১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৬

ভোটার তালিকা হালনাগাদে গোঁজামিল

হ-য-ব-র-ল অবস্থায় গতকাল শেষ হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ। নির্ভুল ভোটার তালিকা নিশ্চিত করতে নজরদারি ছিল না ইসি’র। নতুন ভোটার সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। পর্যাপ্ত লোকবল, অর্থ ও ফরম সঙ্কটের কারণে হালনাগাদ কার্যক্রমে ধাক্কা লেগেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মূল কারণ হিসেবে সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, হালনাগাদ কার্যক্রমে বিদ্যমান দুই হাজার ভোটারের জন্য একজন করে তথ্যসংগ্রহকারী নিয়োগ এবং প্রতি ৫ জন তথ্য সংগ্রহকারীর জন্য একজন করে সুপার ভাইজার নিয়োগ করা হয়। ঢাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক বা কর্মচারী এবং সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক বা কর্মচারীকে তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত কিন্ডার গার্টেন ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছর শিক্ষকদের হালনাগাদের তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রমে নিয়োগ করায় সঠিকভাবে কাজটি হচ্ছে না। একদিকে ফরম সঙ্কটের অজুহাত, অন্যদিকে পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক না পাওয়া। সবমিলিয়ে মাঠে কাজ করতে অনীহা তথ্যসংগ্রহকারীদের। বয়সের কারণে অনেকে এলাকায় যাচ্ছেন না। রাজধানীতে যেসব বহুতল বাসায় লিফট নেই সেসব বাসায় তথ্য সংগ্রহকারীরা কম যাচ্ছেন। যেসব তথ্য সংগ্রহকারীর বয়স বেশি তারা সিঁড়ি বেয়ে বহুতল ভবনে উঠতে চান না। সারাদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেয়ার পর অনেক শিক্ষক বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহে আগ্রহ পাচ্ছেন না। আবার অনেক বাসায় নিরাপত্তার কারণে ঢুকতে পারছেন না তথ্য সংহগ্রকারীরা। ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে, কমিউনিটি সেন্টারে বা মহল্লার স্কুলে বসে তথ্য নিচ্ছেন তারা। এমনকি ইসিতে কর্মরত অনেকের বাড়িতেই যাননি তথ্য সংগ্রহকারীরা। যার প্রভাব পড়েছে পুরো হালনাগাদ কার্যক্রমে। ফলে বিপুল পরিমাণ ভোটার নিবন্ধনের বাইরে থেকে গেছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা সরজমিন ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কাজটি প্রতিবছর দায়সারাভাবেই হয়ে আসছে। এবছর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের পক্ষে একজন উপ-সচিব বিষয়টি তদারকি করেছেন। তবে প্রতিবারের ন্যায় এবার নিবিড়ভাবে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। থানা নির্বাচন অফিসাররা স্মার্ট কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন ও বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের পক্ষে এত কম জনবল নিয়ে হালনাগাদের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ চালানো অসম্ভব। যে কারণে যাচ্ছেতাই ভাবে হালনাগাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই একই চিত্র বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। নির্বাচন সহায়তা শাখার একজন সহকারী সচিব অভিযোগ করেন, হালনাগাদ কার্যক্রমের জন্য ৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ৪১ কোটি টাকা। পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিটি ফরম পূরণের জন্য তথ্য সংগ্রহকারীকে ২৫ টাকা করে দিতে হয়। একজন শিক্ষকের পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকার পরিমাণ খুবই সামান্য ও অসম্মানজনক। ধানমন্ডির একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি মানবজমিন-এর কাছে অভিযোগ করেছেন, প্রতি ফরম বাবদ তথ্য সংগ্রহকারীরা ১০ থেকে ১৫ টাকা পাচ্ছেন। কখনও কখনও কোনো টাকাই পাচ্ছেন না। তথ্য দিয়ে যারা ছবি তুলতে আসছে না তাদের ফরমের টাকা দেয়া হয় না। তাই অনেকটা দায়সারাভাবে কাজ করছেন তারা। আবার অনেকের স্কুলে ক্লাসের চাপ থাকায় ইচ্ছা থাকলেও সঠিকভাবে সময় দিতে পারেনি নি।
নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানায়, প্রতিবছর ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজটি দৈনিক ভিত্তিতে মনিটরিং করা হতো। কোথায় নারী ভোটার ও পুরুষ ভোটার কি পরিমাণে তথ্য দিচ্ছেন এবং মৃত ভোটার কর্তনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হতো। তথ্য সংগ্রহকারীদের চাহিদার ভিত্তিতে ভোটার নিবন্ধন ফরম-২ থানা নির্বাচন অফিসকে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এ বছর ফরম সঙ্কটের কারণে তথ্য সংগ্রহকারীরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন নি। পুরো বিষয়টি ইসি’র সমন্বয় করার কথা থাকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গা-ছাড়া ভাব দেখিয়েছেন। তাদের মতে, সারা বছরই ভোটার হওয়ার সুযোগ আছে। তাই হালনাগাদে তারা কম গুরত্ব দিচ্ছেন। মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি এলাকার দায়িত্বে থাকা একজন তথ্য সংগ্রহকারী গতকাল জানান, ফরম না থাকায় তিনি তথ্য সংগ্রহে যেতে পারেননি। থানা নির্বাচন অফিসারকে বিষয়টি জানিয়েছেন। তাকে বলা হয়েছে তথ্য ডায়েরিতে লিখে রাখতে। ধানমন্ডি এলাকার একজন তথ্য সংগ্রহকারী জানান, মঙ্গলবার তার ৮০টি ফরমের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু থানা নির্বাচন অফিস থেকে তাকে চাহিদার অর্ধেক সরবরাহ করা হয়েছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ না করায় জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থেকে যাবে। পরবর্তীতে ভুল সংশোধনে ভোগান্তিতে পড়ছেন নাগরিকরা। মৃত ভোটার কর্তনের বিষয়টিও এবার গুরুত্ব সহকারে করা হয়নি। ফলে আগামী নির্বাচনের আগে হালনাগাদ না হলে জাল ভোটের বিশাল ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। হালনাগাদ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ভোটার তালিকা থেকে মৃত ভোটার কর্তনের জন্য একসময় কবরস্থানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টি কম গুরুত্ব পাচ্ছে। হালনাগাদ কার্যক্রমের প্রচার নিয়েও রয়েছে ঘাটতি। একদিকে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও তথ্য সংগ্রহকারীরা তথ্য নিতে আসছেন না। অন্যদিকে কোথায় গিয়ে তথ্য দিতে হবে সে বিষয়টি অজানা নতুন ভোটার হতে ইচ্ছুক সাধারণ মানুষের। নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর প্রচারণায় পর্যাপ্ত বাজেট থাকে। এ বছর শুধু মোবাইলে এসএমএস দেয়ার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছিল। এলাকায় মাইকিং বা পোস্টারিং এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা থাকলেও তা যথাযথভাবে করা হয়নি। ফলে ভোটার হতে ইচ্ছুক সাধারণের কাছে বিষয়টি অজানাই থেকে গেছে। খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা আবদুল খালেক মানবজমিন কার্যালয়ে ফোন করে বলেন, গত দুই বছর আগে ভোটার হওয়ার জন্য তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ওইবার তিনি ছবি তুলতে পারেননি। এ বছর কোথায় ভোটার হতে পারবেন তা জানতে চান। একইভাবে নতুন ভোটার হতে আগ্রহীরা বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন অফিসে ফোন করছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হালনাগাদ কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা উপ-সচিব আবুল কাসেম জানান, হালনাগাদের বিষয়ে সচিব কথা বলবেন। নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাতের চেষ্টা ও তার মোবাইলে ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি।
এবার ১ জানুয়ারি ২০০০ বা তার পূর্বে যাদের জন্ম অথচ ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিগত কার্যক্রমে বাদ পড়েছেন তাদের নিবন্ধনের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ২৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ তথ্য সংগ্রহের সময় শেষ হয়েছে গতকাল বুধবার। আগামী ২০শে আগস্ট থেকে ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত তিন ধাপে নতুন ভোটার হতে ইচ্ছুকদের ছবি তোলা, হাতের ছাপ নেয়াসহ নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। হালনাগাদকৃত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি। এবারের তালিকায় ৩৫ লাখ ভোটার অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগে ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই হালনাগাদকৃত তালিকাই হতে পারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=78100&cat=2/