১২ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ২:১৯

ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়

সংসদে ক্ষমতা থাকলে বিচারপতিরাও হবেন করুণার পাত্র

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্যপদ চলে যায়। এ কারণে সংসদ সদস্যরা দলের নির্দেশনা বা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দলের হাইকমান্ডের কাছে তারা জিম্মি। এ অবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার পরিণতি হবে বিচারপতিদেরও দলের হাইকমান্ডের করুণার পাত্রে পরিণত করা।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল তা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল করা দেয়া রায়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ে লিখেছেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং সংসদ সদস্যদের ওপর ৭০ অনুচ্ছেদের প্রভাবের কারণে এ সিদ্ধান্তই অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, এই নতুন ব্যবস্থা স্বাধীন ও পক্ষপাতহীনভাবে কার্যকর হবে তা আশা করা যায় না। আর স্বাভাবিকভাবেই যখন কোনো বিচারক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরাগভাজন হবেন, তখন এটিই প্রত্যাশিত যে, তিনি সংসদ কর্তৃক অপসারিত হবেন এ নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে। এ অবস্থায় সংসদ সদস্যদের ৭০ অনুচ্ছেদ থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ম্লান হয়ে যাবে।
ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের কঠিনভাবে লাগাম টেনে ধরেছে এবং দলের বাইরে যাওয়ার কোনো স্বাধীনতা নেই। এমনকি দলের অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগও নেই তাদের। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। শাসক দলের মন্ত্রিসভা বা বিরোধী দলের শ্যাডো মন্ত্রিসভা যে সিদ্ধান্ত দেবে তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই সংসদ সদস্যদের।
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, আমরা হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণে কোনো দুর্বলতা দেখছি না। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এর পরিণতি হলো বিচারপতিদেরও দলের হাইকমান্ডের করুণায় পরিণত করা হবে।
তিনি লিখেছেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকা অবস্থায় সংসদে বিচারপতি অপসারণের উদ্যোগের সময় একজন সংসদ সদস্য নিজেকে কতটা নিরপেক্ষ ও দলীয় রাজনৈতিক নির্দেশনা থেকে মুক্ত রাখতে পারেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ বিচারপতি অপসারণের উদ্যোগ নেয়া হবে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক। আর ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা তাদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে পারবেন না এটা বলায় কোনো অতিরঞ্জন হবে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলীয় নির্দেশনা এবং সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একজন সংসদ সদস্যের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, এ অনুচ্ছেদ একজন সংসদ সদস্য যে দলের এবং যে দল থেকে নির্বাচন করেছেন সেই দলের গোত্রভুক্ত করে ফেলেছে।
আর সংবিধানের ৫৫(২) ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এবং সে হিসেবে তিনি ক্ষমতা চর্চা করেন। রায়ে বলা হয়েছে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে সংসদে আইন তৈরি করে সেই দলের সদস্যদের মাধ্যমেই মন্ত্রিসভা বা ক্যাবিনেট গঠন করা হয়। আর এ মন্ত্রিসভাই সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ মূলত ঘুরেফিরে একই দলের ব্যক্তিবর্গের ওপর বর্তায়। নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ বা সংসদ সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি বিভাগ হলেও মূলত একই দলের ব্যক্তিবর্গের হাতে থাকায় এই দুই বিভাগের মধ্যে ব্যবধান খুব কম। এ অবস্থায় সেই একই গ্রুপ যদি বিচার বিভাগের বিচারপতি অপসারণের কাজে যুক্ত হয় তাহলে অভিন্ন দলীয় সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদেরও দলের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের ক্ষমতা থাকা হবে ভয়ঙ্কর।
প্রধান বিচারপতি তার রায়ে শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি এবং সম্প্রতি ভারতীয় দু’জন বিচারপতিকে অপসারণ উদ্যোগের উল্লেখ করে বলেন, কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেন না যে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল রেখে বাংলাদেশের একজন বিচারপতি শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের মতো একই প্রক্রিয়ায় অপসারিত হবেন না। গত ৪২ বছরে বাংলাদেশের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে সংসদ যে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ কম যে, কোনো ধরনের নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতা তাদের পক্ষে বজায় রাখা সম্ভব হবে।
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এখন প্রশ্ন হলো সংসদের কাছে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে সংবিধানে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে তার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে কি না।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যেকোনো দেশের আইনের শাসনের নিশ্চয়তার জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ দরকার যেখানে বিচারপতিরা সরকারের অন্য কোনো বিভাগের অধীন থাকবেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা সুপ্রিম কোর্টের অপরিহার্য দায়িত্ব এবং একই সাথে এ স্বাধীনতা যাতে সরকারের অন্য কোনো বিভাগ ছিনিয়ে নিতে না পারে সেটাও দেখার দায়িত্ব রয়েছে।
এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যেসব আইনজীবী নিয়োগে দেয়া হয়েছিল তারা আদালতে যে যুক্তি পেশ করেছেন তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। ড. কামাল হোসেন তার উপস্থাপনায় বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর উদ্দেশ ছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করে দেয়া। বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশের ৪২ বছরের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, যেসব সংসদে বিচারকদের অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে এ প্রশ্ন উঠেছে যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সংসদের এ প্রক্রিয়া সঠিক নয়। এখন এর মাধ্যমে বিচার বিভাগে রাজনীতিকরণ ঘটেছে এবং দলীয়করণের কারণে এ প্রক্রিয়া সঠিক নয় মর্মে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে, খর্ব হবে এবং ক্রমে সঙ্কুচিত হবে। তিনি বলেছেন, সংসদের হাতে এ ক্ষমতা থাকলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারপতি অপসারণের ঝুঁকি থেকেই যায়। জনগুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর বা রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে কোনো বিচারকের রায় যদি সংসদের জন্য বিব্রতকর হয় তবে সংসদ তাকে সরিয়ে দেয়ার চিন্তা করতে পারে। আর সংসদ কর্তৃক অপসারিত হওয়ার আশঙ্কার কারণে একজন বিচারক স্বাধীনভাবে তার বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। এ চাপের কারণে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের যে অবস্থান তাকে আপসকামিতার জায়গায় নিয়ে যাবে।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের ক্ষমতা এর আগে ছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। তিন সদস্যের এ কাউন্সিলে অপর দুই সদস্য হলেন আপিল বিভাগের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিচারপতি। ১৯৭৭ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বর্তমান সরকার বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী পাস করে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ গত ৩ জুলাই সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের আপিল খারিজ করে দেন। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/243399