১৩ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৪৮

নৌবাণিজ্য দপ্তরে এত অনিয়ম!

অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে নৌবাণিজ্য দপ্তর। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের এই অঙ্গ সংস্থার মুখ্য কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি আবারও তদন্ত শুরু হয়েছে। শুধু ওই কর্মকর্তাই নন, সংস্থার আরও কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

ঘুষ গ্রহণকালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলাম দুদকের হাতে গ্রেফতারের পর শফিকুল ইসলামকে অস্থায়ীভাবে প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৮ জুলাই ফখরুল ইসলাম গ্রেফতারের দু'দিন পরই তড়িঘড়ি করে তাকে অতিরিক্ত দায়িত্বে আনা হয়। যার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির এত অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে তার তদন্তও চলছে; তাকেই আবারও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপরন্তু প্রধান প্রকৌশলী পদে তাকে স্থায়ী করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।
নৌ সেক্টরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রাম ও শাখা কার্যালয় খুলনায় অবস্থিত। সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরার ট্রলার ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজসহ সমুদ্রগামী সব নৌযানের নিবন্ধন ও সার্ভে (ফিটনেস) সনদ প্রদান, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ ও বন্দর ত্যাগের আগে দেশি-বিদেশি সব জাহাজের অনাপত্তি সনদ (এনওসি) প্রদান, নাবিকদের পরীক্ষা গ্রহণ ও যোগ্যতা সনদ যাচাই এবং সরকারি-বেসরকারি মেরিটাইম ইনস্টিটিউট পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ সংস্থাটির ওপর অর্পিত। সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নৌযান পরিদর্শন না করে ত্রুটিপূর্ণ এমনকি অস্তিত্ববিহীন নৌযানের নিবন্ধন ও সার্ভে সনদ দেওয়ার বহু অভিযোগ রয়েছে। মুখ্য কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে চলাচলকারী 'এলসিটি কুতুবদিয়া' এবং 'এলসিটি কাজল' মারাত্মক ত্রুটিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলোকে সার্ভে সনদ ও চলাচলের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ অন্যতম। গত বছরের ১ নভেম্বর প্রথম সার্ভেতে 'এলসিটি কাজল'-এ সাতটি মারাত্মক ত্রুটিসহ ১৯টি এবং ১৩ নভেম্বর দ্বিতীয়
সার্ভেতে আরও কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হয়। এর পরও জাহাজটিকে ডকে না তুলেই তিন মাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। আবার মারাত্মক ত্রুটিসম্পন্ন এলসিটি কুতুবদিয়াকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত দুটি জাহাজকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া ছিল মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশের পরিপন্থী। এ ছাড়া ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির (ডিএনভি-জিএল) জাল সনদের ভিত্তিতে চারটি কোস্টাল ট্যাঙ্কারকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়াসহ অন্য অভিযোগের বিষয়গুলোও শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিধি লঙ্ঘন করে ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি 'এফবি সী-হারভেস্ট' নামে অস্তিত্ববিহীন মাছ ধরার ট্রলারকে অস্থায়ী নিবন্ধন ও ফিটনেস দিয়ে ছয় মাস সাময়িক চলাচলের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এ-সংক্রান্ত অনুমতিপত্রে মুখ্য কর্মকর্তার অস্পষ্ট স্বাক্ষর থাকলেও স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার নাম, পদবি ও সিলমোহর দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হলে মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট ট্রলার মালিককে নৌযানটি দেখানোর নির্দেশ দেয়। তবে অপরাধ আড়াল করতে ডকইয়ার্ডে পুরনো একটি ট্রলারকে 'এফবি সী-হারভেস্ট' হিসেবে দেখানো হয়। দপ্তরে সার্ভেয়ারের খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালনকারী মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফয়সাল আজিম, হিসাবরক্ষক জসিমউদ্দিন এবং পিয়ন মিজানুর রহমান এই জালিয়াতিতে মুখ্য কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করেন। এমএসও-১৯৮৩ এর সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী, নৌবাণিজ্য দপ্তরে অন্য সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে খণ্ডকালীন সার্ভেয়ার নিয়োগের সুযোগ না থাকলেও ফয়সাল আজিমকে এ পদে দায়িত্ব দেওয়ার পেছনেও অনিয়ম হয়েছে বলে জানা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, শফিকুল ইসলাম কোনো ডকইয়ার্ড পরিদর্শন ও পরীক্ষা না করলেও মোটা অঙ্কের ডকইয়ার্ড সুপারভিশন ফি, সার্ভে ফি ও উপঢৌকন পাচ্ছেন। তার সম্মতিক্রমে হিসাবরক্ষক জসিমউদ্দিন, পিয়ন মিজানুর রহমানসহ একটি চক্র সার্ভের কাজ করে। তারা দিনে ১০ থেকে ১২টি ফিশিং ট্রলারের ফিটনেস-সংক্রান্ত ভুয়া ও ভুল তথ্যসংবলিত নথি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিলে মালিকরা অর্থের বিনিময়ে জাহাজের সার্ভে সনদ পেয়ে যান। এমএসও-১৯৮৩ এর সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সাগর ও সাগর উপকূলে ২৪ বছরের বেশি সময় চলাচলরত তেলবাহী জাহাজগুলো স্ক্র্যাপ করে ফেলার নির্দেশনা রয়েছে। নৌবাণিজ্য দপ্তরে নিবন্ধিত ১৪৭টি তেলবাহী জাহাজের মধ্যে ১২টির বয়স ৫০, ৩৫টির বয়স ৪০ ও কমপক্ষে ৩০টির বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। এর পরও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব জাহাজ স্ক্র্যাপ করার বদলে শফিকুল ইসলাম ক্ল্যাসিকাল সোসাইটির মাধ্যমে বিশেষ ডকিং করিয়ে আবারও চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশেষ ডকিং চলাকালে ডকইয়ার্ড সুপারভিশনের নামে অর্থ উপার্জনের কারণেই নৌপথে তেলবাহী জাহাজ বিস্ফোরণ কিংবা ঝুঁকির বিষয়টি আমলে নেননি তিনি। এভাবে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে ৩০ লাখ টাকা সুপারভিশন ফি পেয়েছেন। কেবল ফেব্রুয়ারিতেই পেয়েছেন সাড়ে ৮ লাখ টাকা।
মংলা সমুদ্রবন্দরে জাহাজ প্রবেশ ও বন্দর ত্যাগের আগে অনাপত্তির সনদ বা ছাড়পত্র (এনওসি) দেওয়ার দায়িত্ব নৌবাণিজ্য অফিস খুলনার প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক অথবা নটিক্যাল সার্ভেয়ারের। কিন্তু খুলনা অফিসের তৎকালীন প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক শফিকুল ইসলাম চার বছরের বেশি চট্টগ্রামে দপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তা এবং খুলনা অফিসের নটিক্যাল সার্ভেয়ার কেএম জসিমউদ্দিন সরকার প্রায় সাড়ে আট বছর ঢাকায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে কারিগরি বিশেষজ্ঞের ওই দায়িত্ব পালন করছেন খুলনা অফিসের একজন নিম্নমান সহকারী। জাহাজ পরিদর্শনের আইনি ক্ষমতা ও কারিগরি দক্ষতা-যোগ্যতা না থাকলেও ওই নিম্নমান সহকারী বেআইনিভাবে প্রতি মাসে মংলা বন্দরের ৩০-৪০টি জাহাজের এনওসি দিচ্ছেন, যা বন্দরের নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে একাধিকবার কমিটি হলেও কোনোটাই কার্যকর হয়নি। বিশেষ মহলের প্রভাবে ওই সব তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাণিজ্যিক) আবদুল কুদ্দুস খানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। গত ২০ জুলাই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত এই তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামে দপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও অভিযোগকারীদের বক্তব্য শুনেছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস খান সমকালকে বলেন, শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে প্রথম দিন অভিযুক্ত কর্মকর্তা উপস্থিত হলেও অভিযাগকারীদের একজন আসেননি। তদন্তের জন্য উভয়পক্ষকে আবারও ডাকার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মুখ্য কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অবশ্য এর আগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলাকালে একাধিকবার সমকালের কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেছিলেন, নৌযানের নিবন্ধন, ফিটনেস সনদ প্রদানসহ তার দায়িত্ব পালনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো রকম দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম হচ্ছে না।

http://bangla.samakal.net/2017/08/13/316613