১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৫

অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানীর সেবাখাতের ৯৮ ভাগ প্রতিষ্ঠান

অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধির নোটিশ পাঠানোর পরে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাসে ঢাকায় অন্তত ২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বড় অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সর্বশেষ গত ৩ জুলাই উত্তরার একটি আবাসিক হোটেলসহ পাশাপাশি তিনটি ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট টানা ৫ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় দুজন দগ্ধ হয়ে মারা যান। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ঐ হোটেলটিকে মার্চেই অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। পরে তাদের দুই দফা নোটিশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।

এর আগের দিন গত ২ জুলাই লালবাগ এলাকার একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় দোকানের মালিক মামুনুর রশিদ, তার বন্ধু মাসুম, ক্রেতা আবুল কাশেম, কর্মচারী জাকির ও শামীম দগ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢামেক বার্ন ইউনিটে মারা যান মাসুম, শামীম ও জাকির।
এ ঘটনার চারদিনের মাথায় ৬ জুলাই বাড্ডার পোস্ট অফিস গলিতে একটি বাড়িতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই বাড়ি থেকে দগ্ধ অবস্থায় সুলতান, সোহরাব ও আনন্দ বর্মণ নামের তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এর আগে ১ জুলাই পুরান ঢাকার একটি পলিথিন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কারখানার দুই শ্রমিক গুরুতর দগ্ধ হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সেবা প্রদানকারী প্রায় ৯৮ভাগ প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। বড় ধরনের অগ্নিকান্ড মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা এসব প্রতিষ্ঠানের নেই।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে ঢাকার বিপণিবিতান, আবাসিক হোটেল, হাসপাতাল, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা যাচাই করতে মাঠে নামে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৮৮ থেকে ৯৮ ভাগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে কিছু স্থাপনা ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত হয়। অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে দুই দফা নোটিশও দেয়া হয়। কিন্তু টনক নড়ছে না ঝুকিতে থাকা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অগ্নি আইনে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
সূত্র জানায়, গত ৪ জানুয়ারি গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকান্ডের পর ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে ফায়ার সার্ভিস মহানগরীর সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়। মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্থতা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি খতিয়ে দেখে সংশি¬ষ্ট স্থাপনাগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মধ্যে ছোট বড় মিলে ১ হাজার ১২৬টি বিপণিবিতানের মধ্যে মাত্র ৪৬টির অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা রয়েছে বাকী ১০৮০ বিপণীবিতান অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। এতে ৯৬ ভাগ বিপণিবিতানেরই অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা নেই বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।
সূত্র জানায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার প্রায় সব হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল, বিপণিবিতান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এ সময় নগরের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ২৪৮টি হাসপাতালকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৭৪টিকে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস।
একইভাবে ঢাকার মোট ৯৯৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ৮৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ৯৪টিকে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে। শতকরা হিসাবে প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই।
সূত্র জানায়, ঢাকার ৩২৬টি আবাসিক হোটেল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ২৪৭টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ৭০টি। শতাংশের হিসাবে ঢাকার ৯৭ ভাগ হোটেলই ঝুঁকিপূর্ণ।
সবশেষে ফায়ার সার্ভিস ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৬৯২টি শাখা পরিদর্শন করে ৬৪৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। আর খুবই ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে ১৭৩টি ব্যাংক শাখা।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রথম দফা নোটিশ পাঠানো হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে। এরপর এপ্রিল-মে মাসে পুনরায় ওইসব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে গিয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিন্দুমাত্র নমুনাও দেখা যায়নি। পরে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে দ্বিতীয় দফা নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু তার পরও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানই সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে রিপোর্ট করেনি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ একটি গণমাধ্যমকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা নেই, তাদের সমস্যাগুলো নিরূপণ করে সমাধানের জন্য নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই দুই দফা নোটিশ প্রদানের পরও সক্ষমতা বৃদ্ধি করেনি। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অগ্নি আইন অনুযায়ী মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/295435-