১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৬

একি হাল ৪০৬ কোটি টাকার কারাগারের

দেয়ালে গুঁতো লাগলেই ঝরে পড়ে বালু-সিমেন্ট। বৃষ্টিতে ভেতরের অংশ ভিজে স্যাঁতসেঁতে। কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের লোহার গেটও ভাঙা। দেখা দিয়েছে ফাটল। কারারক্ষীদের ব্যারাকের জানালা ঠিকমতো লাগে না। সামান্য ঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়ে, তাতে আবার রয়েছে মরিচা। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের তেঘরিয়ায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণ কাজে এমন অর্ধশতাধিক ত্রুটি রয়েছে। অথচ মাত্র এক বছর আগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগার এখানে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু দেখে মনে হয়_ দুই শতকের বেশি পুরনো নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারের চেয়েও এর অবস্থা করুণ। তাই অনেকের প্রশ্ন_ ৪০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কারাগারের একি হাল!

সংশ্লিষ্টদের জোরালো বিশ্বাস, মানহীন নির্মাণ কাজের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা এও মনে করেন, কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে জড়িত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা। উচ্চমূল্যের কাজ নিয়েও অতি নিম্নমানের কাজ করায় এমন হাল। পূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা কমিশন নিয়ে ঠিকাদারদের সুযোগ করে দিয়েছেন। এতে কারাগারের নিরাপত্তা নিয়েই এখন হুমকি দেখা দিয়েছে। জানা যায়, কারাগারটি উদ্বোধনের আগেই অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা

পড়ে। সীমানা প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা

.দেয়। সেগুলো আড়াল করতে পরে সিমেন্ট-বালুর আস্তরণ দিয়ে রঙ করে ঢেকে দেওয়া হয়। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান কাজের অগ্রগতি দেখতে গিয়ে নিম্নমানের ইট ব্যবহার দেখতে পান। তিনি একটি ইট তুলে মাটিতে ফেলে পরীক্ষা করেন। দেখেন, ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তখনই পূর্ত বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন এবং মানসম্মত ইট ব্যবহারের নির্দেশ দেন। পরে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ওই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী উৎপল কুমারকে প্রত্যাহার করা হয়।

এদিকে গতকাল সরেজমিন শ্রমিকদের কাজ করতে দেখা যায়। দেয়ালের যেসব স্থানের পলেস্তারা বেশি খসে পড়েছে সেখানে তারা নতুন করে পালিশ করছেন। কাজের সময় এক শ্রমিক মন্তব্য করেন_ জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ত্রুটি দেখতে সকাল ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শিরিন রুমি, প্রকল্প পরিচালক সামসুল আলম, সাবেক প্রকল্প পরিচালক আবদুল হক, নির্বাহী প্রকৌশলী উজির আলী, সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী উৎপল কুমার দেসহ ২০-২৫ জনের প্রতিনিধি দল কারাগার পরিদর্শন করেন।

সামসুল আলম সমকালকে বলেন, অল্প সময়ে চার পাশের দেয়ালের পলেস্তারা ঝরে পড়ায় হতবাক হয়েছি। নির্মাণে ত্রুটির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কারাগারের কয়েক কর্মকর্তা জানান, উদ্বোধনের পরই ফাটলসহ বিভিন্ন ত্রুটি চোখে পড়তে শুরু করে। অনেক কক্ষের দরজা ঠিকমতো লাগে না। পরে কারা অধিদপ্তর দুই দফা পরিদর্শন করে প্রথমে ৭২ ধরনের ত্রুটি খুঁজে পান। পূর্ত বিভাগ কিছু মেরামত করে দেয়। এর পর কারা অধিদপ্তর আবারও পরিদর্শনে গিয়ে আরও ৩৬ ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত করে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ১৯ জুলাই কমিটির সদস্যরা কারাগার পরিদর্শন করেন। কিন্তু ওই কমিটি এখনও তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি।

তদন্ত কমিটির প্রধান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আফজাল হোসেন জানান, কাজ শুরুর পর কিছু ত্রুটি পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন দিতে একটু সময় লাগবে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ১৯৪ একর জমির ওপর কারাগার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪০৬ কোটি টাকা। গত বছরের ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। একই বছরের ২৯ জুলাই নাজিমুদ্দিন রোড থেকে বন্দিদের নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সেখানে প্রায় সাত হাজার বন্দি রয়েছে।

কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ত্রুটি ধরা পড়ার পর অনেক কিছুই মেরামত করা হয়েছে। মাসদুয়েক আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি আবাসিক ভবনের লোহার গেট পূর্ত বিভাগ মেরামত করেছে।

কারা কর্মকর্তারা আরও জানান, নির্মাণ কাজে নিম্নমানের ইট-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। বালির মানও ছিল খুব খারাপ। বালি ও সিমেন্টের অনুপাতও ঠিক ছিল না। এ কারণে একটু গুঁতো লাগলেই দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ে। কিছু দরজা বাঁকা হয়ে গেছে। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি এতটাই খাড়া ও অপ্রশস্ত যে, ওপরে ওঠা যায় না। আবার বন্দিদের সাক্ষাৎকার কক্ষ খুবই ছোট। একসঙ্গে কয়েকজন কথা বললে ঠিকমতো কথা শোনা যায় না। কারা চত্বরে বসানো বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোর কয়েকটি চলতি বছরের প্রথমদিকে ঝড়ে ভেঙে পড়ে। পাল্টে বসানো খুঁটিগুলোও দুর্বল। কয়েকটি খুঁটি ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে উন্নতমানের খুঁটি বসাতে বললেও তা করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, কারাগারের ৩০টি ভবন নির্মাণ করেছে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বেশি কাজ করে খান অ্যান্ড সামস। নিম্নমানের কাজ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বলেন, কারাগার চালুর অনেক আগেই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। তা অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। ফলে এ রকম মনে হতে পারে। অপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিপা এন্টারপ্রাইজের এক কর্মকর্তা বলেন, কাজের মান ঠিক আছে। কিন্তু ইটে লবণাক্ততা ছিল। এ জন্য প্লাস্টার খুলে পড়তে পারে।

জানা যায়, বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের নিম্নমানের কাজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অভিযোগে বলা হয়, কারারক্ষী ব্যারাকের বিভিন্ন কক্ষে বৈদ্যুতিক কাজ অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণভাবে করা হয়েছে। অনেক কক্ষে বৈদ্যুতিক বাতি পর্যন্ত নেই। কিছু টিউবলাইট জ্বলে না। কয়েকটি টয়লেটের কমোড ভাঙা, কয়েকটির ফ্লাশ কাজ করে না। কয়েকটিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই ও জানালার কাচ ভাঙা। কারারক্ষী ব্যারাকের রান্নাঘরে পানির ট্যাঙ্ক রাখা হয়নি। খাবার ধোয়ার কক্ষও নেই। চুলার ধোঁয়া বের হওয়ার ব্যবস্থা খুব খারাপ। অধিকাংশ চৌকির পাটাতন ঘুণে খাওয়া। প্রতিটি তলা সমতল রাখার কাজও ঠিকভাবে করা হয়নি। কোনো দরজায় হাতল নেই। জানালা আটকানোর ছিটকিনি নেই। চুনকামের কাজও নিম্নমানের। বিভিন্ন তলায় করিডরের পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা নেই। ড্রেনের পানি বের হওয়ারও ব্যবস্থা নেই। মসজিদে প্রবেশের দরজার কাঠগুলো ও পাটাতন নিম্নমানের। ওজুখানার জন্য ড্রেন রাখা হলেও পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা নেই। কয়েকটি বৈদ্যুতিক কন্ট্রোল বক্সের খাঁচা লাগানো হয়নি।

এসব বিষয়ে পূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা কথা বলতে রাজি হননি। প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের দপ্তরে গেলে স্টাফ অফিসারের মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে তার সাক্ষাৎ চাওয়া হয়। পরে স্টাফ অফিসার জানান, বিষয়টা দেখছেন মো. সোহরাওয়ার্দী নামে এক নির্বাহী প্রকৌশলী। দু'দিন তার দপ্তরে গিয়েও দেখা মেলেনি। তবে একজন প্রকৌশলী দাবি করেন, যেসব ছোটখাটো ত্রুটি রয়েছে, কারা কর্তৃপক্ষ বললেই তা মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এটা নিয়ে এত শোরগোল কেন, বুঝতে পারছি না।

 

http://bangla.samakal.net/2017/08/10/315671