১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৪৯

বড় বন্যার পদধ্বনি

৯০ পয়েন্টের মধ্যে এক দিনেই ৮১টির পানি বেড়েছে, ১৭টিতে বিপত্সীমার ওপরে

আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি, সেই সঙ্গে উজান থেকে আসা ঢলে মাত্র এক দিনে ৯০ পয়েন্টের মধ্যে ৮১টিতে পানি বেড়ে গেছে; এর মধ্যে ১৭টি পয়েন্টে পানি উঠে গেছে বিপত্সীমার ওপরে। বন্যা পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলছেন, আরো তিন দিন পানি বাড়তে পারে। আগস্টে দেখা দেওয়া বন্যা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে বলেও তাঁরা জানান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে সমুদ্র ও নদ-নদী পানিতে ভরে থাকায় এবার সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেদিকে নজর রেখেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। ’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দিনেই একসঙ্গে বেশ কিছু নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা খুব স্বাভাবিক নয়। আরো তিন দিন এভাবে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি যদি বাড়তে থাকে, বিপত্সীমার ওপরে উঠবে আরো কিছু এলাকার পানি। এখন মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত চলছে। বৃষ্টি কমে গেলেও ওই পানি কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে লেগে যাবে দীর্ঘ সময়। অন্যদিকে গত জুন থেকে এ পর্যন্ত তিন দফায় সিলেট অঞ্চলে বন্যা হওয়ায় সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার প্রভাব আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বন্যা পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞরা গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় এমনভাবেই নিজেদের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন কালের কণ্ঠ’র কাছে।
বন্যা বিশেষজ্ঞরা এবারে বন্যা পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ এর আগে শুরু হওয়া আকস্মিক বন্যা এখনো যমুনা-সুরমাবেষ্টিত আছে, যা ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার দিকে ধাবিত হতে পারে বলে জোর আশঙ্কা রয়েছে। আর সাধারণত ওই নদ-নদী তিনটির মধ্যে যেকোনো দুটির পানি একসঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে সারা দেশেই বন্যার প্রভাব পড়ে যায়। মেঘনার চাঁদপুর মোহনায় পানি বেড়ে গেলেও দেশের মধ্যাঞ্চল বা রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা এখনই বন্যা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকাল থেকে বন্যা পরিস্থিতি দেখে আমি ইতিমধ্যেই কবলিত এলাকার জেলা প্রশাসনকে সার্বিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। দুর্গতদের উদ্ধার করা, প্রয়োজনমতো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা, বিশেষ সাহায্যের পাশাপাশি সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের কাছে তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য আগাম থাকা চাল ও টাকা থেকে সাহায্য দেওয়া এবং মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত করতেও বলা হয়েছে। ’
বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি আরো ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে দেশে সাধারণত জুন-জুলাই মাসে এমন ধরনের বন্যার প্রবণতা দেখা গেছে। এবার ওই সময়ে সিলেট অঞ্চলে বন্যা থাকলেও অন্য এলাকায় এর প্রভাব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই গতকাল থেকে যে পরিস্থিতি শুরু হয়েছে তা অনেকটাই আকস্মিক। আগস্টের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এসে এমন বন্যা দেখা দেওয়া উদ্বেগজনক।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে তেঁতুলিয়ায়, ৩৩০ মিলিমিটার। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ২২০ মিলিমিটার, বালাগাছিতে ১৩৭, রাঙামাটিতে ১১৬ মিলিমিটার এবং ঢাকায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখছি, সামনের আরো তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। সেটা হলে খুবই খারাপ হবে। কারণ এক দিনের মধ্যেই যেভাবে বেশ কিছু নদ-নদীর পানি বেড়ে আছে আর বিপত্সীমার ওপরে উঠে যাচ্ছে সেটা এ সময়ে খুব স্বাভাবিক নয়। গত বছরও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জুলাইয়ে। কিন্তু আগস্টের মাঝারি থেকে শুরু হওয়া বন্যা যে প্রবল হয় তা ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ সালে দেখা গেছে। বন্যা দুটো যেমন দীর্ঘমেয়াদি ছিল তেমনি ব্যাপ্তিও বেশি ছিল। ’ ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, যমুনায় পানি বাড়তে থাকলেও তা পরবর্তী সময়ে মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলেও প্রভাব ফেলতে পারে। পানি নামতেও অনেক সময় নেবে। তার ওপর যদি গঙ্গার পানি আরো বেড়ে যায় তবে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
বন্যা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সেলিম ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন যা পরিস্থিতি দেখছি তাতে বলা যায়, দেশ বন্যার মধ্যে পড়ে গেছে। আরো দুই-তিন দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে এ বন্যা কতটা ব্যাপক হবে। যদি বৃষ্টি ও পানিপ্রবাহ একইভাবে বাড়তে থাকে তবে বিপদ বয়ে আনতে পারে। আর যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয় তবে ব্যাপকতা কম হবে। আর বড় আকারের বন্যা হলে তা দেশের বেশির ভাগ এলাকার জন্য ব্যাপক ক্ষতি বয়ে আনবে। ’
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ৯০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে গতকাল ৮১টি পয়েন্টের পানি বিভিন্ন হারে বেড়েছে এবং ১৭টি নদীর পানি কমেছে। গতকালের রেকর্ড অনুসারে শেরপুরের নাকুয়াগাঁও এলাকার ভুগাই নদীর পানি সর্বোচ্চ ৩২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২৩৬ সেন্টিমিটার বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বেড়েছে ৪৭০ সেন্টিমিটার আর বিপত্সীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। একই নদীর বাল্লা এলাকায় পানি বেড়েছে ২২১ সেন্টিমিটার আর বিপত্সীমার ওপরে উঠেছে ১৩৫ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া কংস নদীর ১০৫ সেন্টিমিটার পানি বিপত্সীমার ওপরে উঠেছে। এ ছাড়া সুরমা নদী সুনামগঞ্জে ৭০ সেন্টিমিটার, ধরলা কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার, যমুনা বাহাদুরাবাদে ৪, সুরমা কানাইঘাটে ৭৮ সেন্টিমিটার, যমুনা সিরাজগঞ্জে ১০ সেন্টিমিটার এবং তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর ছিল।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে সুনামগঞ্জে ২০৫ মিলিমিটার, দিনাজপুরে ১৮৭, ডালিয়ায় ১৮৬ মিলিমিটার। ওই তথ্য অনুসারে ১৫টি পয়েন্টে বৃষ্টিপাত ১০০ মিলিমিটারের বেশি ছিল।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/13/531076