্লাইট বাতিল হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1287376/