১২ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১:৩৮

আবারও দৃশ্যপটে সেই কীর্তিমান

আশিকুল হামিদ

কথায় বলে, হাজার ধোয়া-মোছা করলেও কোনো এক বিশেষ পদার্থের ময়লা নাকি পরিষ্কার করা যায় না। আর পক্ষাবলম্বনকেই যারা জীবনের কর্তব্য হিসেবে ধরে নেয় তাদের রক্তের কণায় কণায় নাকি চাটুকারিতার বীজ সুপ্ত এবং সক্রিয় থাকে। সুযোগ বা উপলক্ষ পেলেই তারা সেবাদাসের ভূমিকায় নেমে পড়ে। কথাটা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। রাষ্ট্রের মাননীয় প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর অন্য কোনো চাকরিতে নিযুক্তি নেন এমন খবর খুব একটা শোনা যায় না। প্রসঙ্গক্রমে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নাম উঠতে পারে। তিনি কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্তি নিয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদটির জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেদিক থেকে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক জনগণকে রীতিমতো স্তম্ভিত করেছেন। তিনি এখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে চাকরি করছেন। চেয়ারম্যান শব্দটিকে যতো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়েই বলা হোক না কেন, সেটা কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির জন্য সম্পূর্ণ বেমানান। পদটিতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে এককালের ‘মাননীয়’ বিচারপতি মিস্টার খায়রুল হক সবদিক থেকেই দেশের প্রধান বিচারপতির পদকে অসম্মানিত করেছেন। পদটির সঙ্গে স্বাধীন বিচার বিভাগের শুধু নয়, সার্বিকভাবে জনগণেরও মর্যাদা ও অধিকার জড়িত রয়েছে বলেই সাবেক এই প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে এভাবে শুরু করতে হলো।
এর কারণ বা উপলক্ষও তিনিই তৈরি করেছেন। গত ১ আগস্ট ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঘোষিত রায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা চলছে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ রায়টিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, নির্বাচন, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংসদ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং সামরিক শাসন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল বিষয়েই সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। রায়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সংবিধান এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। রায়টিতে অতীতের বিভিন্ন ভুল সম্পর্কেও সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আর সে সব ভুলের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জড়িত বলেই রায়ে ক্ষুব্ধও তারাই বেশি হয়েছেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্তমান ‘নির্বাচিত’ নামের সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হওয়ার পর সংশোধনীটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করা হয়েছিল। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৬ সালের মে মাসে দেয়া রায়ে হাই কোর্ট ষোড়শ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ও অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সরকার আপিল করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গত ৩ জুলাই ঘোষিত রায়ে হাই কোর্টের রায়কে বহাল রাখে। সে রায়টিই পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশ করা হয়েছে গত ১ আগস্ট।
সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে তুমুল হৈ চৈ করেছেন ক্ষমতাসীন দল ও জোটের এমপিরা। মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি আদালত অবমাননার মতো অশোভন ও আপত্তিকর বক্তব্যও রেখেছেন তারা। এদিকে পূর্ণাঙ্গ আকারে রায় প্রকাশিত হওয়ার পর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সুপ্রিম কোর্ট এবং মাননীয় বিচারপতিদের তুলোধুনা করে সিলেটের এক অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেছেন, বিচারপতিরা যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেবেন ততবার তারা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে সংশোধনীটি পাস করবে। মিস্টার মুহিত চ্যালেঞ্জ দেয়ার সুরে আরো বলেছেন, দেখি কতবার তারা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট এবং মাননীয় বিচারপতিরা সংশোধনীটি বাতিল করতে পারেন! আরেক মন্ত্রী বলেছেন, আদালতের হাত কত ‘লম্বা’ তা তিনি দেখে ছাড়বেন! দিন পাঁচেক পর্যন্ত ‘নিশ্চুপ’ থাকার পর সরকারের পক্ষ থেকে রায়ের কয়েকটি বক্তব্য ও শব্দের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে সমাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রায়টি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার এবং রায়ের বিরুদ্ধে জনমত ড়ড়ে তোলার জন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় পঞ্চদশ সংশোধনীও প্রকৃতপক্ষে বাতিল হয়ে গেছে। একই কারণে বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার হারিয়েছে। সরকারের তাই অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়টির নানাদিক নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যেই হঠাতই দৃশ্যপটে এসেছেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে ৯ আগস্ট তিনি মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার ঢঙে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন। মূলকথায় বলেছেন, রায়টি নাকি ‘পূর্বধারণা প্রসূত’ অর্থাৎ আগে থেকে করে রাখা চিন্তাভাবনার ফসল! এতে নাকি অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে এত বেশি পর্যবেক্ষণ রয়েছে যার ফলে মূল ইস্যুটাই হারিয়ে গেছে! নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মূলকথায় খায়রুল হক বলেছেন, জনগণের নয়, আমরা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বসবাস করছি!
আরো অনেক কথাও বলেছেন সাবেক এ প্রধান বিচারপতি। সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, আবারও তিনি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন। শুনতে কঠোর মনে হলেও এমন মন্তব্যের পেছনে শক্তিশালী কারণ রয়েছে। প্রধান একটি কারণ হলো, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ রয়েছে বাস্তবে যেগুলো খায়রুল হকের বিরুদ্ধে গেছে। যেমন এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া যে রায়ের অজুহাত দেখিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল, সে রায়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেঞ্চের সাত বিচারপতিই বলেছেন, রায়টিতে একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া রায়ের নামে প্রথমে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। এ পর্যন্ত এসেই নিজের গভীর বিস্ময়ের কথা প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বলেছেন, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্যাপারেই তৎপর থেকেছেন। তারা তাই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছেন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে অন্য কিছু বিষয়ের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে মাননীয় বিচারপতিদের অপসারণ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রসঙ্গ। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের সাতজন মাননীয় বিচারপতিই একমত হয়ে ঘোষণা করেছেন, প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান কোনো ফরমানের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছিলেন বলে যে প্রচারণা চালানো হয় সেটা সঠিক নয়। বাস্তবে সংসদের কাছ থেকে কেড়ে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। সে সংশোধনীর পেছনে প্রধান ভ’মিকা রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান- যিনি বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং জিয়াউর রহমানকে দায়ী করার সুযোগ থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিমত জানাতে গিয়ে বেঞ্চের সদস্য মাননীয় বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব লিখেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের নজরে এটাও আনা হয়নি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অভিসংশনের ক্ষমতা রহিত করেছিলেন। তিনি (শেখ মুজিব) ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করেছিলেন।’
বাকশাল এবং চতুর্থ সংশোধনী প্রসঙ্গে বেঞ্চের আরেক সদস্য মাননীয় বিচারপতি মো. ইমান আলী তার পর্যবেক্ষণে লিখেছেন, ‘সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্পষ্টতই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল।’ এই বিচারপতি আরো লিখেছেন, ‘আর ঘটনাক্রমে সেই সংসদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
এই পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট বা অভিসংশন ও অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে কেড়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে প্রচারণা চালানো হয় তা সঠিক নয়। কারণ, আলোচ্য রায়ে সাত বিচারপতিই এক সুরে বলেছেন, সংসদের কাছ থেকে কেড়ে বিচারপতিদের সম্পর্কিত এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে এটা করেছিলেন তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। সুতরাং জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের প্রচারণার পেছনে কোনো সত্যতা নেই। তাছাড়া রায়ে সাত বিচারপতিই বলেছেন, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে স্পষ্টতই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনী পরিষ্কারভাবে ছিল ‘সংবিধানের পরিপন্থী’ আর সেটাও করেছিলেন বাকশালের প্রধান নেতা ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠ করানোর ব্যাপারেও নতুন বিধান প্রবর্তন করেছিলেন একই নেতা।
এই বিধানে পরিবর্তন এনেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার সময় থেকে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করাতেন। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানটিতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এ ব্যাপারেও ক্ষমতাসীনরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা এমনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন যেন এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে! অন্যদিকে ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আসলে ফিরে গেছেন চতুর্থ সংশোধনীতে। বাকশালের বিধানে।
এভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কেন রায়টির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার কসরত করেছেন। বলা দরকার, চাকরিতে থাকাকালে এমন কিছু ‘ঐতিহাসিক’ রায় তিনি দিয়ে এসেছেন- যেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসকে তো বিতর্কিত করেছেই, সেই সাথে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতাকেও করেছে অনিবার্য। একটি উদাহরণ হিসেবে মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত রায়ের উল্লেখ করতে হবে। কারণ, যে ব্যক্তি মামলা করেছিলেন তিনি মালিকানা ফিরে পাননি। তাকে মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও কিছুই করেননি বিচারপতি খায়রুল হক। মাঝখান দিয়ে এই উপলক্ষে তিনি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন এবং মূল সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে ওই রায়কে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। একই কারণে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা সে সময় বলেছিলেন, রায় দেয়ার আড়ালে বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সংবিধানকেই ‘লন্ডভন্ড’ করে ফেলেছেন।
দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি সংক্রান্ত রায়ের কথা স্মরণ করা যায়। সে সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। কিন্তু আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই সরকার তাকে উচ্ছেদ করেছে। উচ্ছেদ ঠেকানোর ব্যাপারে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ সিনিয়র আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মিস্টার খায়রুল হকও আশ্বাস দিয়েছিলেন, আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হবে না। কিন্তু বাস্তবে আপিল বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই সরকার খালেদা জিয়াকে অসম্মানের সঙ্গে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। এটা ছিল পরিস্কার আদালত অবমাননা। কিন্তু দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক এ জন্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। শুধু তা-ই নয়, ক’দিনের মধ্যে খালেদা জিয়ার পক্ষে দায়ের করা লিভ টু আপিল এর শুনানি না করেই তিনি ‘উত্থাপিত হয়নি’ মর্মে আপিলটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। এসবের একটি মাত্র অর্থই হতে পারে- আর তা হলো, সরকারের সঙ্গে বিচারপতি খায়রুল হকের গোপন সমঝোতা ছিল। আইনজীবী সমিতির নেতারা সে সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন, মামলা নিষ্পত্তির আগে এ ধরনের উচ্ছেদের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর একটিও ঘটেনি।
খায়রুল হক বিরোধী সমালোচনার তৃতীয় কারণ হিসেবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের উল্লেখ করা দরকার। রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি আইনজীবী সমিতির নেতারাও সে সময় বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরিবর্তে স্ববিরোধিতাপূর্ণ সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে বিচারপতি খায়ররুল হক বিভ্রান্তি ও সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। একদিকে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে আবার বলেছেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। রায়ের এই অংশকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কারণ, তেমন ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই প্রধান উপদেষ্টার পদ ‘অলংকৃত’ করার সুযোগ পেতেন। অর্থাৎ রায় দেয়ার সময়ও সাবেক প্রধান বিচারপতি নিজের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেছিলেন!
অন্য কিছু উদাহরণ দিতে গিয়ে আইনজীবী নেতারা বলেছিলেন, দু-একটি ডিভিশন বেঞ্চ কখনো কখনো সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক তাৎক্ষণিকভাবে সে সব বেঞ্চের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। সিনিয়র ও দক্ষ বিচারপতিদের বসিয়ে রেখে জুনিয়র এবং স্থায়ীভাবে নিয়োগ না পাওয়া বিচারপতিদের দিয়ে বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে বিচার বিভাগে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগও উঠেছিল খায়রুল হকের বিরুদ্ধে। তাছাড়া অতীতের সব ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন করে খায়রুল হকের সময়েই সর্বোচ্চ আদালতে রায়ট পুলিশ ও দাঙ্গা পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রবেশ ঘটেছিল। পূববর্তী প্রধান বিচারপতি যে দু’জনের শপথ পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন, বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়েই সে দু’জনকে বিচারপতি বানিয়েছিলেন। তার মাধ্যমে অন্তত পঞ্চাশজনকে ডিঙ্গিয়ে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ ক্ষমতাসীন দলের দু’জন নেতা বিচারপতি পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। তাছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দায়ের করা বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তি করার পরিবর্তে ২০০৯ ও ২০১০ সালে বিরোধী দলের নেতা-কর্মিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করার মাধ্যমেও খায়রুল হক আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছেন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, বিচারপতি খায়রুল হক আওয়ামী লীগের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করেছেন। তার সময়ে আপিল বিভাগকে আওয়ামী লীগ সরকারের অংশে পরিণত করা হয়েছিল। খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেছিলেন, সংবিধান ‘ল-ভ-’ করলেও বহুদলীয় গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হত্যাকারী চতুর্থ সংশোধনীর বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি। অত্যন্ত ‘ঠান্ডামাথায়’ বিচার বিভাগকে বরং ‘খুন’ করেছিলেন খায়রুল হক।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মিস্টার খায়রুল হক আওয়ামী লীগ সরকারের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে এসেছেন। করেছেনও ‘অত্যন্ত নিষ্ঠা ও শতভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে’ই! তার মতো বিচারপতিদের কারণেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোনোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার ন্যক্কারজনক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে এবং বিচার বিভাগকে অকার্যকর বানিয়ে ফেলার পদক্ষেপ নিতে পেরেছিল। সেবার বিনিময়ে মিস্টার খায়রুল হককেও অবশ্য যথেষ্টই দিয়েছিল সরকার। ২০১১ সালের ৩০ মে দৈনিক আমার দেশ-এর একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ২০০৯ সালে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি আওয়ামী লীগ সরকারের ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা পেয়েছিলেন। ঘটনাটা ২০০৯ সালের ২৭ জুলাইয়ের। সোনালী ব্যংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় বিচারপতি খায়রুল হকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া চেকটি ইস্যু করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে।
কথা উঠেছিল একটি বিশেষ কারণে। সে কারণটি হলো, ওই টাকা পাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে, ২০০৯ সালের ২১ জুন বিচারপতি খায়রুল হক এক রায়ে ঘোষণা করেছিলেন, জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। খায়রুল হক তখন হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। অমন একটি রায় দেয়ার পর পর এত বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ায় বিশেষ ইঙ্গিতসহ গুঞ্জন ওঠাই ছিল স্বাভাবিক। সরকারের পক্ষে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ অবশ্য অনুদান নেয়ার ‘রেওয়াজ’ আছে শুনিয়ে খায়রুল হককে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাবেক এই প্রধান বিচারপতি ‘ক্লিন ইমেজ’ নিয়ে বিদায় নিতে পারেননি। বিদায়ের আগে প্রচলিত নিয়মে ‘ফেয়ারওয়েল’ও পাননি তিনি। ২০১১ সালের ১৬ মে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি তাকে বরং ‘গায়েবানা সংবর্ধনা’ দিয়েছিল- যেভাবে সাধারণত দূরে কোথাও মৃত কোনো মুসলমানের গায়েবানা জানাজা পড়া হয়।
এ ধরনের আরো অনেক তথ্যই রয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সম্পর্কে। কিন্তু সেগুলোর উল্লেখের পরিবর্তে বলা দরকার, সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মত রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সর্বশেষ উপলক্ষেও তিনি পদার্থ বিশেষের ময়লা সম্পর্কিত প্রবাদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

http://www.dailysangram.com/post/295771-