৯ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১০:১৮

রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দিতে কোনো সুখবর নেই

জিবলু রহমান

সাম্প্রতিক ভারি বর্ষণে রাজধানীর যেসব সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে জেগে উঠছে তছনছ হয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা রাস্তা। অলিগলির সড়কগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। এককথায়, পুরো রাজধানীর সব সড়কই এখন ক্ষতবিক্ষত ও গায়ে দগদগে ঘা। এরই মধ্যে নগরজুড়ে চলছে বেপরোয়া খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তির অন্ত নেই।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বর্তমানে রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সম্প্রতি গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় যেসব রাস্তার আধুনিকায়ন করা হয়েছে, সেগুলোরও বিভিন্ন স্থান বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডিএসসিসি এলাকায় সম্প্রতি যে শতাধিক উপসড়কের আধুনিকায়ন করা হয়েছে, জলাবদ্ধতার কারণে সেগুলোরও অনেক স্থান ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব সড়ক ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কই এখন ভাঙাচোরা। যেসব এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বা বিভিন্ন সেবা সংস্থার ভূগর্ভস্থ লাইন স্থানান্তর করা হচ্ছে সেগুলোতে চলাচলকারী মানুষের জন্য দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় তীব্রতর হয়েছে যানজট।
সামান্য বৃষ্টি হলেই এখন জলাবদ্ধতা দেখা দেয় রাজধানীতে। রাজপথ থেকে অলিগলি তলিয়ে যায়। কারণ আগে রাজধানীর চারপাশে যেসব খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতো সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যে যেভাবে পেরেছে দখল করেছে। এ তালিকায় রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, পাড়া-মহল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অনেক জায়গায় খাল দখলের পর তার ওপর স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। উদ্ধারের প্রসঙ্গ তুললেই কর্তৃপক্ষ বারবার খাল দখলমুক্ত করার আশ্বাস দেয়। আর বছরের পর বছর ধরে এ কাজের জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপায়, কিন্তু খাল উদ্ধার হয় না।
সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসা, তিতাস, ডিপিডিসি, বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একেবারেই সমন্বয় নেই। সমন্বয়হীন কাটাকাটির ফলে নগরবাসীর ভোগান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়। আবার এসব সংস্থা ভালো রাস্তা কাটার পর সেটা ঠিকমতো মেরামত করে যায় না। করলেও আগের আদলে ফিরে আসে না। ঠিকাদাররাও যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রেখে বিদায় নেন।
যানবাহনগুলোকে অনেক সাবধানে হেলেদুলে চলতে হচ্ছে রাজপথ দিয়ে। খানাখন্দে পড়ে যত্রতত্র ইঞ্জিন বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলো ছিল, ২০০৯ সালে সরকার তা অনুমোদন করে। কিন্তু বাস্তবায়নে ঢিলেমি দিয়ে বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলেছে। সরকার এই ঢিলেমি না করলে নগরীর বর্তমান অবস্থা হতো না। নগর ব্যবস্থাপনা এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার (ওয়ার ফুটিং) মতো কাজ করতে হবে।
নগর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কার্যত অজ্ঞ নীতিনির্ধারক এবং অনভিজ্ঞ নগর ব্যবস্থাপকদের সমন্বয়হীন কাজের ফলে ভুগতে হচ্ছে ঢাকার নগরবাসীকে। সাতটি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এই নগরীর উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার। এদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। অনেকে সমন্বয় করতেও চান না। কারণ, নিজে নিজে কাজ করলেই তাঁদের সুবিধা বেশি।
১৯ জুলাই ২০১৭ হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস আয়োজিত ‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন বিকল্প’ শীর্ষক দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এবং আশু ভবিষ্যতে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাধানের পথ হচ্ছে পূর্বদিকে পরিকল্পিত সম্প্রসারণ। সেটাই হবে অতি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা মেরামতের (রেট্রোফিট) চেষ্টার চেয়ে বেশি কার্যকর ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
সম্মেলনে ঢাকা সিটি উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন তাদের আলোচনায় সেবা খাতগুলোর কাজের সমন্বয়হীনতা, পরিকল্পনার অভাব ও সম্পদের ঘাটতিসহ বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চিত্র তুলে ধরেন। সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রশাসনিক রাজধানী ছাড়াও অর্থনীতির মূল কর্মকা- চলছে এই মহানগরকে কেন্দ্র করেই। দেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ভবিষ্যতেও ঢাকা-নির্ভরতা এড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ শহরটি দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই পরিকল্পনার অভাবে ভারসাম্যহীন ও বিশৃঙ্খল নগরে পরিণত হয়েছে। সেবা খাতে সমন্বয় ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নাগরিক সেবা সীমিত হচ্ছে।
সম্মেলনে জানানো হয়, ‘টুয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের মূল প্রতিবেদনটি আগামী মাসে পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশ করা হবে। এতে বলা হয়, মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকা- সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল ও অসম নগরায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অত্যধিক ঘনবসতি, নিম্নমানের বসবাসযোগ্যতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং বন্যা ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক অধিবাসী প্রায়ই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, কয়েক মাস পর্যন্ত ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তাও নগর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে এ রকম রোগ-ব্যাধি এবং জলাবদ্ধতার মতো নাগরিক সংকট তৈরি হচ্ছে; পরিবহন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় ট্রাফিক জামে বিনষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা-এমন বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা ও নাগরিক সেবা সংকটের কথা তুলে ধরেন তারা। উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে এসব সমস্যা সমাধানে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেওয়া হয়।
তারা বলেন, ঢাকা শহরের আধুনিকায়নে যথাযথ এবং টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ, সঠিক বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। নিজস্ব পরিবেশ ও সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন দেশের সফল নগরের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। তাদের মতে, সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নত শহরের মডেল অনুসরণ করলে ঢাকা হতে পারে দিল্লি কিংবা সাংহাইয়ের মতো সফল নগর। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে অবকাঠামো উন্নয়ন করা যায়।
অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ঢাকার নাগরিক পরিস্থিতি নিয়ে তুলে ধরা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ঢাকায় যান চলাচলের গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যা হাঁটার গতির চেয়ে সামান্য বেশি। এসব সমস্যা বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। একে বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করা গেলে ওই জনবলের উৎপাদন-দক্ষতা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারবে। সেটা কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয়সাধন এবং বিনিয়োগ সুুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের অপরিকল্পিত নগরায়ন রাজধানীর পরিবেশের আরও অবনতি ঘটাবে। বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিও বাড়বে। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই পূর্বদিকে বিশৃঙ্খল সম্প্রসারণ দৃঢ় হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, নইলে ওদিকটাও একই পরিণতি বরণ করবে। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা বলেন, যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য নগরী গড়া ও অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত হতে পারে পূর্ব সাংহাইয়ের পুডং এলাকা। সেখানে পরিকল্পনার মাধ্যমে যানজট নিরসন করা হয়েছে। পুডংকে ঢাকা অনুসরণ করতে পারে।
অনুষ্ঠানে দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত দিল্লি শহর এবং চীনের সাংহাইয়ের সাবেক ভাইস মেয়র কিঝেং ঝাও পুডংয়ের রূপান্তরের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

http://www.dailysangram.com/post/295349-