১১ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪১

চালের বাজার চড়া নেপথ্যে সিন্ডিকেট

রাজধানীর বাজারগুলোতে আবারও চালের দাম বেড়েছে। কেজিতে এক-দুই টাকা বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা চাল বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ ভোক্তারা। সংশ্লিষ্টদের দাবি, অসাধু ব্যবসায়ী চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। চক্রটি সিন্ডিকেট করে চাল মজুদ করছে। এর পর সংকটের নামে দাম বাড়িয়ে মজুদ করা চাল ধীরে ধীরে বাজারে ছেড়ে অতি মুনাফা করছে চক্রটি। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না বলে মন্তব্য তাদের।

জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় দেড় লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও নতুন করে যুক্ত হওয়া কম্বোডিয়া থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে থাইল্যান্ডের সঙ্গে চাল আমদানির চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ব্যাপক হারে প্রভাব পড়েনি বাজারে। তবে কয়েক মাসের ব্যবধানে চালের কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৩ টাকা বেড়ে সেই বাড়তি দাম থেকে কমেছে মাত্র ৫ টাকা। এর আগে পাইকারি পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। মাঝখানে লাফিয়ে লাফিয়ে ৫০ টাকায় উঠে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকায়। আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। অর্থাৎ শুল্কমুক্ত চাল আমদানির সুযোগ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা চালের বাজারে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। সরজমিন চালের বাজার ঘুরে আড়ৎদার ও মিল মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে দামের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
এর আগে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, অবৈধভাবে চাল মজুদ করায় ১৬ হাজার মিল মালিককে (মিলার) কালো তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। আগামী তিন বছর কালো তালিকাভুক্ত এসব মিলারের কাছ থেকে সরকার চাল কিনবে না। কিন্তু ফলাফল কিছুই পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা।
সূত্র জানায়, চাল আমদানিতে আরো শুল্ক প্রত্যাহার হতে পারে, এমন আশায় দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল খালাস করছেন না আমদানিকারকরা। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে আটকা পড়ে আছে দেড় শতাধিক চালবোঝাই ট্রাক। দেশের বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে ও দ্রুত মজুদ বাড়াতে চাল আমদানিতে পুরোপুরি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠানোর বিষয়ে সমপ্রতি খবর প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এ খবর প্রকাশের পরই স্থলবন্দর থেকে চাল খালাস বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতারা জানান, এ কারণেও চালের দাম বাড়ছে। সম্প্রতি চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরো ৫ শতাংশ কমানোর সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এর আগে চাল নিয়ে সংকট হওয়ায় চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, হাওর অঞ্চলে বন্যা কারণে ধান উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর চালের দাম রেকর্ড বেড়ে যায়। এক মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৬-৫০ টাকায়। চিকন চালের দাম ওঠে প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকায়। আমদানি শুল্ক হ্রাস ও শূন্য মার্জিনে চাল আমদানির ঘোষণার পর এক সপ্তাহের মধ্যে পণ্যটির দাম কেজিতে ৩-৫ টাকা পর্যন্ত কমে। যদিও ওই সময় আমদানি ছিল সীমিত। এরপর ব্যাপক পরিসরে চাল আমদানি হলেও এর প্রভাব পড়ছে না দামে। দুই সপ্তাহ আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে এখনো।
বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৬ ও চিকন চাল ৫৪-৫৮ টাকায়।
পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল কিনতে প্রতি কেজি ৫৩ টাকা ৫০ পয়সা গুনতে হচ্ছে, যা খুচরা বাজারে ৫৬ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। অথচ গত বছর এ সময়ে এই চাল কেজিপ্রতি ৪৬-৪৮ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। একজন ক্রেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, প্রতি মাসেই চালের দাম বাড়ছে। চালের দাম কমাতে সরকারের শুল্ক কমানোর কথা শুনছি। কিন্তু বাজারে তার প্রভাব নেই। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি হচ্ছে শুধু মোটা ও আতপ চাল। এই দুই ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা কমেছে। মিলমালিকদের দাবি, ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া তাঁদের উপায় নেই।
বাজারে দেখা গেছে, সরু নাজিরশাইল চাল কেজিপ্রতি ২ টাকা ও মাঝারি বিআর-২৮ জাতের চাল ১ টাকা বেড়েছে। মজুমদার ব্র্যান্ডের বিআর-২৮ চাল কেজিপ্রতি ৪৭ টাকা ছিল, এখন তা ৪৮ টাকা এবং একই ব্র্যান্ডের বিআর-২৯ জাতের চাল ৪৫ থেকে বেড়ে ৪৬ টাকা হয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও সেগুবাগিচা কাঁচা বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক দিন আগে মিলমালিকেরা প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) মিনিকেট চালের দাম ২৫ টাকা বাড়িয়েছেন। এতে কেজিপ্রতি বাড়তি দাম পড়ছে ৫০ পয়সা। আর মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১ টাকা। আর এই দুই ধরনের চালের ক্রেতা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।
আমদানির পরও চালের দাম কমছে না কেন জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের হাজি ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের মাঈন উদ্দিন বলেন, আমদানি হচ্ছে সবাই জানে। কিন্তু যে পরিমাণ আমদানি হওয়ার কথা, সত্যিকারে তা আসছে কি-না খতিয়ে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন-জুলাই এই দুই মাসে চাল দুই হাজারেরও বেশি কোটি টাকার চাল আমদানির এলসি খোলা হয়। এলসি নিষ্পত্তির পর দুই মাসে দেশে প্রায় দেড় লাখ টন চাল এসেছে। আমদানি পর্যায়ে রয়েছে আরো অনেক চাল।
বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, মান ভেদে চালের কেজি ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা বেড়েছে। তবে শুল্ক আরো কমলে এবং আমদানি বাড়লে চালের দাম অনেক হ্রাস পাবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যায় ফসলের ক্ষতি এবং সরকারি গুদামের মজুদ কমে আসার প্রেক্ষাপটে সমপ্রতি ভিয়েতনাম থেকে ৯০৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারি ক্রয় সংক্রায় মন্ত্রিসভা কমিটি গত ১৪ই জুন দরপত্র ছাড়াই সরকারি পর্যায়ে এই চাল আমদানির অনুমতি দেয়। এর মধ্যে গত ১৩ই জুলাই বৃহস্পতিবার প্রথম চালানে ২০ হাজার টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। গত ১৭ই জুলাইয়ে ২৭ হাজার টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ এবং গত ২২ জুলাই তৃতীয় চালানের চাল বাংলাদেশে পৌঁছায়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=78256&cat=2/