চট্টগ্রাম নগরের অনেক সড়কেরই এমন বেহাল। ছবিটি অলংকার মোড়ের পোর্ট কানেকটিং সড়ক থেকে তোলা। ছবি : রবি শংকর
১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯

গর্তই ভরতে পারেনি সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম নগরে বিধ্বস্ত ৩৫০ কিমি সড়ক

 

চট্টগ্রাম নগরের প্রবেশমুখ অক্সিজেন থেকে মুরাদপুর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কের পুরোটাই ভাঙাচোরা ও ছোট-বড় গর্তে ভরা। বাস-মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পো প্রভৃতি গণপরিবহনে এ পথ যেতে আগে লাগত ১০ মিনিট, এখন লাগছে এক ঘণ্টা। সেটাও দিনের হিসাব, সন্ধ্যার পর লাগছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
এ ছাড়া অক্সিজেন থেকে নগরের ষোলশহর ২ নম্বর গেটের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এ সড়কের পথে পথে গর্ত আর চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইন স্থাপনের কাজের কারণে কয়েকটি স্থানে যানবাহন চলাচল একমুখী। এ পথে যাত্রীদের লাগছে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময়। এর মধ্যে ২ নম্বর গেট থেকে বেবী সুপার মার্কেটের আধা কিলোমিটার সড়ক যেতেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে নগরের মধ্যভাগ লালখানবাজার প্রধান সড়কও বেহাল। প্রায় ১০ কিলোমিটারের এই সড়কে রাত-দিন তীব্র যানজট লেগেই থাকছে। কেননা সড়কজুড়ে বিশাল আকৃতির গর্ত, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির দুর্ভোগ। তাই ওই পথ যেতে সময় লাগছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবেই বলা হয়েছে, এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে নগরের এক হাজার ১৭৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের তথ্য এবং সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। নগরের কমবেশি সব সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে অস্থায়ী মেরামতের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, বেশির ভাগ সড়ক এখন পর্যন্ত অস্থায়ী মেরামতই করা হয়নি। অর্থাৎ গর্তই ভরতে পারেনি সিটি করপোরেশন। স্থায়ী মেরামত তো অনেক দূরের কথা। এ কারণেই এ দুর্ভোগ, যানজট। গতকাল কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে সরেজমিনে গিয়েও এ চিত্র দেখা গেছে।
চানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের বর্ষায় এক হাজার ১৭৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতের জন্য মাননীয় মেয়র মহোদয় ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে দুই হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ চেয়েছেন। তবে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু করপোরেশন বসে নেই। ১০-১২ দিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর অস্থায়ী মেরামতের কাজ শুরু হয়ে এখন শেষ পর্যায়ে। ’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের পর ক্ষতিগ্রস্তসহ অন্য সড়কগুলো স্থায়ীভাবে মেরামতের কাজ শুরু হবে। বর্ষায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কিছুটা দুর্ভোগ হচ্ছে জনগণের। কিন্তু সে দুর্ভোগ লাঘবের জন্য আমরা (করপোরেশন) বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি। ’
করপোরেশন যে অস্থায়ী মেরামতের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকার দাবি করছে তার সমালোচনা করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘করপোরেশনের যাঁরা বলেছেন তাঁরা রুমের মধ্যে অস্থায়ী মেরামতের কাজ শেষ পর্যায়ের কথাটি বলেছেন। আমাদের মালিক গ্রুপের আওতাধীন নগরের দেড় হাজারের বেশি বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। প্রতিদিনই আমরা খবরাখবর নিচ্ছি। নিজেরাও সড়কগুলো দিয়ে চলাচল করি। নগরের প্রায় সড়কই ভাঙাচোরা। মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশের মতো অস্থায়ী মেরামত হয়েছে। আর যেগুলো মেরামত হয়েছে সেগুলো বৃষ্টি হলেই কোনো চিহ্ন থাকে না মেরামতের। ’
তিনি বলেন, ‘ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে প্রতিনিয়ত গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি বিকল হয়ে গেছে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার সময় বেশি ক্ষতি হয়েছে। এখন গণপরিবহনের মূল সমস্যা বড় বড় গর্তের কারণে গাড়ি কম গতিতে চলছে। এ কারণে যানজট বেড়েছে। সঠিক সময়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে পারছে না। ’ এসব বিষয় নিয়ে আগামী সোম অথবা মঙ্গলবার সংগঠনের পক্ষ থেকে মেয়রের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে জানান বেলায়েত হোসেন।
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো এখন যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে ভাঙাচোরা ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে; সেই সঙ্গে নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে গাড়ি চলাচল করতে বেগ পেতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে সড়কগুলো মেরামতের কাজ করার; এখনো তা পুরোপুরি দৃশ্যমান হচ্ছে না। মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। যানবাহনেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নগর পরিকল্পনাবিদ জানান, বর্ষায় বৃষ্টি হবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যায় নগরের অনেক সড়ক এখন খানাখন্দে ভরে গেছে। এ সড়কগুলোর খোঁজ নিলে জানা যাবে বছরে দু-তিনবার মেরামত করা হয়। এসব কাজের গুণগতমান ঠিক না থাকায় কাজের নয়ছয়ের কারণে সড়কগুলো কিছুদিন যেতে না যেতেই বেহাল হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত গুণগতমান ঠিক রাখা না যাবে এবং কাজের পর্যবেক্ষণ না থাকবে ততক্ষণ সড়কগুলো মেরামত করা হলেও তা বেশি দিন টিকবে না। মেরামতের নামে বিভিন্ন ঠিকাদার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের বহদ্দারহাট থেকে বাস টার্মিনালমুখী প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে একমুখী যানবাহন চলছে। অন্য পাশে চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইন স্থাপনের কাজের কারণে সড়ক বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের মুখে, পুরাতন চান্দগাঁও থানা, কাপ্তাই রাস্তার মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টেও ওয়াসার কাজ চলছে। একইভাবে কাপ্তাই রাস্তা থেকে মদুনাঘাটমুখীও বেশির ভাগ অংশে ওয়াসার কাজের কারণে সড়কে একমুখী যানবাহন চলছে। এর বাইরে অক্সিজেন মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক পর্যন্ত, মুরাদপুর থেকে কয়েকটি পয়েন্টে একমুখী যান চলছে। সেখানেও মোড়ে মোড়ে ওয়াসার পাইপলাইনের কাজ চলছে।
অক্সিজেন মোড় থেকে ২ নম্বর গেট আসার পথে বেবি সুপারমার্কেটের সামনে যানজটের কারণে অনেক যাত্রী যানবাহন থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছে। ওই সময় চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী মো. হারুন পথচারীদের একজনকে উদ্দেশ করে বলছিলেন, ‘ফ্লাইওভারের লুপ-র্যাম নির্মাণের কাজে যে আর কত দিন লাগবে জানি না?’ উত্তরে অন্যজন বলেন, ‘যারা এগুলো করছে (সিডিএ) তারা তো এই পথে চলাচল করে না। চলাচল করলে বুঝত মানুষের কষ্ট। ’
সিএনজি অটোরিকশার চালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘এখানে তো সব সময়ই যানজট থাকে। রাস্তা ভাঙার কারণে আস্তে গাড়ি চালাতে হয়। যাত্রীরা অনেক সময় বলে ওঠে, তাড়াতাড়ি কেন গাড়ি চালাচ্ছি না। আমি কি গাড়ি আকাশের ওপর চালাব। যাত্রীরা বুঝতে চায় না। ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালাতে কী রকম কষ্ট হয়। ’
বহদ্দারহাট এলাকায় আহমেদ মুনির নামের এক শিক্ষক বলেন, ‘যেভাবে সড়ক ভেঙেছে তাতে যাতায়াত করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই মেরামত করে; কিছুদিন না যেতেই আবার ভেঙে যায়। ’
পলিটেকনিক মোড়ে যানজটের কারণে রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রুবি গেটের দিকে যাচ্ছিলেন রাউজান থেকে আসা ফেরদৌস আহমেদ নামের এক টেইলারিং কর্মী। তিনি বলেন, ‘এটা দুর্ভোগ নয়, মহাদুর্ভোগ বললে কম বলা হবে। আমাদের গ্রামের রাস্তাও এর চেয়ে অনেক ভালো। ’
সরজমিনে আরো দেখা গেছে, বারিকবিল্ডিং থেকে মাঝিরঘাট, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে বিমানবন্দর সড়ক, দেওয়ানহাট থেকে নয়াবাজার, আগ্রাবাদ বাণিজিক এলাকা থেকে এক্সেস রোড হয়ে বড়পোল, বিশ্বরোডের মোড় থেকে অলংকার পর্যন্ত সড়কও বেহাল। এর মধ্যে কয়েকটি সড়কে অসংখ্য গর্ত ও বড় বড় ডোবার মতো হয়েছে। এতে পথে পথে পানি জমে আছে। প্রধান সড়কের পাশাপাশি অলিগলি দিয়ে হাঁটাও দায়।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/10/529903