৯ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১০:২৩

চালের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে পারছে না সরকার

চাল নিয়ে চাপে পড়েছে সরকার। চাপ কমাতে প্রচলিত পথের পাশাপাশি অপ্রচলিত পথেও চাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু নানা পথ পাড়ি দিয়েও মিলছে না সমাধান। বরং চালের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই আশঙ্কা থেকেই চালের আমদানি শুল্ক শূন্যে নামানোর প্রস্তাব দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৫ জুলাই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে।

মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি, সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল কেনাসহ সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষের নাগালের মধ্যে আসছে না চালের দাম। বরং মাঝে দাম কিছুটা কমলেও এখন ফের বাড়তির দিকে। আমদানি শুল্ক কমানোর আগে বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ টাকায় ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ২০ জুন ২৮ শতাংশ থেকে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে সরকার।
এরপর সরকারিভাবে চালের দাম কমেছে দাবি করা হলেও মোটা চাল এখনো বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায়। তবে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের গত রবিবারের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় মোটা চালের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও সরু চালের দাম খুচরা বাজারে ১.৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাল নিয়ে কোনো চাপ নেই। পর্যাপ্ত চাল মজুদ আছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। এখন প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আসছে। কম্বোডিয়া থেকে একটি প্রতিনিধিদল আসছে। তাদের সঙ্গেও চুক্তি হবে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে তো চাল আসছেই। ’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন ফসল আমন ওঠার আগে আর চালের দাম কমবে না। কারণ বোরো ফসল কাটার পর যত দিন যাবে চালের দাম ততই বাড়বে। একটা সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ফসল কাটার পর প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই টাকা হারে চালের দাম বাড়বে। জ্যৈষ্ঠ মাসে ফসল কাটার পর পরবর্তী আমন ফসল উঠবে অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্রহায়ণ আসতে এখনো চার মাস বাকি। এই চার মাসে প্রতি মাসেই কেজিতে দেড় থেকে দুই টাকা হারে দাম বাড়বে।
জানা যায়, চালের বাজারে সংকটের কারণে সরকারের ভেতরেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ জন্য অপ্রচলিত পথেও সরকার চাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। কম্বোডিয়া চাল রপ্তানিকারক দেশ হলেও সেখান থেকে বাংলাদেশ কখনোই চাল আমদানি করেনি। কারণ কম্বোডিয়ার চাল এশিয়ায় চাল উৎপাদনকারী অন্য দেশের তুলনায় বেশি দামি, গুণগত মানেও ভালো। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে কম্বোডিয়ার চালের দাম টনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ ডলার বেশি। কম্বোডিয়া চাল উৎপাদনে কোনো ধরনের কীটনাশক, সার বা রাসায়নিক ব্যবহার করে না। এ কারণে কম্বোডিয়ার চালের প্রধান ক্রেতা ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ। এখন চাপে পড়ে সরকার সেই কম্বোডিয়ায় গেছে চাল আনতে। দেশটি থেকে পাঁচ বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির জন্য ইতিমধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। দর নির্ধারণ করে চুক্তি সইয়ের জন্য কম্বোডিয়ার একটি প্রতিনিধিদল আগামী রবিবার বাংলাদেশে আসবে। একই সময়ে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলেরও বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
চাল নিয়ে প্রচণ্ড চাপে থাকলেও সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি করতে পারছে না। বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আসতে শুরু করলেও তার পরিমাণ এখনো বেশি না। তা ছাড়া আগামী মাসে সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ শুরু হবে। সেই কর্মসূচিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল সরবরাহ করার জন্য নতুন করে ওএমএস চালু করা হচ্ছে না। বাজারে চালের দাম অসহনীয় পর্যায়ে গেলে নিম্ন আয়ের মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে খোলাবাজারে চাল বিক্রি বা ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিক্রি করে সরকার। কিন্তু সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ সংকট দেখা দেওয়ায় গত মাস থেকে হাওরের তিন জেলা ছাড়া সারা দেশে সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি অকালবন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকা সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ওএমএস কার্যক্রমও আগামী ১৫ আগস্ট শেষ হয়ে যাবে। ওএমএসের প্রতি কেজি চালের মূল্য নির্ধারিত আছে ১৫ টাকা। একজন একবারে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত রবিবার পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল ও গমের মোট মজুদ ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল দুই লাখ ৩৯ হাজার টন, গম এক লাখ ৫৩ হাজার টন। যদিও গত বছর একই সময়ে মজুদের পরিমাণ ছিল আট লাখ ৮৭ হাজার টন। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি খাতে ২৪ হাজার টন এবং বেসরকারি খাতে দুই লাখ ১৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে।
এদিকে একজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে সরকারি পর্যায়ে তিন থেকে চার টন আর বেসরকারি পর্যায়ে সাত থেকে আট টন চাল আমদানি হয়। বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে এই আমদানি আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা থাকলেও আশানুরূপ হারে চাল না আসার কারণ হচ্ছে, ভারত থেকে চালের পরিবর্তে পাথর আসছে বেশি। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে চালের তুলনায় পাথর বহন করা অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় আমদানিকারকরা স্থলবন্দর দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে চাল আমদানি করতে পারছেন না।
বেসরকারি চাল আমদানিকারক নীপা অটো রাইসের স্বত্বাধিকারী কাজী কাইয়ুম শিশির কালের কণ্ঠ’কে বলেন, আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরও দেশে চালের দাম না কমার কারণ হচ্ছে, ভারত চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যেদিন বাংলাদেশ আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে সেদিনই ভারত চালের দাম বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে চালের দাম না কমার এটি একটা বড় কারণ। শুধু ভারত নয়, চাল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও দাম বাড়িয়েছে। এ জন্য দায়ী বাংলাদেশই। কারণ হাওরে বন্যার পর সরকার যখন বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় তখন চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে বাংলাদেশের সংকট, কী পরিমাণ চাল কেনা হবে তার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমারসহ সবগুলো দেশ চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। ব্যবসায়িকভাবে এ বিষয়টি ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি।
আমদানি শুল্ক শূন্যে নামানোর প্রস্তাব : বাজার স্থিতিশীল ও দ্রুত মজুদ বাড়াতে চাল আমদানির ক্ষেত্রে সব ধরনের শুল্ক তুলে দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে চাল আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়ার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল খাদ্য অধিদপ্তর।
এনবিআরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, চলতি বোরো মৌসুমে সাত লাখ টন সিদ্ধ চাল ও এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এপ্রিলে হাওর এলাকায় অকালবন্যার কারণে শুরুতেই অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। চালের বাজারদর সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় সংগ্রহ অভিযান সফল না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ভোক্তার স্বার্থে ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ বহাল থাকায় এ ক্ষেত্রে একধরনের স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মিলার, সচ্ছল কৃষক ও বড় বড় চাল ব্যবসায়ীর মধ্যে মজুদ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এতে বাজারে চালের সরবরাহ কমে গিয়ে বাজারদর বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হলে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি গতি পায়। চলতি অর্থবছরের মাত্র ২৩ দিনে এক লাখ ১৬ হাজার ৬১ টন চাল আমদানি হয়।
চিঠিতে আরো বলা হয়, মজুদ বাড়াতে ইতিমধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আনার চুক্তি হয়েছে। ভারত, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দুই লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। আরো এক লাখ টনের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। শুল্ক কমানোয় বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি বাড়ছে। প্রতিদিনই সরকারি গুদামে গড়ে চার-পাঁচ হাজার টন চাল পাওয়া যাচ্ছে। শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হলে আমদানি আরো বাড়বে।
চালের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শুল্ক হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ হয় রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি)। ফলে ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয়। এতে দেড় বছর ধরে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ২ মে চাল আমদানি শুল্কমুক্ত করতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশ্বের কোনো দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি বন্ধ ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এখন বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানি শুল্কমুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়লে বাজারে চালের দাম কমবে। কিন্তু ওই সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি।
বোরো সংগ্রহেও সাড়া নেই : অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না খাদ্য অধিদপ্তর। গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি গুদামগুলোতে মাত্র এক লাখ ৭৭ হাজার ৭৫১ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। ধান সংগ্রহ হয়েছে এক হাজার ৩৬৯ টন। অথচ বোরো মৌসুমে আট লাখ টন চাল ও সাত লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য ২৪ টাকা এবং প্রতি কেজি বোরো চালের সংগ্রহ মূল্য ৩৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে ২ মে, চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ অভিযান শেষ হতে বাকি আর মোটে ২৩ দিন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এত অল্প সময়ে সংগ্রহরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না। চলতি মৌসুমে কম বোরো সংগ্রহের রেকর্ড সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/08/09/529468