১১ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩৯

আল-আকসায় ইহুদিদের বর্বোরচিত হত্যাযজ্ঞ

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক রোগার গ্যারাউডির প্রধান রচনায় দুনিয়ার মুসলিম শাসককুলের প্রতি সাবধান বাণীটি ছিল “ইসরাইলের অগণিত লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সবচাইতে ভয়ংকর হচ্ছে ফিলিস্তিনের অধিবাসীদিগকে হত্যা, জোর, জুলুম করে তাড়িয়ে দিয়ে তথায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজে তারা সফল হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান উচ্ছেদ শুরু করবে। সেই অভিযান হবে হিটলারের নতুনরূপ। (সুত্র : Garaudy, The Case of Israel) ইহুদিরা হচ্ছে আল্লাহর অভিশপ্ত জাতি। বনী ইসরাইলদেরকে আল্লাহ তায়ালা সম্মান দিয়েছিলেন যখন তারা বিশ্বাসী বা মুমিন ছিলো। ছিলো পয়গম্বরদের অনুগত এবং নাজিলকৃত শিক্ষার বাহক। তারা কুটিল পন্থায় জটিলভাবে জড়িয়ে পড়ে। তারা ইব্রাহীম, যোসেফ এবং মূসা (আ.) এর পবিত্র শিক্ষাকে মিথ্যায় কলুষিত করেছে। অসংখ্য পয়গম্বরকে হত্যা করেছে। সন্ত্রাস এবং কলুষতা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে এবং ছলনা ও সুদীকারবার ব্যবস্থায় মানুষদেরকে তাদের ধন সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে। অসংখ্য নবীর স্মৃতিধন্য ও মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস-এর পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন আজ ইহুদিদের কবজায়।
১৯১৪ সালে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। তারা ফিলিস্তিন বিজয়ীবীর সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মাযার শরীফ-এ পদাঘাত করে উচ্চস্বরে বলতে থাকে “হে সালাহ উদ্দিন উঠে দেখ আমরা তোর সিরিয়া জয় করে এসেছি”। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। পৃথিবীর কোন দেশ তাদের ভূখন্ডে ইহুদিদের বসাতে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ কুক্ষিগত করা ও বিভিন্ন স্বার্থ অক্ষুণœ রাখার প্রয়োজনেই এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে লালন করা হচ্ছে। ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৪ লক্ষ ৬৫ হাজার। আমেরিকার মদদে ইসরাইল এখন এতটাই শক্তিশালী যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। মুসলমানদের শক্তি হিসেবে বর্তমানে ইসরাইলকে চোখ রাঙ্গিয়ে আসছে ইরান। আর তাই ইরান-ইসরাইল এখন এক রণাঙ্গনের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন বিশ্ব মানচিত্র থেকে ইসরাইলের নাম আবার মুছে যাবে। রাসূল (সা.) সেই ভবিষ্যদ্বাণীই করেছেন ইহুদিদের সম্পর্কে। তবে সেটির জন্য দরকার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একতা। গোটা মুসলিম এখনো নীরব থাকা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। মূলত ইহুদিচক্র গোটা পৃথিবীর মুসলমানদের বিভক্ত করে রেখেছে। এ জন্যই মুসলমানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অনৈক্য সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এই বীরের জাতি। অথচ মুসলমানদের ইতিহাস অনেক গৌরবের, অনেক সাফল্যমন্ডিত। মুসলমানরা আজ যেন সব হারাতে বসেছে।
কিন্তু ইহুদিরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে পূর্বসূরীদের নির্দেশনা। ইসরাইলী সাবেক মন্ত্রী ইজাক রবিনের The Robin Memoris নামক আত্মজীবনীতে লিখেন-১৯৪৮ সনে যখন ইসরাইলী সেনারা ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ছলনা করে অবৈধ ইসরাইলী রাষ্ট্র গঠন করছিল। সে সময়ে রবিন একজন ২৬ বছর বয়সী তরুণ ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্বীকার করে বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুড়িয়ান তাকে তেল আবিবের নিকটবর্তী দুটি শহর থেকে ৫০,০০০ আরব অধিবাসীকে শক্তি প্রয়োগ করে তাড়িয়ে দিতে আদেশ দেন। (NŸws Week, Nov 5, 1979) বিশ্ব-ইহুদিদের কাছে নেপোলিয়নের আহ্বানটি এখনো অনুকরনীয় নির্দেশনা হিসেবে তারা পালন করছে-হে ইসরাইলীগণ! হে ‘তীহ’ প্রান্তরে বিতাড়িতগণ! শক্তির সাথে জাগ্রত হও! তোমাদের সামনে এখন তোমাদের জাতির জন্য এক ভয়াবহ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে! দ্রুত অগ্রসর হও, এই তো সময়- এমন সুবর্ণ সময় হয়তো হাজার বছরেও আর ফিরে আসবে না। যে অধিকার হাজার হাজার বছর ধরে তোমাদের থেকে হরণ করা হয়েছে তা হচ্ছে- বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটি জাতি হিসেবে তোমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং তোমাদের প্রভু ‘ইয়াহুয়াহ’কে তোমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী উপাসনা করার নিরঙ্কুশ সহজাত অধিকার। তা তোমরা প্রকাশ্যে কর, চিরদিন কর! বোনাপার্ট ইহুদিদের প্রভুত্বব্যঞ্জক আচরণের শেষ কোথায়?
বর্তমান সময়ে ইহুদি আগ্রাসীরা নিজেদেরকে অতীতের যে কোন উচ্চাকাক্সক্ষী রাজা বা দেশের চাইতেও বেশি শক্তিশালী, ধন সম্পদশালী এবং চাতুরতায় পারদর্শী বলে মনে করে। তারা তাদেরকে সারা দুনিয়া এবং মানবজাতির প্রভু বলে বিবেচনা করে। মানব জাতির বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যেমন প্রযুক্তি বিদ্যা, সমরাস্ত্র, অর্থ, খাদ্য, ওষুধপত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাদের হাতে বা দখলে আছে বলে তারা দাবি করে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে ইসরাইল একদিন আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সে দিন বেশি দূরে নয়। CBS টেলিভিশনের Face The Nation অনুষ্ঠানে ১৯৭৩ সনে সিনেটর উইলীয়াম ফুলব্রাইট ঘোষণা দেন যে, সিনেট হচ্ছে- আমেরিকান স্বার্থের পরিপন্থি ইসরাইলী স্বার্থের অধীনস্ত সহায়ক কেনা গোলাম। সিনেটর জেমস জি আবরেজক বলেন : “যুক্তরাষ্ট্র যদি আগে নাও হয়ে থাকে- তবে একটি অধীন রাষ্ট্রের কাছে বন্দী হতে যাচ্ছে- অর্থাৎ ইসরাইলের অধীন হতে যাচ্ছে।”
জেরুজালেমের পবিত্র আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরাও তাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে ইসরাইল। আল-আকসায় প্রবেশের ওপর ইসরাইলী বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করে শনিবার পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে পৃথক দুই হামলার ঘটনায় আরও দুই ফিলিস্তিনী কিশোরকে হত্যা করেছে ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনী। ইসরাইলের এ ধরনের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে কূটনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে তেলআবিব। উত্তেজনা প্রশমনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক ডেকেছে। এদিকে ওই মসজিদের প্রবেশ পথে মেটাল ডিটেক্টর সরানোর ইঙ্গিত দিয়েছে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ। খবর বিবিসি, এএফপি ও আল-জাজিরা।
আল-আকসা মসজিদে প্রবেশে ইসরাইলী বিধি নিষেধের ফলে সৃষ্ট বিক্ষোভে আহত দুই ফিলিস্তিনী কিশোর শনিবার হাসপাতালে শাহাদাতবরণ করেছে। গত কয়েকদিনে বেশ কয়জন ফিলিস্তিনী শহীদ হলেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার পূর্ব জেরুজালেমের আল আইজারিয়াতে ইসরাইলী সেনাদের গুলীতে ওদে নাওয়াজা (১৭) শহীদ হন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পশ্চিম তীরের আবু দিস গ্রামে নিহত হন ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ।
১৪ জুলাই ঐ মসজিদের কাছে দুই ইসরাইলী পুলিশ নিহত হওয়ার পর সেখানে মেটাল ডিটেক্টরগুলো বসায় ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ। মুসলিমরা যাকে ‘হারাম আল শরিফ’ বলে সেই স্থানটিকে ইহুদিরা ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় আল-আকসা মসজিদে শুধু ৫০ বছরের বেশি বয়সী মুসল্লিদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়। তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ফিলিস্তিনীরা। ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনী ওই বিক্ষোভ দমনে ফিলিস্তিনীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলী ছোঁড়ে। ফিলিস্তিনী এক যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ৩ ইসরাইলী। নতুন এ উত্তেজনায় সব মিলিয়ে অনেকসংখ্যক নিহত হয়েছে।
আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। শনিবার ইসরাইলের এ ধরনের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। তিনি এ ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানান।
আল-আকসায় ইসরাইলী আগ্রাসন নিয়ে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে ইসরাইলকে থামানোর আহ্বান জানান তিনি। শনিবার এক লিখিত বিবৃতিতে এরদোগান বলেন, আল-আকসায় আমার ভাইদের হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অবিলম্বে ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে মেটাল ডিটেক্টর বা অন্য কোনো বাধা থাকতে পারবে না। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইল সরকার কর্তৃক আগ্রাসন থামাতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আল-আকসা মসজিদের ফটকে বিতর্ক সৃষ্টিকারী মেটাল ডিটেক্টরগুলো সরিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় ইসরাইল রাজি বলে জানান দেশটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল ইয়োভ মোদেশাই বিকল্প পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘জর্ডান ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্র এ সমস্যা সমাধানে বিকল্প কোনো নিরাপত্তা পরামর্শ দেবে বলে আমরা আশা করছি। সমস্যার সুরাহা চায় ইসরাইল, তা ইলেকট্রনিক্স, সাইবার বা আধুনিক প্রযুক্তির যে কোনো বিকল্প হতে পারে। আমরা নিরাপত্তা সমাধান চাই, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নয়।’ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক অ্যালান জনস্টন বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে এই প্রথম নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিল ইসরাইল। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ, নিন্দা ও বিরোধিতার মুখে ইজরাইল আল-আকসা মসজিদে দেয়া অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
২০১৪ সালে অনেকটাই নাকানি-চুবানী খেয়েছে হামাসের কাছে। তখন ইসরাইল সৈন্যদের আত্মহত্যা, যুদ্ধে মনোবল হারানো এবং হামাসের রণকৌশলের কাছে হয়েছে ধারাশায়ী। এই অসম যুদ্ধে শিশু এবং বেসামরিক লোক হত্যা করে বিশ্ব দরবারে ইসরাইল অপমানজনক পরাজয় ছাড়া হয়ত আর কিছুই অর্জন করতে পারবে না।” ইসরাইল এর আগে এমনই ভয় পেয়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার আশ-পাশের এলাকায় বসবাসকারী দখলদার ইহুদিদের ৭৫ শতাংশই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সেই শহরের জেলা কাউন্সিলের প্রধান হাইম ইইলীন। (খবর প্রেস টিভি)। বিপরীত দিকে যুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের অনড় মনোবল, শাহাদাতের তামান্না, যুদ্ধের রণকৌশল গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে।
ফিলিস্তিনীদের মূলমন্ত্র হলো ‘শাহাদাতের ইচ্ছাতেই জীবন পেত পার। মহান লিবীয় মুজাহিদ ওমর আল-মুখতার বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বাধীনতার অধিকার, আমার দেশের অধিকার এবং যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে আমার এই বিশ্বাসকেই বেশি শক্তিশালী মনে করি।’ আমরা আজ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরাই জয়ী হবো।”
ফিলিস্তিনীদের এ অসমযুদ্ধে মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে আরব বিশ্বের শাসকদের। স্পষ্ট হয়েছে আমেরিকা-ইউরোপ হচ্ছে ইসরাইল নামক এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক। শত বাধা-জুলুম-নির্যাতনের পর ও বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনীরা। সাবাস! ফিলিস্তিন। সাবাস হামাস! বিজয়ী বীর যোদ্ধাদের অভিনন্দন। বিগত দিনে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল-অবশেষে গাজা থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলী মিডিয়া জানিয়েছে, চার সপ্তাহের এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল হামাস যোদ্ধাদের নির্মূল করা ও ইসরাইলে প্রবেশের সকল সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করা। তবে তেলআবিবের এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল পাওয়া যায়নি। তারা নৃশংসভাবে নিরীহ ফিলিস্তিনীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। অথচ হামাসের তেমন কোন ক্ষতিই তারা করতে পারেনি। মাত্র কয়েকটি সুড়ঙ্গ তারা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। গাজার অফিসিয়াল সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ইসরাইলী বর্বরতায় নিহতের সংখ্যা ১৮শ’ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি। হামাসের প্রতিরোধে ৬৭ জন সেনা নিহতের কথা স্বীকার করেছে ইসরাইল। যদিও হামাস ১০০’র অধিক ইসরাইলী সৈন্য হত্যার দাবি করেছে। ইসরাইল নিরীহ নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করে বিশ্বব্যাপী শুধু নিন্দাই কুড়িয়েছে। মিসর, লেবানন, হিজবুল্লাহ ও হামাসের সঙ্গে কোন পূর্ববর্তী যুদ্ধে ইসরাইলের এত সেনা নিহত হয়নি । তাই প্রকৃতপক্ষে এটা ইসরাইলেরই পরাজয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। (সূত্র: বিবিসি)
১৯৪৮ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনীদের দু’বারেরই লড়াই ছিল আত্মরক্ষামূলক, একবার সফল হয়েছিল, অন্যবার সফল হয়নি। এ লড়াইয়ে ফিলিস্তিন জাতি উপহার দিয়েছে -২,৬১,০০০ জন শহীদ, ১,৮৬,০০০ জন আহত, ১,৬১,০০০ জন পঙ্গু। এছাড়া প্রায় দু’মিলিয়ন ফিলিস্তিনী স্বদেশ ছেড়ে বাইরে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের পরিবারবর্গসহ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সে দু’মিলিয়ন দেশছাড়া লোক এখন ৫ মিলিয়নে পৌঁছে গেছে। সঠিক সংখ্যা হচ্ছে ৫ মিলিয়ন ৪ লক্ষ। এবারের লড়াইয়ে ত্যাগ-কুরবানির পাহাড় অনেক দীর্ঘ হলেও আল্লাহ মুমিনদের সাহায্য কিভাবে করেন তার নজীর বিশ্ববাসী আবার ফিলিস্তিনের গাজায় দেখেছে।
ফিলিস্তিন এখন মুসলিম শিশু, নারী-পুরুষের রক্তে রঞ্জিত এক জনপথ। আজ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ঘরে ঘরে সন্তান হারানোর বেদনা আর আহাজারী। কাঁদতে কাঁদতে এখন যেন চোখে পানিও নেই। শোকের পাহাড় বয়ে চলছে প্রতিটি পরিবার। রক্তপিপাসু ইসরাইলের মূল লক্ষ্য এবার মুসলমানদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়া। নিহতের বেশীর ভাগই শিশু। ফেরাউন মুসা (আ:) আগমন ঠেকাতে সব ছেলে সন্তানকে হত্যা করলেও আল্লাহ তায়ালা তার ঘরেই মুসা (আ:)-কে লালন পালন করানোর ব্যবস্থা করলেন। সুতরাং ইসরাইলের এই নীতিও বুমেরাং হবে। পৃথিবীর কোন যুদ্ধ আইনে নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা সমর্থন করে না। ইসরাইলের সন্ত্রাসীরা আজ সেই জঘন্য কাজটি করছে। রাস্তার পাশে সারি সারি লাশের সারি! সর্বত্র মানুষের খন্ড বিখন্ড শরীরের টুকরা। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সব জায়গায়! কোথায় তাদের বাড়িঘর! কোথায় তাদের ঠিকানা! স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, হাসপাতাল সব জায়গায় চলছে অব্যাহত হামলা। হাসপাতালগুলোতে এখন আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পৃথিবীতে হাসপাতালগুলোতে আক্রমণ যুদ্ধরীতি বিরুদ্ধ হলে কোন আইন, নীতি, মানবিকতা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না ইসরাইল। চলছে ইসরাইলের নরপিচাশদের আক্রমণ।
ইসরাইলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোরদেচাই কেদর ইসরাইল সৈন্যদের গাজায় ধর্ষণ-অস্ত্র প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে সারা বিশ্বে তাদের নোংরা চরিত্রের উম্মেষ ঘটালেন। ইহুদিরা এ যেন রক্তের হলি খেলায় লিপ্ত! এ হচ্ছে মানবিকতার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় আঘাত। এ কোন অসম যুদ্ধ!! এতো কোন যুদ্ধ নয় এ হচ্ছে গণহত্যা। এ যেন মাছুম শিশুদের জীবন নিয়ে প্রচন্ড তামাশা! এত অমানবিক নির্যাতন গাজায় চলছে তা মুসলিম বিশ্ব দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। প্রতিটি নারকীয় তান্ডবের পর দু’একটি বিবৃতি আর বিক্ষোভ ছাড়া আর কার্যকর কোন তৎপরতা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জোরালো কোন প্রতিবাদ এখনও করেনি। সবাই যেন রুটিন মাফিক প্রতিবাদই করছে। আরব বিশ্ব অনেকটাই নীরব। দু’একটি দেশ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিবৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। হামলা বন্ধে যারা কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা সেই মিসরে এখন আমেরিকা-ইসরাইল পুতুল সিসি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা- ইসরাইল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এটা এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার। বিশ্বের মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা গাজায় এই অমানবিক নিষ্ঠুরতাকে যেন উপভোগ করছে। এত কিছুর পরও মুসলমানদের দৃঢ়তা ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছিল অভাবনীয়। ফিলিস্তিনের সাবেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, গাজা হবে ইসরাইলীদের কবরস্থান। গাজায় আগ্রাসন ও গণহত্যার মাধ্যমে ইসরাইলের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। তবে শত বাধা ও ইসরাইলের বারবার আগ্রাসন সত্ত্বেও ফিলিস্তিনীদের তাদের সংগ্রামের পথ থেকে সরানো যায়নি।
ইসরাইলী বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গাজার নিরপরাধ মানুষের আর্তচিৎকারে পৃথিবী যখন কাঁদছে। সেই আর্তচিৎকার শুধু পৌঁছেনি বিশ্বের মোড়লদের কানে। ইসরাইলী বর্বরতা ও নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে নিরপরাধ এবং নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বনেতাদের কেউই এগিয়ে আসছে না এখনো।
আরব রাষ্ট্রগুলো প্রতিবাদের পরিবর্তে যেন হামলার যোগানদাতা। গাজা ইস্যুতে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়েছে তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র নায়কদের। যারা নিজেদের গদী রক্ষায় ইহুদিদের জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করেনি। আলল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- ”তোমরা কি একথা মনে করে রেখেছো যে তোমাদের এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা (তার পথে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো এবং আল্লাহ , রাসূল ও মুমিনদের ছাড়া কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না? তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন” আজ ফিলিস্তিন মুসলমান হত্যায় বিশ্ব যতই নীরব থাকুক। হয়ত সেই দিন বেশী দূরে নয়, যেদিন ইসরাইল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, গোটা পৃথিবীর জন্য। তাই এখনই মুসলিম উম্মাহকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে মুসলমানদের পবিত্রভূমি পুদ্ধরুদ্ধার সংগ্রামে। আল্লাহ তায়ালা মজলুমের সহায় হোন।

 

http://www.dailysangram.com/post/295671-