১২ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১:৩৬

আত্মপক্ষ

বাংলাদেশে পরিবেশবাদ

এবনে গোলাম সামাদ

কোনো অঞ্চলের কোনো ঋতুর গড়পড়তা আবহাওয়াকে বলে জলবায়ু। আবহাওয়া বলতে বোঝায় বায়ুর চাপ, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ, বৃষ্টিপাত, আকাশে মেঘের অবস্থা, বাতাসের গতিবেগ ও দিককে। বাংলাদেশকে বলা হয় ছয় ঋতুর দেশ। তবে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকাল হলো প্রধান ঋতু। গ্রীষ্মকাল বলতে ধরা হয় মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়কে। বর্ষাকাল বলতে ধরা হয় মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে আর শীতকাল বলতে ধরা হয় মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগ পর্যন্ত সময়কে।
বাংলা মাস সাধারণত শুরু হয় ইংরেজি মাসের মাঝামাঝি থেকে। বাংলাদেশের জলবায়ুর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়। বৈশাখ মাসে বজ্রবিদ্যুৎসহ এই ঝড় হয়। ঝড়ের সময় আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে এবং যথেষ্ট বৃষ্টিও হয়। বাংলাদেশে আষাঢ় শ্রাবণে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টি হওয়ার কারণ দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাস বঙ্গোপসাগর থেকে যথেষ্ট পরিমাণে জ্বলীয়বাষ্প বয়ে আনা। বাংলাদেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় না। তাপমাত্রা নেমে যায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এ সময় নারকেল তেল জমে যায়। হয়ে ওঠে চর্বি। শীতকাল এখানে মোটেও প্রখর নয়। তবে মাঝে মধ্যে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যাওয়ার রেকর্ড আছে, যেমনÑ রাজশাহী শহরে ১৯৮৯ সালে ১২ জানুয়ারি সকালে তাপমাত্রা হয়েছিল ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে সাধারণত শীতকালে তাপমাত্রা এত কম হয় না। এসব ভৌগোলিক তত্ত্ব দিতে হচ্ছে এ কারণে যে, পরিবেশবাদীরা বলছেন বাংলাদেশের জলবায়ু বদলাচ্ছে। অর্থাৎ বিভিন্ন ঋতুর আবহাওয়া আর আগের মতো থাকছে না। কিন্তু তারা বলছেন না, আবহাওয়া ঠিক কতটা বদলে গেছে।
পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন আগেও বহুবার ঘটেছে। কেবল আমাদের সময়ই যে ঘটছে তা নয়। যদিও অনেক পরিবেশবাদীর বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে, ঘটনাটি ঘটছে শুধু আমাদেরই সময়ে। আর তা হতে পারছে কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার জন্য। কয়লা পুড়িয়ে কলকারখানা চালাতে গিয়ে কয়লা পুড়ে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, তাতে থাকে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড। কার্বন ডাই-অক্সাইড পৃথিবীপৃষ্ঠের উত্তাপ ছড়িয়ে যেতে দেয় না। ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হতে থাকে আগের তুলনায় বেশি। ফলে সৃষ্টি হতে পারছে আবহাওয়া তথা জলবায়ুর পরিবর্তন। কিন্তু অতীতে যখন কোনো কলকারখানা ছিল না, তখনো জলবায়ুতে গুরুতর পরিবর্তন এসেছে, যার ব্যাখ্যা পরিবেশবাদীদের বর্তমান তত্ত্বের সাহায্যে করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি ১০ হাজার লিটার বাতাসে গড়পড়তা ৩ লিটার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকে। একটি হিসাব অনুসারে, যদি এই কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা হঠাৎ অর্ধেকে নেমে আসে, তবে পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাবে। পৃথিবীর বহু জায়গায় জমবে বরফ। অতীতে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। এ রকম সময়কে উল্লেখ করা হয় হিম যুগ বা আইস এইজ হিসেবে। কিন্তু হিম যুগের পরে আবার এক সময় শুরু হয়েছে উষ্ণ যুগ বা সান এইজ। এখন পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এটা উষ্ণ যুগের অংশ কি না, তা আমরা বলতে পারি না। পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর প্রতিদিন একবার করে ঘুরপাক খায়। এ জন্য সৃষ্টি হতে পারে দিবারাত্র। একে বলে আহ্নিক গতি। পৃথিবীর আরেকটি গতি আছে, যাকে বলে বার্ষিক গতি। বছরে পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এক দিকে হেলে। এর জন্য ঘটে ঋতু পরিবর্তন। দিবারাত্রি বাড়ে-কমে। অনেকে মনে করেন, পৃথিবী যদি কোনো কারণে একটু কম হেলে ঘোরে, তবে পৃথিবীতে তাপ বাড়ে। তাপ বৃদ্ধি নির্ভর করে পৃথিবী সূর্যকে কতটা কোণ করে হেলে ঘুরছে, তার ওপর। এই কোণ সব সময় যে একই থাকে, এমন নয়। কোণের হেরফেরে হতে পারে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ যে বাতাসে কেবল কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কম-বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল, এ কথা সব বৈজ্ঞানিক স্বীকার করেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কলকারখানা চালাতে আগের মতোই কয়লা পোড়াবেন। কয়লা পোড়ানোর ওপর তিনি কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করবেন না। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে ইচ্ছুক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পরিবেশবাদী আন্দোলন থেকে সরে থাকে, তবে এই আন্দোলন যে নিস্তেজ হয়ে পড়বে, সেটা সহজে অনুমান করা চলে। কেননা, এই আন্দোলন সতেজ হওয়ার মূলে ছিল মার্কিন অনুদান।
বাংলাদেশে পরিবেশবাদীরা ঠিক কী চাচ্ছেন, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ এখনো একটি কৃষি অর্থনীতিনির্ভর দেশ। আর ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। কলকারখানার অর্থনীতি এখনো এখানে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তা প্রতিষ্ঠিত হতে যথেষ্ট সময় লাগবে। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল আমাদের দেশের পরিবেশ অধিদফতর থেকে বলা হয়, দেশের পরিবেশ দূষণের জন্য ১১৭৬টি শিল্পকারখানা দায়ী। অর্থাৎ পরিবেশবাদীদের দাবি মানলে নতুন কলকারখানা তো গড়া যাবেই না, যেসব কলকারখানা আছে সেগুলোও করতে হবে ধ্বংস। ফলে আমাদের অর্থনীতি কী অবস্থায় পড়বে সেটা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশে মোট জমির শতকরা ৬০ ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটার উঁচু। বর্ষাকালে বাংলাদেশের শতকরা ২০ ভাগ জমি বন্যার পানিতে ডুবে যায়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের পরই আসে বন্যার কথা। শিল্পপ্রধান দেশে বাঁধ বেঁধে নদীর ভাঙন ও বন্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। কেননা ওইসব দেশে আছে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তি, যা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শিল্প-বিপ্লব ঘটলে আমরাও অনেক সহজে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সক্ষম হব; যেটাকে পরিবেশবাদীরা নিতে চাচ্ছেন না তাদের বিবেচনায়। তারা শুধুই ভাবছেন জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্র-প্রয়াণ বিদস পালিত হলো। এটা ছিল তার ৭৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ তার একটি কবিতায় লিখেছেন :
দাও ফিরিয়ে সেই অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা।
(চৈতালি। সভ্যতার প্রতি)
আমাদের দেশের অনেক পরিবেশবাদী যেন ফিরতে চাচ্ছেন আদিম আরণ্যক জীবনে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? অরণ্যের পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। অরণ্যে থাকে না মানুষের খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা। মানুষ তায় অরণ্য পুড়িয়ে পরিষ্কার করে গড়েছে কৃষিক্ষেত্র। নিশ্চিত করতে চেয়েছে তার খাদ্য সরবরাহকে। এক সময় বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলই ছিল অরণ্যে আবৃত। ১০০ বছর আগেও ঢাকা শহরের কাছে সাভারে ছিল গভীর শালবন। যেখানে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দেও খ্যাঁদা করে ধরা হয়েছে বুনোহাতি। সাধারণত মনে করা হয় আজ যেখানে বাংলাদেশ, সেখানে হাজার দশেক বছর আগে থেকে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করেছে। আমাদের পরিবেশবাদীরা যা বলছেন, যেমন জীবনের কথা ভাবছেন, তাকে বলতে হয় এক অসম্ভব ভাবনা। আমরা এ রকম পরিবেশবাদী কখনোই হতে পারি না।
রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রসভ্যতার বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশে তার সময়ে কি বিলাতের মতো শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল? আমরা বাংলাদেশে যন্ত্রসভ্যতার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হই কয়লা পুড়িয়ে চলা স্টিম ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়ি চলার ফলে। এ ছাড়া নদীতে চলেছে স্টিমার। তাও চলেছে কয়লা পুড়িয়ে স্টিম ইঞ্জিনের সাহায্যে। কলকাতার ধারে-কাছে হুগলি বা ভাগীরথী নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু চটকল, কিন্তু সারা দেশ ছিল কৃষিজীবী মানুষের। যাদের সাথে যন্ত্রসভ্যতা ও নগর জীবনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তথাপি রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন নগর সভ্যতার সমালোচনা। তিনি সম্ভবত এটা করেছিলেন বিলাতের দার্শনিক জন রাসকিন (১৮১৯-১৯০০)-এর চিন্তার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিলাতে ঘটে শিল্প বিপ্লব। যার কারণে বহু মানুষের জীবনে আসে বিরাট বিশৃঙ্খলা। রাসকিন এর বিরোধিতা করেন। তিনি মানুষকে আঁকড়ে থাকতে বলেন আগের দিনের হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে। রবীন্দ্র-চিন্তা এ ক্ষেত্রে যে খুব মৌলিক ছিল, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
এখন যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, সেখানে রেলগাড়ি চলে ১৮৬২ সালে। এই রেল খোলে ইস্টার্ন-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি। প্রথমে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত এই রেলপথ ছিল ১১১ মাইল। ১৮৭১ সালে এই রেললাইন গোয়ালন্দ পর্যন্ত নিতে হয়। গোয়ালন্দ থেকে ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা হয় স্টিমারে। ঢাকা বিভাগে রেলপথ খোলা হয় অনেক পরে। ১৯০৪ সালে খোলা হয় আসাম-বাংলা রেলপথ, যা আসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যায়। এই রেলপথ করতে গিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কাটতে হয়েছিল অনেক মাটির পাহাড় বা টিলা। কিন্তু এসব টিলা ভূমির সাথে এমন কোণ করে কাটা হয়েছিল যে, এগুলো ধসে পড়েনি। বর্তমানে পত্রিকায় টিলা ধসে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কেননা এসব টিলা কাটা হচ্ছে এমনভাবে যে, টিলার মাথা ভারসাম্য হারিয়ে ধসে পড়ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এভাবে টিলা কেটে বসতি করা যায়নি। এমনকি সাবেক পাকিস্তান আমলেও মানুষ টিলা কেটে বসতি করার কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু এখন প্রশাসনিক দুর্বলতার জন্য মানুষ কাটতে পারছে টিলা। গড়তে পারছে বেআইনি জনবসতি। আর তাদের ওপর একপর্যায়ে ভেঙে পড়ছে টিলা। এটা কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের ফলে যে ঘটছে, তা নয়। তবুও পরিবেশবাদীরা একে ফেলতে চাচ্ছেন পরিবেশ দূষণের মধ্যে। এত ব্যাপক অর্থে পরিবেশ দূষণ কথাটা প্রয়োগ না করাই ভালো। পরিবেশ দূষণ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি পানি, মাটি ও বাতাসে এমন কিছু যুক্ত হওয়া, যা মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিতÑ মাটি, পানি ও বাতাসে যাতে মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বস্তু যুক্ত হতে না পারে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/243311