১১ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪৩

আদালতে নেয়া-আনা বন্দিদের ভোগান্তি

আদালতে আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কারাবন্দিদের। কারাগার থেকে আদালত ও আদালত থেকে কারাগার পর্যন্ত পদে পদে দুর্ভোগ। এ অবস্থায় প্রায় সময় অসুস্থ হয়ে পড়ছে বন্দিরা। ফলে আদালতে হাজিরার দিনটি আসামিদের কাছে এখন বিভীষিকাময়। ডিসি-প্রসিকিউশন মোহাম্মদ আনিসুর রহমান আদালতে আনা-নেয়ায় বন্দিদের দুর্ভোগের বিষয় স্বীকার করে বলেন, দীর্ঘ যানজট ও প্রিজনভ্যানের গরমে আনা-নেয়ার সময় অনেক বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য আবার অ্যাম্বুলেন্সও নেই। এ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে দুর্ভোগে। এছাড়া আদালতে হাজিরার দিন বন্দিদের দীর্ঘ সময় উপোস থেকে কাটাতে হচ্ছে। এ সময় তারা ক্ষুধার জ্বালায় অনেক সময় পুলিশের উপরও চটে যায়। কারাগারে বন্দিদের জন্য যে খাবার বরাদ্দ আছে তা হাজিরার দিন আদালত প্রাঙ্গণে খাওয়ানোর ব্যবস্থা নিলে দুর্ভোগ কমবে বলেও মত দেন তিনি।

অনুসন্ধান ও বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর প্রায় ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতগুলো রয়েছে ঘিঞ্জি এলাকা হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায়। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিশেষায়িত বেশ কিছু আদালত। কিন্তু বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় কোনো কারাগার নেই। সর্বশেষ পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জে। আর সবচেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার কাশিমপুর কারাগার-১, ২, ৩ (নারী কারাগার) ও কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার রয়েছে আরো দূরে গাজীপুরে। প্রতিদিন গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জ থেকে পাঁচ শতাধিক বন্দি ঢাকায় বিভিন্ন আদালতে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য আনা-নেয়া করতে হয়। এরপর প্রতিটি স্তর ভোগান্তির মধ্য দিয়ে পার করতে হচ্ছে হাজতি ও কয়েদিদের। ঢাকায় প্রতিদিন বেশি বন্দি আনা-নেয়া হয় কাশিমপুরের ওই চার কারাগার থেকে। মামলায় আদালতের ধার্য তারিখের আগের দিনই কারাগারের ওয়ার্ডে সংশ্লিষ্ট আসামিকে পরদিন সকালে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেয়া হয়। আসামিদের মধ্যে যারা কারারক্ষীদের মাসোয়ারা দিতে পারে না তাদের আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতির নামে রাত ৭টা বা ৮টার দিকেই কারাফটকে এনে বসিয়ে রাখা হয়। নির্ঘুম রাত কাটে তাদের। আর যারা টাকা দিয়ে থাকে তাদের ঘুম থেকে জাগানো হয় শেষ রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে। এরপর আনা হয় কারাফটকে। তবে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামিদের সকালে প্রিজনভ্যানে উঠানোর জন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়। বর্তমানে কাশিমপুরে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার দিকে কারাফটকে দেহতল্লাশির পর তাদের তুলে দেয়া হয় প্রিজনভ্যানে। এ সময় বন্দিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে কিছু শুকনো চিড়া ও গুড়, যা এতই নিম্নমানের যে খাওয়ার উপযোগী নয়। তাই অনেকে তা নেয় না বা নিলেও ফেলে দিচ্ছে। আর কেরানিগঞ্জে দেয়া হচ্ছে একটি করে বনরুটি। ওইদিন কারাবন্দিদের জন্য তাই একমাত্র খাবার। কেননা তারা আসার পর নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৮টার নাস্তা, দুপুর ১২টা ও বিকাল ৩টার ভাত, ডাল ও তরকারি মিস করছে। তারা আবার কারাগারে পৌঁছাতে লেগে যায় সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। দীর্ঘ ভ্রমণ ও আদালতে দৌড়ঝাঁপ থাকলেও ওইদিন উল্টো তাদের ২৪ থেকে ৩০, এমনকি ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত উপোস থাকতে হচ্ছে। এ সময় আদালত চলাকালীন কারাবন্দিদের কারো কারো স্বজন আদালতের হাজতখানা থেকে সংশ্লিষ্ট এজলাসে নেয়ার আগে-পরে পুলিশের হাতে ৫০, ১০০ থেকে ৩০০ টাকা গুঁজে দিলে দুপুরে কিছু খেতে দেয়। তাতে আবার বিষাক্ত খাবার প্রয়োগের ঝুঁকিও রয়েছে। আনা-নেয়া ও আদালতে থাকাকালীন ক্ষুধার্ত কারাবন্দিরা পুলিশের সঙ্গে রুক্ষ আচরণ করছে। অনেকে ওইদিন রোজা রাখছে। প্রিজনভ্যানে উঠা-নামা এবং যাতায়াতের সময় চিল্লাচিল্লি করে। কিন্তু হেফাজতের দায়িত্বরত পুলিশ নির্বিকার।
কারাবন্দিদের আরেক আতঙ্ক প্রিজনভ্যান। লোহার পাত ও টিনের প্রকোষ্ঠের প্রিজন ভ্যানগুলোতে বাতাস চলাচল সীমিত হওয়ায় এমনিতেই তা খুব উত্তপ্ত। তার উপর প্রত্যেক প্রিজনভ্যানে ঠাসাঠাসি করে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি তোলা হয়। ঢুকতেই অসহনীয় গরমে হাঁপিয়ে উঠে বন্দিরা। এ অবস্থায় কাভার্ডভ্যানে অনেক বন্দি বমি এবং প্রাকৃতিক কাজও করে ফেলে। আবার অনেকে ধূমপান ও নেশা করে। তাতে উৎকট দুর্গন্ধে দুর্বল বন্দিদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। গাড়ির ঝাঁকুনি ও হার্ড ব্রেকে একজন ছিটকে পড়ছে অন্যের গায়ের উপর। এ নিয়ে প্রিজনভ্যানে বন্দিদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটছে। প্রিজনভ্যানে দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার যানজটে আটকা পড়ে। তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। খুলে ফেলে গায়ের পোশাকও। কেরানীগঞ্জ থেকে রওনা দেয়ার আধ ঘণ্টায় আদালতপাড়ায় পৌঁছার কথা থাকলেও তীব্র যানজটে লেগে যাচ্ছে দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টা। কাশিমপুরের বন্দিদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা আরো শোচনীয়। একই কারণে দুই আড়াই ঘণ্টা রাস্তা পাড়ি দিতে হচ্ছে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টায়। ফলে ভোর ৬টায় কেরানিগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে আদালতে পৌঁছাচ্ছে সকাল ১০ থেকে ১১ টায়। একইভাবে বিকাল ৫টা বা ৬টায় রওনা দেয়ার পর কারাগারে পৌঁছাতে লেগে যাচ্ছে রাত ৯টা থেকে ১১টা।
গত সোমবার বিকালে প্রিজনভ্যানের জানালা দিয়ে কথা হয় বন্দি হায়দার মানিক ও সাগর আহমেদের সঙ্গে। তারা বলেন, প্রিজনভ্যানে গরমে দাঁড়ানো যায় না। গায়ের কাপড় খুলে ফেলে প্রায় সবাই। সারা গায়ে ঘামের বন্যা। তার উপর অনেকে গাড়িতেই নেশা করে। সিগারেট ধরায়। বমি করে। এমনকি পায়খানা প্রস্রাবও করে দেয়। এ অবস্থায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকার সময় মনে হয় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া আদালতের গারদ বা হাজতখানায়ও আসামিরা দুর্ভোগে রয়েছে। প্রিজনভ্যান থেকে বন্দি আদালতের হাজতখানায় নেয়া হয়। সেখান এক বা একাধিক পুলিশ সদস্য তাদের সংশ্লিষ্ট আদালতে নেন। আদালতের কাজ সেরে আবার আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় তিনটা হাতজখানা দেখা গেছে। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানা, ঢাকা জেলা হাজতখানা ও জজ কোর্ট হাজতখানা। প্রতিটিতেই অপরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি অতিরিক্ত বন্দি ঠাসাঠাসি করে রাখার কারণে সেখানেও স্বস্তি নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক বন্দি। গত সোমবার ঢাকা জেলা হাজতখানার ২ কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, যে কক্ষে একটি টেবিল পেতে প্রশাসনিক কাজ চলছে সেই কক্ষেই ৭ জন নারী বন্দিকে রাখা হয়েছে। এক বন্দিকে বের করার জন্য পুরুষ কক্ষের দরজা খুলতেই তাতে গাদাগাদি করে বন্দিদের বসে, শুয়ে ও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সেই ছোট্ট হাজতকক্ষ দু’টিতে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ নারী ও পুরুষ বন্দি রাখা হয় বলে জানান দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য। আর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় রাখা হয় ২০০ থেকে ৪০০ হাজতি ও কয়েদিকে। অন্যদিকে জজ কোর্ট হাজতখানার ২টি নারী ও ৩ পুরুষ কক্ষে দেড় থেকে ২০০ বন্দি রাখা হচ্ছে।
ঢাকা জেলা হাজতখানায় বিকালে ৪০ দিনের নবজাতক কোলে সাভারের সিন্দুরিয়ার আফরোজা বলেন, ওয়ারেন্ট মূলে রোববার রাতে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এখানে আনে। নবজাতকসহ তাকে প্রিজনভ্যানে করে কিভাবে কারাগারে নেয়া হবে জানতে চাইলে মুখ খোলেননি দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা।
বিগত ৯০ দিন কারাভোগের পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আদিল বাবু মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত কারাগারে প্রতিদিন রুটি, গুড়সহ আটটার দিকে সকালের নাস্তা, দুপুর ১২টা ও বিকাল ৩টায় ডাল এবং তরকারিসহ ভাত দেয়া হয়। কিন্তু যেদিন আদালতে হাজিরা থাকে সেদিন সকাল ৭টায় গাড়িতে উঠানোর আগে লাইনে থাকতে হাতে একটা বনরুটি দেয়া হয়। সেদিন হাঁটাহাটিসহ গাড়িতে জার্নি হলেও আর কোনো খাবার দেয়া হয় না। সেই সামান্য খাবার খাওয়ার পর ২৪ থেকে ২৫ ঘণ্টা পরে পরদিন সকাল ৮টায় খাবার জুটে। এই দীর্ঘ সময় উপোস থাকতে হচ্ছে বন্দিদের। এছাড়া আদালতের গারদখানায় অপরিচ্ছন্নতা ও গাদাগাদিতে অতিষ্ঠ। অথচ কোনো কোনো বন্দিকে শুধু তার হাজিরার জন্য এভাবে আনা-নেয়া করা হচ্ছে।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে প্রিজনভ্যান চালান মোস্তাফা কামাল। এখন কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা মেট্রো শ ১১-০৬৫৫ নম্বর গাড়িতে প্রতিদিন বন্দি আনা-নেয়া করেন। তিনি বলেন, গরমের কষ্ট ও ক্ষুধায় বন্দিরা প্রিজনভ্যানের মধ্যেই চিল্লাচিল্লি করে। একে অন্যের সঙ্গে মাঝে মাঝে মারামারিও করে। সোমবার আমার গাড়িতে ১৭ জন মিলে পিটিয়েছে একজনকে। তখন গাড়ি থামাতে পীড়াপীড়িও করে। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নেই। দরজা না খুলেই চলে আসি আদালতে। তবে যানজটে কষ্টটা বেশি হচ্ছে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=78261