১২ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ২:২১

আমানতের মুনাফার টাকায় চলছে ব্যাংকগুলো

# মূল্যস্ফীতির নীচে সুদ হার
# আমানতকারী পাচ্ছে না কিছুই
আমানতের সুদ হার এখন মূল্যস্ফীতির নীচে। যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আর এ কারণেই ব্যাংকগুলোতে কমতে শুরু করেছে আমানতের সুদ হার। বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ধস। গ্রাহকের আমানতের সুদ কমিয়ে টিকে রয়েছে ব্যাংকগুলো। এক বছরে ব্যাংক আমানত ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বাড়লেও এ বাবদ সুদ ব্যয় বাড়েনি ব্যাংকগুলোর। উল্টো ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় কমেছে। এখনই বিনিয়োগ না বাড়ানো গেলে দেশে দেখা দিবে ভয়াবহ বেকারত্ব। বেড়ে যাবে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা-ও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ।
অথচ আমানতের সুদ হার ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আমানতের সুদ হারের সাথে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পার্থক্য প্রায় ২ শতাংশ। অতীতে এর আগে কখনই মূল্যস্ফীতির নীচে আমানতের সুদ হার নামেনি। এতে করে আমানতকারীরা তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। কারণ খাদ্যের মূল্যস্ফীতির সাথে আমানতের সুদ সমান হলে আয় ব্যয়ে ঘাটতি থাকে না। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে না পারাতে বাধ্য হয়ে তারা আমানতের সুদ হার কমাচ্ছে। এতে করে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত তেমনি ক্ষতি হচ্ছে আমানতকারীরা। এতে করে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংক এবং আমানতেকারী উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকার কারণে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে সমাজে নানা অন্থিরতা দেখা দিচ্ছে। দেশের যুব সমাজ নেশাগ্রস্ত হচ্ছে। একইভাবে নানাভাবে তারা সন্ত্রাসীকার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে।
সরকার সারা দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ রয়েছে বলে প্রচার করলেও বাস্তবে তার উল্টো অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা গ্যাস বিদ্যুৎ লাইন না পাওয়ার কারণেই নতুন করে বিনিয়োগে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাদের অনেকে বিদেশে বিনিয়োগের আবেদন করছে। সরকারও বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়ার পায়তারা করছে। এ নিয়ে বিনিয়োগ বোর্ড একটি নীতিমালাও তৈরি করছে। এ নীতিমালা কার্যক্রর হলে দেশের বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। এতে দেশে আরও অস্তিরতা দেখা দিবে।
ব্যাংকিং ব্যবসায় ধস দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের নতুন ৯টি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্ণর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। তবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই দুর্বল বা ভালো তা এখনই বলা যাবে না। যে দুই-তিনটি ব্যাংকে বড় ধরনের বিচ্যুতি দেখা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে। সার্বিকভাবে তাদের মনিটরিং করা হচ্ছে।
সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকার এত ব্যাংকের অনুমোদন না দিলেও পারতো। ভারতে ১২ হাজার মানুষের জন্য একটি ব্যাংকের শাখা আছে। আমাদের ব্যাংকগুলোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, ১০ হাজার মানুষের জন্য একটি ব্যাংকের শাখা।
সদ্য বিদায়ী অর্থ বছরে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ৮ লাখ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার আমানত থাকলেও গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ লাখ ৬ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়। এক বছরে ব্যাংক আমানত ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বাড়লেও এ বাবদ সুদ ব্যয় বাড়েনি ব্যাংকগুলোর। উল্টো ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে।
মূলত আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেই গত বছর মুনাফা প্রবৃদ্ধি করেছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৬ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের তুলনায় গত বছর ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে ৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ১০ কোটি টাকাই এসেছে গ্রাহকদের আমানতের সুদ কমিয়ে।
আমানতের সুদহার মূলস্ফীতির নিচে নামিয়ে আনায় ব্যাংকবিমুখ হয়ে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ। শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরই সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার। ফলে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানতপ্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। নগদ টাকার সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের অন্তত ১৫টি ব্যাংক।
নতুন প্রজম্মের ব্যাংকসহ প্রায় ২২টি ব্যাংক ধার দেনা করে নিয়মিত ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিনিয়োগ তো দুরের কথা এসব ব্যাংকে এতটাই তারল্য সংকট যে তারা নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে পারছে না। বিনিয়োগ করতে না পারার কারণে তাদের মুনাফা ধস নেমেছে। তারা বাধ্য হয়ে আমানতের সুদ হার কমিয়ে ব্যাংকের ব্যয় চালাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকতে কলমানি মার্কেটে তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে।
এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে মানবিক ব্যাংকিং করার আহ্বান জানিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংক কোনো মহাজনি প্রতিষ্ঠান নয়। আমানতের সুদহার কমিয়ে কিছু ব্যাংক সাধারণ আমানতকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি কখনো কোনো ব্যাংকের নীতি হতে পারে না।
ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০১৬ অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের মধ্যে চলতি আমানত ছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ১০০ কোটি, সঞ্চয়ী আমানত ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬০ কোটি ও মেয়াদি আমানত ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া আন্তঃব্যাংক আমানতের পরিমাণ ১৬ হাজার ৯৯০ কোটি ও অন্যান্য আমানত রয়েছে ৫৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
এসব আমানত থেকে গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে সুদ বাবদ গত বছর ৬৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা আয় করেছে ব্যাংকগুলো। এর আগে ২০১৫ সালে ৬৩ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা সুদ আদায় করেছিল ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে গত বছর ঋণের সুদ বাবদ ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে ২৯০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করেছিল ৪৯ হাজার ৭০ কোটি টাকা। আর গত বছর এ বাবদ পরিশোধ করেছে ৪৬ হাজার ৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৬ সালে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা কম দিয়েছে। সবমিলে গত বছর সুদ বাবদ ব্যাংকগুলোর নিট আয় বেড়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো যে হারে আমানতের সুদহার কমিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সে হারে কমায়নি বলে জানান রূপালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্প্রেড বর্তমানে ৪ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। বিদ্যমান খেলাপি ঋণের অর্ধেকও যদি নিয়মিত করা যায়, তাহলে ৩ শতাংশ স্প্রেড দিয়েও ব্যাংকগুলোর পক্ষে ভালো মুনাফা করা সম্ভব। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতে কোনো ঝুঁকি থাকবে না।
গত বছর দেশের ব্যাংকগুলো মোট আয় করেছে ৪৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। একই সময়ে ২৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় করেছে। এ হিসাবে গত বছর ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা দাঁড়ায় ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যদিও এর আগের বছর ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফায় ছিল। পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলো ২০১৬ সালে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ ও ৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা কর পরিশোধ করেছে। ফলে বছর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৫ সালে ৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকার নিট মুনাফায় ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত।
দুই বছর ধরেই ব্যাংকগুলো নীতিবোধ ছাড়াই আমানতের সুদহার কমিয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমানতের সুদ কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর মধ্যে ব্যাংকারদের কোনো কৃতিত্ব নেই। ব্যাংকগুলো এখন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি না করে মুনাফা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ফলে ঋণপ্রবাহ বাড়লেও দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ব্যাংকগুলোকে এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে দেশে কার্যরত রয়েছে ৫৭টি তফসিলি ব্যাংক। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। ক্রমবর্ধমান এ খেলাপির ঋণের সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্ত হয়েছে আরো ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আদায় অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরো প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। সবমিলে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে মুনাফা কম ব্যাংকগুলোতে। আর এ কারণেই ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। একই সাথে কমেছে আমানতের সুদ হারও। ব্যাংকগুলো যদি বিনিয়োগ না বাড়াতে পারে তাহলে আমানতের সুদ হার আরও কমবে। এতে করে ব্যাংকে আয় আরও কমে যাবে। বিকল্প আয়ের রাস্তা খুঁজছে আমানতকারীরা। আর এ কারণেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/295715-