১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৪

সড়ক মেরামতে নজর নেই, বরাদ্দ কম

ঢাকার মাতুয়াইল-নিউটাউন-শ্যামপুর সড়কের দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। অর্ধেকই ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা। মাঝে-মধ্যে বড় গর্তও আছে। এটি মেরামতে এখন সাত কোটি টাকা দরকার। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় সংস্কার হয়নি। তেমনি গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ঢাকা বাইপাস সড়কটির অবস্থা এতই খারাপ যে, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা কঠিন। সংস্কারে প্রয়োজন ১০ কোটি টাকা। এ খাতের বাজেটের টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় মেরামত করা যায়নি। এ দুটি সড়কের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর।

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়; পর্যাপ্ত অর্থাভাবে সারাদেশে এ রকম অসংখ্য রাস্তা মেরামত না হওয়ায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হাজার হাজার যাত্রী দুর্বিষহ কষ্ট ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে সড়ক মেরামত বা সংস্কারে যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তার তুলনায় জাতীয় বাজেটে দেওয়া বরাদ্দ খুবই কম। অধিকাংশ রাস্তা সময়মতো মেরামত হয় না। ফলে আরও নষ্ট হয়।

সড়ক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত প্রশাসক, প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে সড়ক-মহাসড়ক ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তাগুলোর করুণ দশা শুরু হয় নকশা ও নির্মাণের পর্যায় থেকেই। নকশার ত্রুটির কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত গড়ায় না। জমির অভাবে মহাসড়কের পাশে নালা রাখা হয় না। রাস্তায় পানি জমে থাকলে বিটুমিন (আলকাতরা) উঠে যায়।


দ্বিতীয় কারণ, দরপত্র ও নির্মাণ পর্বে মারাত্মক দুর্নীতির জন্য উপযুক্ত রসদ দিয়ে মানসম্মত রাস্তা তৈরি হয় না। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা কাজ নিয়ে পেশাদার ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করলে ও লাইসেন্সহীন অদক্ষ ঠিকাদাররা কাজ করলে এবং এভাবে বাজেট ভাগাভাগি হলে নিম্নমানের কাজই হবে। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সড়ক অবকাঠামো খাতে বাজেটের ৪০ শতাংশই অপচয় হয়।


তৃতীয় কারণ, অতিরিক্ত ওজনের ট্রাক-লরি চলাচল। কর্তৃপক্ষ কিছুতেই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ডিজাইনে নির্দিষ্ট করা ভার বহন ক্ষমতার তিন-চার গুণ পর্যন্ত ওজনের পণ্যবাহী যান চলায় সড়ক দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে।

এসব কারণ বিদ্যমান থাকার পাশাপাশি এটাও সত্য, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বাজেট খুব কম দেওয়া হয়। সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাস্তা মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, বাস্তবে প্রয়োজন তার চেয়ে কমপক্ষে পাঁচ গুণ। বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের আওতায় রাস্তা মেরামত খাতে বরাদ্দ ছিল মোট ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এর পুরোটা ব্যয় হয়েছে। ওই সময় চাহিদা ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। একই অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে এ খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এলজিইডি কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল ৬ হাজার কোটি টাকা।


সওজের ঢাকা বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. আলমগীর সমকালকে জানান, গত অর্থবছরে তাদের আওতায় রাস্তা মেরামতের জন্য চাহিদা দেওয়া হয় ৩৯ কোটি টাকা। পাওয়া গেছে মাত্র ৮ কোটি টাকা। ফলে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোও সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যমান ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের চেয়ে কর্তাব্যক্তিদের বেশি উৎসাহ নতুন রাস্তা তৈরির প্রকল্পের দিকে। কেননা, নতুন রাস্তায় বাজেট বেশি, দুর্নীতির সুযোগ বেশি। এলাকার জনিপ্রতিনিধিদের বেশি ঝোঁক কাঁচা রাস্তা পাকা করার দিকে। এতেও ভাঙাচোরা পাকা রাস্তা মেরামত অবহেলিত থাকে।

বাজেট বরাদ্দ :অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের (২০১৭-১৮) বাজেটে সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে মোট বরাদ্দ ৪ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ। এর শতকরা ৮০ ভাগই সরকারি দুটি সংস্থা এলজিইডি ও সওজের অনুকূলে। এলজিইডি ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ও সওজ ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা পেয়েছে।


ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, বছরে সারাদেশের রাস্তা মেরামত বাবদ মোট যে টাকা খরচ হয়, তা একটি মাত্র প্রকল্পের ব্যয়ের কাছাকাছি। এর বাইরে ৪২২ কোটি টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ৪২৫ কোটি টাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সওজ অফিসের একটি সূত্র বলেছে, মেরামত বাবদ প্রকল্পে যে বরাদ্দ থাকে তা খুবই সামান্য।

সওজের আওতায় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মিলে সারাদেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক আছে। বিদায়ী অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ১০০ কিমি মেরামতের আওতায় এসেছে। সংশ্রিষ্ট সূত্রমতে, মেরামতযোগ্য রাস্তার দৈর্ঘ্য এর প্রায় চার গুণ। প্রতি বছর দরকার কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এবার বাজেটে দেওয়া হয় মাত্র ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। এতে চাহিদার অর্ধেক রাস্তা সংস্কারও সম্ভব নয়।

যোগাযোগ করা হলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সমকালকে বলেন, মেরামত বাবদও বরাদ্দ বাড়ছে। আগে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এখন প্রায় ছয় গুণ হয়েছে। চাহিদার শেষ নেই। সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেটা বিবেচনা করেই বরাদ্দ দেওয়া হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাস্তা মেরামতে বরাদ্দ অনেক কম। তবে সেটা বাড়াতে হলে কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে, দুর্নীতি কমাতে হবে। দাতারা প্রায়ই কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং অর্থায়নে আগ্রহী নয় তারা।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক রাস্তা টেকসই করতে হলে মেরামতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তিনি সংরক্ষণ ও মেরামত খাতে মোট প্রকল্প ব্যয়ের শতকরা ২ ভাগ অর্থ জমা রাখা এবং বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতা সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে স্থায়ীভাবে একটি তহবিল গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, 'এটা করা হলে অর্থ সংকট অনেকটা দূর হবে। সারাবছর মেরামত করা যাবে। রাস্তা টেকসই হবে।' তিনি অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবাহী যানের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, ফিটনেসের সময় চেক করতে হবে, যাতে কোনো ট্রাকের মালিক তার কাঠামো পরিবর্তন না করতে পারে। কেউ পরিবর্তন করলে তাকে ফিটনেস সনদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ ড. হক আরও বলেন, রাস্তা তৈরির আগে দেখভাল করার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা যায়। এলজিইডি ও সওজ পরীক্ষামূলক এটি চালুর চিন্তাভাবনা করছে বলে জানান তিনি।

 

http://bangla.samakal.net/2017/08/10/315666